somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

টরন্টোর চিঠি ১ - নিষ্ঠুর এপ্রিল মাস - মহামারীর ঢেউ, ইউক্রেনের যুদ্ধ আর মূদ্রাস্ফীতি

২৯ শে এপ্রিল, ২০২২ সকাল ১০:১০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


বাংলাদেশে যখন গ্রীষ্মের খরতাপে অতিষ্ঠ জীবন, কানাডায় তখন এপ্রিলের শেষ সপ্তাহেও তুষার পড়ছে। সদ্য গজিয়ে ওঠা নবীন ঘাসের উপর রাতভর জমে ওঠা তুষারের অনেকটাই ধূয়ে গেছে সকালের বৃষ্টিতে। এ বছর শীত যেন শেষই হচ্ছে না। তার সাথে যুক্ত হয়েছে একের পর এক মহামারীর ঢেউ, রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের প্রকোপ আর জনজীবনে মূল্যস্ফীতির যন্ত্রণা। বলা হচ্ছে যে চার দশকের মধ্যে মুদ্রাস্ফীতি এখন সর্বোচ্চ। আর ইউক্রেনের যুদ্ধ অন্যান্য পণ্যের সাথে বিশ্বব্যাপী জ্বালানী এবং খাদ্যের দামের উপর বড় প্রভাব ফেলেছে।

হাসপাতালে করোনা রোগীর সংখ্যা আবার বাড়ছে, আর কমছে সেবা দানকারী প্রতিষ্ঠান গুলোতে কর্মীর সংখ্যা। গত ডিসেম্বর-জানুয়ারী মাসের অমিক্রনের ঢেউ শেষ হতে না হতেই এপ্রিলে আবার করোনা সংক্রমণের সংখ্যা বাড়ছে। হাসপাতালে, ক্লিনিকে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মানুষের সাথে মানুষের সরাসরি যোগাযোগে আরো মানুষ করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে। এতদিন পর্যন্ত শিশুরা অপেক্ষেকৃত কম সংক্রমিত হয়েছিল, কিন্তু প্রায় দুইবছর পরে স্কুলগুলো আবার যখন সব পুরোপুরি খুলে দিল, তখন থেকে বাচ্চারাও আক্রান্ত হতে শুরু করলো। আমার দশ বছর বয়সী মেয়েও এবার আর বাদ গেল না। স্কুল থেকে করোনা আক্রান্ত হয়ে সে তিন সপ্তাহ ভুগলো।

মানুষের শরীরে করোনার দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব এখনও চিকিৎসা বিজ্ঞানের গবেষণার বিষয়। প্রথমে যে জীবানুকে ফুসফুসের জন্য প্রাণঘাতী বলে মনে করা হয়েছিল, এখন দেখা যাচ্ছে শুধু ফুসফুসে নয় করোনার জীবানু কিডনি এবং হার্টের উপরেও ক্ষত সৃষ্টি করতে পারে। অনেকের শরীরে কোভিডের প্রভাব হতে পারে দীর্ঘস্থায়ী (covid-19 long haul) যার লক্ষণ ক্লান্তি, শ্বাসকষ্ট, কাশি, জয়েন্টে বা বুকে ব্যথা। অন্যান্য সমস্যাগুলির মধ্যে রয়েছে মনোযোগ দিতে অসুবিধা, বিষণ্নতা, পেশী ব্যথা, মাথাব্যথা, দ্রুত হৃদস্পন্দন এবং মাঝে মাঝে জ্বর।

অর্থনীতিতে কোভিডের প্রভাব সুদূরপ্রসারী। করোনায় আক্রান্ত হয়ে গত দুই বছরে যত মানুষ ছুটি নিয়েছিল বা কাজ ছেড়ে দিয়েছিল তারা সবাই কাজে ফেরেনি। এতে করে শ্রম-ঘাটতি তৈরী হয়েছে, প্রতিষ্ঠানগুলোর উৎপাদন খরচ গেছে বেড়ে। আবার অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে টাকা ছাপিয়ে সরকার মানুষের জন্য যে সব প্রণোদনা দিয়েছে তাতে করে অর্থের যোগান গেছে বেড়ে। সাপ্লাই চেইন সমস্যা, ক্রমবর্ধমান চাহিদা, উৎপাদন খরচ এবং সরকারী প্রণোদনা সব কিছুরই ভূমিকা আছে মূদ্রাস্ফীতির পিছনে। কয়েক মাস থেকেই বাজারে জিনিস পত্রের দাম বেড়ে গেছে। আবার যুদ্ধের কারণে জ্বালানী তেলের দাম এখন আকাশ ছোঁয়া, যার প্রভাব পড়েছে পরিবহন খাত থেকে সবখানে। এদেশের বাজার আমাদের মত বিশৃঙ্খল নয়, আর মানুষের গড় আয় বেশি বলে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেলেও তার চাপ মানুষ এখন পর্যন্ত সহ্য করছে।

