somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

টরন্টোর চিঠি ২ - কানাডায় পাঁচ বছর

০১ লা সেপ্টেম্বর, ২০২২ রাত ১০:৩৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



কানাডায় আসার আজ পাঁচ বছর হলো। পাঁচ বছর এই বড় দেশ, মাটি, জনপদ, এমনকি ব্রামটনের যে পাড়ায় আমরা থাকি সেটা ভাল করে চেনার জন্য যথেষ্ট না হলেও, আমাদের জীবন প্রবাহে এই পাঁচ বছরের প্রভাব অত্যন্ত গভীর।

কানাডায় প্রথম দিকের বছরগুলো ছিল উদ্বেগের, কষ্টের, বিষাদের। দিক ও কূলবিহীন অনিশ্চিত যাত্রাপথে উৎকন্ঠার শেষ ছিল না। অপরিচিত দেশে নতুন করে জীবন শুরু করার ক্লেশ আর জীবিকার সন্ধান দীর্ঘ ক্লান্তিকর। এ যেন কানাডার শীতকাল - কঠিন আর বিলম্বিত। দিনের পর দিন সূর্যের আলো দেখা যায়না, হীম ঠাণ্ডা রাতগুলো এত বড় যে শেষই হতে চায় না। যখন মধ্যপ্রাচ্যে আমাদের আপাত স্থিত সামাজিক জীবন, বন্ধু-বান্ধব আর ঈদ বা অন্য কোন সময়ে লম্বা ছুটিতে দেশে যাবার কথা মনে পড়তো, তখন বিষাদে মন ছেঁয়ে যেত।

যে কোন যাত্রাপথে একটা সময় যেমন পথই পথ দেখায়, তেমনি পাঁচ বছর পরে আজ দেখতে পাচ্ছি স্রোতের টানে অনেকটা পথ পার হয়েছি। কাজের কাজ তেমন কিছু করতে পারিনি হয়তো, সঞ্চয় বলতে নোনা-শেওলা আর কচুরিপানা ছাড়া মূল্যবান কিছু নেই। তবে পথ চলার যে আনন্দ তা পেয়েছি। নতুন কে চেনার যে স্ফূর্তি তার পুলক জড়িয়ে আছে আলো আধারের এই পাঁচ বছরের পথ চলায়।

এদেশে আসার আগে আগে ইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে একটা মাস্টার্স প্রোগ্রামে ভর্তি হয়েছিলাম। এখানে ভর্তির সুবাদে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের একটা এপার্টমেন্টে থাকার সুযোগ হয়েছিল। লালচে-ধুসর রংয়ের চারটি উচু বিল্ডিং খোলা মাঠের মধ্যে পাশাপাশি দাড়ানো। বিল্ডিংগুলো ১৫ তলা উচু আর দেখতে একেবারে একই রকমের। বিল্ডিংয়ের পাশে বাচ্চাদের খেলার একটা ছোট প্লে-গ্রাউন্ড, পাশে গাড়ি পার্কিয়ের জায়গা ও খেলার মাঠ। শীতের সময়ে যদিও সেই প্লে-গ্রাউন্ড বরফের নিচে চাপা পড়ে থাকে, কিন্তু গ্রীষ্মকালে বাচ্চাদের কল-কল্লোলে সেটা মূখরিত হয়ে ওঠে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ভবনগুলো ১০-১৫ মিনিটের হাটা পথের মধ্যে। আমার মেয়ের স্কুল একটু দূরে, যেতে হয় স্কুল-বাসে করে। স্কুল-বাস কাছেই একটা বিল্ডিংয়ে এসে থামে। মেয়েকে স্কুল-বাসে তুলে দিতে এসে বা ফেরার সময় অন্য অভিভাবকদের সাথে পরিচয় হয়। পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে আসা ছাত্র-ছাত্রীদের কেউ পিএইচডি কেউবা মাস্টার্স করছেন। বাসের জন্য দাড়িয়ে থাকার অবসরে এখানে আমাদের বেশ কিছু বাঙ্গালী পরিবারের সাথেও সুসম্পর্ক হয়েছিল। বাচ্চাদের জন্মদিনে, ঈদ বা অন্য কোন পার্বণে আমরা প্রায়ই কারো বাসায় একত্রিত হতাম।

