somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

[ফিরে দেখা] স্বৈরাচারী এরশাদের গদি বাঁচানোর কৌশল হিসেবে পাতানো দাঙ্গা, দৈনিক ইনকিলাবের নির্লজ্জ সহযোগিতা এবং আমাদের অসাম্প্রদায়িক জনগন

০৪ ঠা আগস্ট, ২০১১ ভোর ৪:২১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
পোস্ট উৎসর্গঃ ব্লগার ইমন জুবায়ের




১৯৯০ সালের অক্টোবর মাস। এরশাদ বিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে উঠছে। দুই নেত্রী শেষ পর্যন্ত একসাথে আন্দোলন করতে রাজি হয়েছেন। সবচেয়ে বড় কথা, সাধারন জনগনও এই আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়েছে। এর আগের দু'টি বড় আন্দোলন (৮৬ এবং ৮৭) এরশাদ নির্বাচনের ঘোষনা দিয়ে চাপা দিয়ে দিয়েছিল। এবার লক্ষন খুব খারাপ। বড় ধরনের একটা ট্রাম্প কার্ড না ছাড়লে তার পক্ষে টিকে থাকা মুশকিল হবে।

এই অবস্থায় এরশাদের ভাগ্যে সুলক্ষন নিয়ে আসে ভারতের কট্টর হিন্দুবাদী দল বিজেপি। বহুদিন ধরেই তারা বাবরী মসজিদ ভেঙ্গে রামমন্দির নির্মানের দাবি জানিয়ে আসছিল। অবশেষে ৩০শে অক্টোবর হাজার হাজার হিন্দু মৌলবাদী মসজিদ ভাঙ্গার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। প্রচুর লোক হতাহত হয় এবং সরকার প্রায় লক্ষাধিক মানুষকে গ্রেফতার করে। পুলিশের প্রবল বাধার মুখে মসজিদটি কিন্তু তারা আদতে ভাঙ্গতে পারেনি।

চতুর এরশাদ ভারতের এই দুঃখজনক পরিস্থিতির ফায়দা তুলে বাংলাদেশের আন্দোলনকে নস্যাত করার এবং জনগনের মনোযোগ অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেয়ার এক হিংস্র পরিকল্পনা করে। একাজে তার সহযোগী ছিল তার সরকারেরই প্রাক্তন ত্রান মন্ত্রী রাজাকার মান্নান এবং প্রেসিডেন্ট জিয়ার স্নেহভাজন ঢাকার প্রথম মেয়র আবুল হাসনাত। মান্নান তার বহুল প্রচারিত দৈনিক ইনকিলাবে ৩১ অক্টোবর ৮ কলামে বাবরী মসজিদ ভেঙ্গে ফেলার মিথ্যা উস্কানিমূলক খবর ছাপে। আজকের মত অবাধ তথ্যপ্রবাহ, ইন্টারনেট, বিদেশি চ্যানেল না থাকায় এই খবরের সত্যতা তাৎক্ষনিকভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি।

আবুল হাসনাত এইদিনের আগ পর্যন্ত বিএনপির সাথেই ছিল। পুরোনো ঢাকার আদি বাসিন্দা হাসনাতের তার এলাকায় ব্যাপক প্রভাব। ইনকিলাবে খবর আসার সাথে সাথেই পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারে হাসনাত তার গুন্ডা বাহিনী লেলিয়ে দেয় ঢাকেশ্বরী মন্দির এবং আশেপাশের হিন্দু অধ্যুষিত এলাকার উপর। এছাড়া চট্টগ্রাম এবং দেশের আরো কিছু অঞ্চলে এরশাদের সন্ত্রাসী বাহিনী হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘরবাড়ী ও ব্যবসা লুট এবং মন্দির ভাঙচুর করে। এইদিনই লালবাগ, সূত্রাপুর, কোতোয়ালিতে কারফিউ জারি করা হয়।

পরদিন মিথ্যা এবং উস্কানীমূলক খবর ছাপানোর অভিযোগে ইনকিলাবের ডিক্লারেশন বাতিল করা হয়। এছাড়া পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনের বাইরে অজুহাত দিয়ে এরশাদ পুরো ঢাকায় কারফিউ জারি করে। দেশের অন্যান্য স্থানেও খোদ পুলিশের সামনেই মন্দির ভাঙচুর করা হয়। এসবই এই আশায় যে দাঙ্গা ভালমত শুরু হলে জনগন সরকারবিরোধী আন্দোলনের কথা ভুলে যাবে। এছাড়া কারফিউ দিয়ে মানুষকে ঘরে বসিয়ে রাখার উপায় তো ছিলই।

