নোম চমস্কির বাকরোধ হয়েছে। গুরুতর অসুস্থ হয়ে তিনি কথা বলার এবং লেখার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন। আমরা যারা চমস্কির আমেরিকার আধিপত্যবাদী নীতি, পুঁজিবাদ, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যমের ওপর বহুজাতিক কোম্পানির প্রভাবের লেখা পড়ে এবং বিষয়গুলো নিয়ে তর্ক করে বড় হয়েছি, তাদের জন্য চমস্কির বাকরোধের ঘটনাটি অপ্রত্যাশিত না হলেও বেদনার।
অপ্রত্যাশিত নয় এ কারণে যে চমস্কির বয়স এখন ৯৬। ২০১৫ সালের পর থেকে তিনি পাকাপাকি ভাবে ব্রাজিলের সাও পাওলো শহরে থাকেন। গত বছর গ্রীষ্মে ব্রাজিলের হাসপাতালে যখন তিনি চিকিৎসাধীন ছিলেন, তখন একবার তার মৃত্যু নিয়ে গুজব উঠেছিল। কিন্তু সে যাত্রায় তিনি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন।
সংখ্যায় কম হলেও চমস্কি বাংলাদেশের অল্প কিছুসংখ্যক তরুণ তরুণীকে প্রভাবিত করেছিলেন, যারা "তৌহিদি" না হয়েও ফ্যাসিস্ট আওয়ামী রেজিম এবং হাসিনা গংয়ের কঠোর সমালোচক। ইসরাইল-প্যালেস্টাইনের ইস্যুতে যারা ইহুদি বিদ্বেষী না হয়েও অথবা হামাস বা ইসলামিক জিহাদের মতো দলের আদর্শবাহী না হয়েও ইসরাইলি গণহত্যা, শিশু-হত্যা, অপহরণ-নির্যাতন, গাজার ধ্বংস সাধন, নাগরিকদের বাস্তুচ্যুতি এবং ফিলিস্তিনিদের জাতিগত নির্মূলের বিষয়ে উচ্চকণ্ঠ।
আমেরিকার ইসরাইলি অংশীদারত্ব, আধিপত্যবাদ ও মোড়লিপনার স্বরূপটিকে বুঝতে আমরা বহুবার চমস্কির প্রজ্ঞার খোলা জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছি - বৌদ্ধিক কারণে শুধু নয়, অনেক ক্ষেত্রে হৃদয়ের অনুভবকেই বুদ্ধিবৃত্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচারের জন্যে।
২০২৩ সালের অক্টোবরে, ইসরাইল যখন গাজায় গণহত্যা শুরু করল, তখন একদিন হঠাৎ লক্ষ করলাম যে প্রচারমাধ্যমগুলো সম্পূর্ণ নির্লজ্জভাবে ইসরাইলের গণহত্যাকে সমর্থন করছে। কাজে যাওয়ার সময় আমি যে রেডিও চ্যানেলে খবর শুনতাম এবং যেখানে প্রায়শই যুক্তি-বুদ্ধিপূর্ণ আলাপ-আলোচনাগুলো মুগ্ধ হয়ে শুনতাম, একদিন দেখি সেখানে তারা প্যালেস্টাইনের সমর্থনকারী শান্তিপূর্ণ একটি জনসমাবেশকে "অ্যান্টিসেমিটিক" এবং "ঘৃণার মিছিল" নাম দিয়েছে। পরে দেখলাম, শুধু একটি নয়, প্রায় সব মিডিয়াই ইসরাইলের গণহত্যাকে সমর্থন দিচ্ছে এবং মিথ্যা তথ্য সরবরাহ করে "হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলছো" - এইভাবে মানুষের "সম্মতি" কেনার চেষ্টা করছে।
চমস্কির "ম্যানুফ্যাকচারিং কনসেন্ট" বা "সম্মতির উৎপাদন" যে কতখানি সত্য এবং প্রাসঙ্গিক হতে পারে, সেটি তখন গভীরভাবে অনুভব করেছিলাম। এডওয়ার্ড হারম্যান নামের আরেকজন লেখকের সঙ্গে লেখা এই বইয়ে চমস্কি যুক্তি দেন যে গণমাধ্যম রাজনৈতিক ব্যক্তি ও ক্ষমতাবানদের জন্য প্রচারণার একটি হাতিয়ার মাত্র। প্রচারযন্ত্র কেবল তথ্য দেয় না, বরং এটি একটি মগজধোলাইয়ের মতাদর্শিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে। প্রোপাগান্ডা মডেল নামক একটি ধারণা তারা প্রবর্তন করেন, যেটি ব্যাখ্যা করে কীভাবে মিডিয়া ক্ষমতাবানদের স্বার্থে তথ্য ফিল্টার করে এবং ভিন্নমত পোষণকারীদের কণ্ঠস্বর রুদ্ধ করে।