আমরা যখন কানাডায় আসি তখন আমার স্ত্রী সন্তানসম্ভবা। আমাদের ইচ্ছা ছিল যে মধ্যপ্রাচ্যেই আমাদের সন্তানের জন্ম হবে, তারপর তিন-চার মাস পরে আমরা কানাডায় যাবো। কিন্তু যখন জানতে পারলাম সন্তান জন্মের পরে কানাডায় যেতে হলে বাচ্চার জন্য নতুন করে ভিসার আবেদন করতে হবে, তখন পরিকল্পনা পাল্টাতে হলো। ইতিপূর্বে ইমিগ্রেশনের জন্য যতগুলো দরখাস্ত লিখতে এবং আবেদনপত্র পূরণ করতে হয়েছে, সেই সব কাগজ একসাথে জোড়া দিলে চীনের প্রাচীরের সমান না হলেও পদ্মা-সেতুর সমান হবার সম্ভাবনা, অতএব নতুন করে আর কাগজপত্র পূরণ করার ধৈর্য ছিলনা।

এখানে এসে স্ত্রীর চেক আপের জন্য মিড-ওয়াইফারি বা ধাত্রী-সেবা ক্লিনিকে রেজিষ্ট্রেশন করেছিলাম। সেই ক্লিনিকে প্রথম দিকে দু-সপ্তাহ পর-পর আর ডেলিভারির সময় ঘনিয়ে এলে সপ্তাহে একবার আমাদের যেতে হতো। মিড-ওয়াইফ যাবতীয় সব চেক আপ করে প্র‌য়োজন অনুসারে আমাদের বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে পাঠাতেন। মিড-ওয়াইফের চেক আপের একটা অংশ ছিল কাউন্সেলিং বা পরামর্শ। গর্ভবতী নারী বা তার পরিবার যাতে তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে বাচ্চার জন্ম বিষয়ক সিদ্ধান্তগুলো নিতে পারে, পরামর্শের উদ্দেশ্যে সেটা নিশ্চিৎ করা। কাউন্সেলিংগুলো গর্ভাবস্থা সম্পর্কে পুরোদস্তুর বায়োলজি ক্লাস। আমার স্ত্রী তো বটেই প্রতি সপ্তাহে আমাকেও সেই ক্লাসে অংশ নিতে হতো। কানাডার সমাজ যে জ্ঞান-নির্ভর তা অনুভব করেছিলাম।

সে বছর অক্টোবরে আমাদের ছেলের জন্ম হলো। আমার স্ত্রীর সাথে অপারেশন থিয়েটারে আমাকেও থাকতে হয়েছিল। পর্দার আড়ালে বসে ডেলিভারির সময়টায় আমার কাজ ছিল শক্ত করে স্ত্রীর হাত ধরে থাকা। বন্দোবস্তটা সেভাবেই করা। জ্ঞানের সাথে সাথে মানবিকতা এবং সেবাকে এরা সংস্কৃতির অংশ করতে পেরেছিল। পরবর্তি সময়ে যাত্রাপথে আমরা যখন সেই মিড-ওয়াইফারি ক্লিনিকের সামনে দিয়ে যেতাম, তখন সেই দিনগুলোর এবং সেবাদানকারী মানুষগুলোর কথা মনে পড়তো।