কিন্তু এরশাদের এই চাল সম্পূর্ন ব্যর্থ হয় জনগনের অংশগ্রহনের অভাবে। শুধুমাত্র গুন্ডাবাহিনী দিয়ে বড় মাপের একটা দাঙ্গা তৈরী করা সম্ভব ছিল না। বাংলাদেশের মানুষ কমবেশি অসাম্প্রদায়িক। অনেক ক্ষেত্রেই হিন্দু-মুসলমান পরষ্পরকে "অপছন্দ" করতে পারে, কিন্তু সহজে "ঘৃনা" করে না। রামদা-চাকু নিয়ে আল্লাহু আকবর বা বল হরি বোল ডাক দিয়ে লুটপাট, খুনজখম করার মত পরিস্থিতি এ অঞ্চলে নেই। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এমন একটি রোগ যেটি কোন অঞ্চলে একবার শুরু হলে কখনোই পুরোপুরি নির্মূল করা যায় না কারন তখন দুই সম্প্রদায় পরষ্পরের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। নিয়মিত বিরতিতে এই অবিশ্বাস ভয়ংকর রুপ নিয়ে ফিরে আসে। বিশ্ববেহায়া এরশাদ ক্ষমতার লোভে বাংলার মাটিতে এই বিষবৃক্ষ রোপণ করতে চেয়েছিল। ৯ বছরের শাসনামলের সকল অপকর্ম আর সীমাহীন দূর্নীতিকে ছাপিয়ে এটিকেই তার সর্বনিকৃষ্ট কাজ বলে ধরে নেয়া যায়।

জনগনকে উস্কানি দিয়ে পথে নামাতে ব্যর্থ হয়ে এরশাদ অবশেষে নভেম্বরের ৪ তারিখে কারফিউ প্রত্যাহার করে নেয়। দিন সাতেকের ভেতর ইনকিলাবের ডিক্লারেশনও ফিরিয়ে দেয়া হয়। এর ঠিক একমাসের মাথায় বিশ্ববেহায়ার খপ্পর (১) থেকে মুক্ত হয় বাংলাদেশ।

(১) বিশ্ববেহায়ার খপ্পরঃ শিল্পী কামরুল হাসান ১৯৮৮ সালে পাবলিক লাইব্রেরী মিলনায়তনে (খুব সম্ভব এখন এটার নাম শওকত ওসমান মিলনায়তন) জাতীয় কবিতা পরিষদের উৎসব চলাকালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মারা যাবার কিছুক্ষন আগে তিনি যে শেষ স্কেচটি করেছিলেন তার নাম ছিল "দেশ আজ বিশ্ববেহায়ার খপ্পরে"। প্রাসঙ্গিক বিধায় পোস্টে এই কালজয়ী স্কেচটি সংযুক্ত করা হল।


==============================================


* এই লেখা যখন লিখছি, তখন ব্লগার ইমন জুবায়েরের মোট পোস্ট সংখ্যা ১২০৬টি। মৌলিক লেখায় এটাই কি বাংলা ব্লগে সর্বোচ্চ? আর কেউ কি তার ধারে কাছে আছেন? অবসর নেয়ার আগে উনি পোস্ট সংখ্যা যেখানে রেখে যাবেন, কেউ কি তার রেকর্ড ভাঙতে পারবেন কোনদিন? তার সম্পর্কে অনেক আগে একটা কথা বলেছিলাম, সেটাই আবার বলি - "আমার তো প্রায়ই মনে হয়, ইমন জুবায়ের কোন ব্যাক্তি না, বরং একটা জনা পচিশেক কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়ে একটা অফিসের নাম! এত পড়া, এত লেখা আর এত বিষয়বৈচিত্র্য একজনের পক্ষে আমি অসম্ভবই মনে করি। হিন্দুশাস্ত্রে কোন এক দেবতার যেন দশটা মাথা আছে (কি নাম তার? দশভুজ? নাকি দশভুজ দুর্গাকে বলে?)। আমাদের ইমন জুবায়েরের মাথা আছে পঁচিশটা।" ইমন জুবায়েরের লেখা থেকে যত নতুন জিনিস শিখেছি, মনে হয় না সারাজীবনেও কোন একজন ব্যক্তির কাছ থেকে এতটা শিখেছি। এই পোস্ট তার প্রতি আমার গুরুদক্ষিনা।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা আগস্ট, ২০১১ সকাল ১০:০৭
৫৮টি মন্তব্য ৫৯টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৫৯

বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×