চমস্কি ব্যাখ্যা করেছিলেন যে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে দিনের পর দিন একটি মতাদর্শ মানুষের ভেতরে ঢুকিয়ে দেওয়ার পরে সেই আদর্শে আজ্ঞাবাহী একজনকে উচ্চপদের চাকরির জন্য নির্বাচন করা হয়। যারা ক্ষমতার প্রতি সবচেয়ে বেশি আনুগত্য করে, তারাই কেবল শীর্ষে পৌঁছাতে পারে, যাতে করে সমাজের উচুতলার লোকদের ক্ষমতার ওপর নিয়ন্ত্রণ অক্ষুণ্ণ থাকে।
কিন্তু কদাচিৎ এমনটা ঘটে যায় যে, চিরকালের এই আজ্ঞাবাহীরা কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিদ্রোহ করে ফেলে। ক্ষমতাশীলদের খুশি করার চেয়ে কোনো কোনো ক্ষেত্রে হয়তো মনুষ্যত্ব বা বিবেকবোধ সেই শীর্ষ পদের লোকটিকে তাড়িত করে। ঠিক এমনটি ঘটেছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রধান প্রসিকিউটর করিম আহমদ খানের ক্ষেত্রে। খান যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে নেতানিয়াহু এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী গ্যালান্টের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। তখন খানের মতো লাইনচ্যুত শীর্ষ পদধারীদের জন্যও এলিটদের বিকল্প একটি ব্যবস্থা থাকে। সেটি হলো, তাদের খ্যাতিকে ধূলায় মিশিয়ে দেওয়া এবং জীবনের জন্য একটি শিক্ষা দেওয়া। খানের ক্ষেত্রে "জীবনের শিক্ষা" এবং অপবাদ সুদূরপ্রসারী হয়েছিল। এই অপবাদ এবং প্রচারণার শিকার শুধু তিনি ছিলেন না, তার স্ত্রী এবং সন্তানদেরকেও ইসরায়েলি অপবাদ প্রচারণার লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছিল।
ট্রাম্প ক্ষমতায় আরোহনের পরপরই যেসব নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেছেন তার একটি ছিল করিম খানকে আমেরিকায় নিষিদ্ধ ঘোষণা করা। শীর্ষ পদে থাকা অন্যদের জন্য এটা একটা সতর্কীকরণ বার্তাও বটে, যেন তারা খানের মতো বিবেকবান হয়ে না ওঠেন।
চমস্কি বলেছিলেন যে, যে মানুষেরা তাদের বিপুল অর্থবিত্ত সত্ত্বেও আরও ধনলিপ্সার জন্য মানবজাতির অস্তিত্ব পর্যন্ত বিসর্জন দিতে পারে, তাদেরকে ভাষায় প্রকাশ করা যায় এমন কোনো ইংরেজি শব্দই তিনি খুঁজে পাননি। অশুভ (evil) শব্দটিও সেইসব মানুষের দুরভিসন্ধির গভীরতাকে প্রকাশ করতে পারে না। মাস্ক-ট্রাম্পের বিশ্ব এখন এমন এক গভীর সংকটময় সময়ে দাঁড়িয়ে, যেখানে চমস্কির প্রজ্ঞা আগের চেয়েও আমাদের বেশি প্রয়োজন ছিল। অন্যায়ের নির্ভীক সমালোচক হিসেবে তাকে আমাদের বহুবার, বহুভাবে প্রয়োজন হবে।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ সকাল ৮:০৫