এদেশে এসে আরেকটা জিনিস আমার ভাল লেগেছিল। সেটা হলো নারীর ক্ষমতায়ন বা নারীর স্বাধীনতা। শুধু যে অফিস আদালতে বা মন্ত্রীসভায় এদেশে নারীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ তা নয়। পেশায়, চিন্তায়, মননে এদেশের নারীরা পুরুষের সমান শুধু নয় বরং এগিয়ে। আমাদের দেশে যখন কোন মেয়ে তার পেশায় বা কাজে উন্নতি করে তখন তাকে পুরুষের সাথে পাল্লা দিতে হয়। পাল্লা দিতে গিয়ে তাকে অনেক ক্ষেত্রে পুরুষের মত হয়ে উঠতে হয়। এদেশে নারীরা শরীরের জড়তা কাটিয়ে উঠেছে বলেই হয়তো সহজাত নারীর গুনগুলো নিয়ে সবদিকে উৎকর্ষ সাধন করতে পারে। তাই দেখি অফিসের কাজে একসাথে অনেকদিকে খেয়াল রাখার বিষয়ে তাদের সমকক্ষ কোন পুরুষই নয়। কানাডার প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী (বর্তমানে ডেপুটি প্রাইম মিনিস্টার) তখন নাফটা চুক্তি নিয়ে আমেরিকার ট্রাম্প প্রশাসনের সাথে দফায় দফায় বৈঠক আর দরদস্তুর করছেন। তিন সন্তানের মা এই পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে বৈঠকগুলোকে তার গর্ভাবস্থায় প্রথম সংকোচন (contractions), দ্বিতীয় সংকোচন, তৃতীয় সংকোচন এভাবে তুলনা করেছিলেন। এমন অদ্বিতীয় তুলনা আমি আর কখনো শুনিনি। নারীর স্বাধীনতা যেখানে নেই সেখানে মানবাধিকার বলে কিছু নেই।

মাস্টার্স প্রোগামের মাঝামাঝি সময়ে আমি একটা কাজ পেলাম। বেল নামের একটা ফোন কোম্পানীতে কাজ, তবে আমার চাকরী পার্মানেন্ট নয় চুক্তিবদ্ধ। আপাতত ছয় মাসের চুক্তি, কাজ পছন্দ হলে তারা চুক্তির মেয়াদ বাড়াবেন। মাস্টার্স প্রোগামের কোর্সগুলো বিকেল বা সন্ধ্যায় নেবার সুযোগ ছিল, অতএব দেরী না করে কাজে ঢুকে পড়লাম। কাজে ঢোকার পরে ব্যস্ততা বাড়লো। বিকেল পর্যন্ত আপিস করে বাসায় ফিরি, তারপর সন্ধ্যায় ক্লাসে যাই। আগে বাসায় যে সময় দিতে পারতাম তা দেওয়া হয় না। তারপরও সপ্তাহ শেষে ছুটির দিনগুলো মন্দ যায় না। গ্রীষ্মের বন্ধে বন্ধুরা মিলে সপরিবারে ঘুরতে বের হই। কখনো লেকের ধারে সৈকত বা উদ্যান, কখনো নায়াগ্রা ফলস বা অন্য কোন লেক, অথবা সরু পাথুরে নদীর তীরে বা জঙ্গলের ধারে আমাদের চড়ুইভাতি বসে।

অকূল পাথারে যে পাতার ভেলা ভাসিয়েছিলাম, জীবনের স্রোতে তা ভেসে চলেছে। ঢেউ একটু কমলে যখন নিজের দিকে তাকাই, তখন মনে হয় এ কোথায় এলাম, কোথায় যাচ্ছি।

"পাতার ভেলা ভাসাই নীরে,
পিছন-পানে চাই নে ফিরে॥
কর্ম আমার বোঝাই ফেলা, খেলা আমার চলার খেলা।
হয় নি আমার আসন মেলা, ঘর বাঁধি নি স্রোতের তীরে॥
বাঁধন যখন বাঁধতে আসে
ভাগ্য আমার তখন হাসে।
ধুলা-ওড়া হাওয়ার ডাকে পথ যে টেনে লয় আমাকে--
নতুন নতুন বাঁকে বাঁকে গান দিয়ে যাই ধরিত্রীরে॥" (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর - গীতবিতান)

সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা অক্টোবর, ২০২৩ সকাল ৮:০৪
১৬টি মন্তব্য ১৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×