মহামারী শুরু হবার পর থেকে বিগত দুই বছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সূদের হার ছিল ০.২৫ শতাংশ, যা গত তিন চার মাসে বেড়ে হয়েছে ১ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঘোষণা দিয়েছে সামনে সূদের হার আরও বাড়বে। মূদ্রাস্ফীতি যখন সর্বোচ্চ, তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূদের হার বাড়িয়ে মূদ্রাস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রের চেষ্টা করছে। মুশকিল হলো গত দুবছরে সূদের হার সর্বনিম্ন থাকায় অনেক মানুষ অল্প সূদে অনেক বেশী লোন নিয়ে বাড়ি কিনেছে। এ দেশের ব্যাংকগুলো তখন ১.৭ শতাংশ হারে ২৫ বা ৩০ বছরের জন্য লোন দিয়েছে মানুষকে বাড়ি কেনার জন্য। ফলে বাড়ির দাম গত দুই বছরে বহু গুনে বেড়ে গেছে। কিন্তু লোনের মেয়াদ সর্বোচ্চ ৫ বছর পর্যন্ত। অর্থাৎ মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে ৫ বছর পরে বাজারের চলতি সূদের হারে লোন রি-ফাইন্যান্সিং করতে হয়। কারো লোনের পরিমান যদি হয় পাঁচ লক্ষ কানাডিয়ান ডলার তাহলে ১.৭ শতাংশ সূদের হারে মাসে কিস্তি পরিশোধ করতে হয় ১৭৭৫ ডলার, যা সাধারণ একটি কর্মজীবি পরিবারের জন্য বহন করা কঠিন নয়। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সূদের হার বৃদ্ধির সাথে সাথে সূদের হার যদি ৬% হয়ে যায়, তবে মাসিক কিস্তির পরিমান হবে প্রায় ৩০০০ ডলার, যা একটি পরিবারের পক্ষে বহন করা কঠিন হবে। এমন হলে অনেক পরিবারই লোনের কিস্তি পরিশোধে অক্ষম হয়ে যাবে। যার পরিণতি হতে পারে অর্থনৈতিক মহামন্দা, যেমনটা ২০০০ সালে হয়েছিল।

পৃথিবীর অন্য অনেক দেশের মত কানাডা যখন মহামারীর ভারে কাতর, আর তার সামনে অনেকগুলো অর্থনৈতিক সংকট আর টানাপোড়েন এর মধ্যে শুরু হলো ইউক্রেনের যুদ্ধ। এই যুদ্ধ যে কোথায় গিয়ে শেষ হবে তা আমাদের জানা নেই। দুর্বিষহ এই রক্তপাত অনেকগুলো যন্ত্রণার উপর তীব্রতর আরেক যন্ত্রণা। তাই মনে হচ্ছে এ যেন টি এস এলিয়টের পোড়ো জমির (The Waste Land) নিষ্ঠুর এপ্রিল মাস। মরা মাঠ জুড়ে লাইলাক ফুলের মত ছড়িয়ে আছে জীবন, আশা আর স্মৃতি মিশে আছে একসাথে। বসন্তের বৃষ্টি নির্জীব বৃক্ষের মূলে নাড়া দিচ্ছে।

"April is the cruellest month, breeding
Lilacs out of the dead land, mixing
Memory and desire, stirring
Dull roots with spring rain." (The Waste Land - I. The Burial of the Dead by T. S. Eliot)

পরিশেষে: ইলিয়টের এই বড় কবিতাটা শেষ হয়েছে বৃহদারণ্যক উপনিষদের "দত্ত, দয়াধর্ম, দম্যতা" আর তার পর "শান্তি শান্তি শান্তি" এভাবে। বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনায় খুব প্রাসঙ্গিক বটে।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে এপ্রিল, ২০২২ রাত ১১:৫৫
১৩টি মন্তব্য ১৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কবিতাঃ হে বলবান

লিখেছেন ইসিয়াক, ২৮ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৪০

কে আছিস বলবান!
হ্ আগুয়ান।
দে সাড়া দে ত্বরা।
ধরতে হবে হাল,বাইতে হবে তরী, অবস্থা বেসামাল।

জ্বলছে দেখ প্রাণের স্বদেশ
বিপর্যস্ত আমার প্রিয় বাংলাদেশ।
মানবিকতা, মূল্যবোধ, কৃষ্টি, সভ্যতা, সংস্কৃতির বাতিঘর।
সর্বত্র আজ... ...বাকিটুকু পড়ুন

জুলাইয়ের তথাকথিত আন্দোলন পুরোটা ছিল মেটিকিউলাস ডিজাইন

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ২৮ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ২:১৬

জুলাইয়ের তথাকথিত আন্দোলনের পুরোটা ছিল মেটিকিউলাস ডিজাইন

লালবদর নীলা ইস্রাফিল এখন বলছেন ও স্বীকার করছেন যে—
জুলাইয়ের সবকিছুই ছিল মেটিকিউলাস ডিজাইন।
মুগ্ধের হত্যাও সেই ডিজাইনের অংশ।

অভিনন্দন।
এই বোধোদয় পেতে দেড় বছর লাগলো?

আমরা তো... ...বাকিটুকু পড়ুন

তারেক ৩০০০ কোটী টাকার লোভেই দেশে ফিরেছে

লিখেছেন জেন একাত্তর, ২৮ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:১০



তারেক এসেছে, বলেছে, I have a plan; তারেকের প্ল্যানটা কি? এই মহুর্তে তার প্ল্যান হতে পারে, নমিনেশন বাণিজ্য করে কমপক্ষে ৩০০০ কোটি টাকা আয়। ৩০০ সীটে গড়ে ১০... ...বাকিটুকু পড়ুন

বই : টক অব দ্য টাউন

লিখেছেন স্বপ্নের শঙ্খচিল, ২৮ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:০৮

বই : টক অব দ্য টাউন



একটি বই হঠাৎ করে এতটা আলোচনায় আসবে আমরা কি ভাবতে পেরেছি ?
বাংলাদেশের মানুষ অতি আবেগপ্রবন , বর্তমান রাজনৈতিক অস্হিরতার মধ্যে ও
বাঙালীর স্বভাবসুলভ অনুসন্ধানী... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকার মানুষের জীবন

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১৪


ঢাকাতে মানুষ বড় বিচিত্র ভাবে বেঁচে থাকে। নিয়মিত ঢাকার রাস্তার ঘুরে বেড়ানোর কারণে এই রকম অনেক কিছু আমার চোখে পড়ে। সেগুলো দেখে মনে হয় মানুষ কত ভাবেই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×