আমার বন্ধু রফিকের বিয়ে।
সে সাত বছর পর কুয়েত থেকে এসেছে। বিয়ে করার জন্যই এসেছে। রফিক একদিন আমার বাসায় এসে হাজির। আমি তাকে প্রথমে দেখে চিনতেই পারি নাই। বেশ মোটা হয়ে গেছে। ফর্সা হয়ে গেছে। চেহারার মধ্যে কেমন সুখী সুখী ভাব। আমাকে দেখেই জড়িয়ে ধরলো রফিক। আমি বললাম, আপনি কে ভাই? পরিচয় দিলো। তারপর চিনলাম। আমার একটা সমস্যা আছে, কিছুদিন কারো সাথে দেখা না হলেই তাকে মনে রাখতে পারি না। এমন কি তার নামটাও মনে থাকে না। যাই হোক, রফিক তার বিয়ের দাওয়াত দিয়ে গেল। এবং খুব করে বলেছে, যেতেই হবে। অন্য কোনো উপায় নাই। আমি কথা দিয়েছি আমি তার বিয়েতে যাবো। রফিক অল্প দিনের ছুটিতে এসেছে সে আবার কুয়েত চলে যাবে। আমি রফিকের বিয়েতে যেতে রাজী হয়েছি কারন, সে আমাকে মনে রেখেছে। আজকাল কে কাকে মনে রাখে! স্কুল লাইফের বন্ধু তো অনেক ছিলো- কই কেউ তো খোঁজ নেয় নি।
রফিকের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার দেবিদ্বারে।
এর আগে আমি বেশ কয়েকবার কুমিল্লা গিয়েছি কিন্তু দেবিদ্বারে আগে কখনও যাওয়া হয় নাই। চার দিনের জামা কাপড় নিয়ে আমি কুমিল্লায় চলে এলাম। চমৎকার গ্রাম। মাইলের পর মাইল ধানক্ষেত। ক্ষেতে কৃষক কাজ করছে। মাটির রাস্তা। মাটির রাস্তায় ভ্যানগাড়ি চলছে। নানান রকম গাছগাছালি। নানান রকম পাখির ডাক। এককথায় পুরো গ্রাম সবুজ। সবুজের চেয়ে সুন্দর রঙ দুনিয়াতে আর নাই। প্রতিটা বাড়িতেই বড় বড় পুকুর আছে। বড় বড় উঠান। গ্রামে এসে মনটা খুশিতে ভরে গেল। আমি সারা জীবন এরকম পরিবেশেই থাকতে চেয়েছিলাম। বন্ধু রফিকের বাড়ি দেখে আমি মুগ্ধ! বিশাল বাড়ি। বাড়ির চেয়ে উঠান তিন গুন বেশি বড়। বাড়ির চারপাশে নানান রকম গাছ। গাছ গুলো অনেক বড় হয়েছে। চৌচালা ঘর। বাড়িতে বিদ্যুৎ আছে। নিজেদের গরু-ছাগল আছে। বনেদী গৃহস্থ বাড়ী। এখানে এসে জানতে পারলাম, এই গ্রামে হতদরিদ্র কোনো পরিবার নেই। প্রতিটা পরিবারের এক দুইজন করে বিদেশ থাকে।
বিয়ে উপলক্ষ্যে বাড়ি ভরতি মানুষ।
বন্ধু রফিককে ছাড়া আমি আর কাউকেই চিনি না। চেনার দরকারও নেই আমার। আমি এসেছি বন্ধুর বিয়েতে। আমি এসেছি গ্রামের সৌন্দর্য উপভোগ করতে। রাতের বেলা সবাই মিলে বাড়ির উঠানে মাদুর পেতে খেতে বসলাম। কমপক্ষে পঞ্চাশজন লোক তো হবেই। এর মধ্যে বাচ্চারা খুব দৌড়ঝাপ করছে। চেচামেচি করছে। আমি মন ভরে খেয়ে যাচ্ছি। চমৎকার নানান পদের খাবার। রান্নাও বেশ হয়েছে। নানান রকম দেশী মাছ, দেশী মূরগী। বেশ আরাম করেই খাচ্ছি। প্রতিবেলা এরকম মজার মজার খাবার পেলে এই গ্রামে পাকাপাকিভাবে থেকে যেতে আমি রাজী আছি। এমন সময় কোথা থেকে একটা মেয়ে এলো, বলল, আপনি তো কিছুই খাচ্ছেন না? আমি মেয়েটার দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। সুন্দর হাসিখুশি মুখের একটা মেয়ে। চোখে কাজল দিয়েছে মোটা করে। মেয়েটার মুখটা ভীষন মায়ামায়া। দীর্ঘক্ষন অনায়াসে এই মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকা যায়। বিরক্ত লাগবে না একটুও। মেয়েটা আমার পাশেই একটা প্লেট নিয়ে খেতে বসলো। আমার খাওয়া শেষ তবু মেয়েটা জোর করে একহাতা গরুর মাংস দিয়ে দিলো। বলল, আমার খাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত আপনি উঠবেন না।
পরের দিন খুব ভোরে ঘুম ভেঙ্গেছে।
সকালের গ্রাম দেখতে বের হয়েছি কাঁধে ক্যামেরা নিয়ে। একাএকা হাঁটছি। বেশ শীত। চারিদিকে কুয়াশা। দুই হাত দূরের জিনিসও দেখা যায় না এমন অবস্থা। গলায় একটা মাফলার প্যাচিয়ে নিয়েছি। এই যে শুনুন...., হঠাত মনে হলো কেউ একজন আমাকে ডাকছে। অথচ আমি চারিদিকে কুয়াশা ছাড়া কিছুই দেখতে পারছি না। মেয়েটা কাছে আসতেই চিনতে পারলাম। গতকাল রাতে আমরা পাশাপাশি বসে ডিনার করেছি। কুয়াশা ভেজা প্রথম সকালের আলোতে মেয়েটাকে দেখে দ্বিতীয় বার মুগ্ধ হলাম। মাথা ভরতি চুল একদম কোমর পর্যন্ত। সাদা রঙের একটা জামা পরা। ওড়নাটা লাল। হাতে মেহেদি দেওয়া। মনে হয় বিয়ে উপলক্ষ্যে মেহেদি দিয়েছে। হাঁটতে হাঁটতে মেয়েটার সাথে অনেক কথা হলো। মেয়েটার কন্ঠ অতি মিষ্টি। শ্রুতিমধুর। বাচ্চাদের মতো দুই হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলে। মেয়েটা আমাকে তার গ্রাম ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখালো। মেয়েটার নাম রুবা। একসময় একটা বাড়ির সামনে থেমে রুবা বলল, এটা আমাদের বাড়ি। আমি দেখলাম- ছবির মতো সাজানো গুছানো খুব সুন্দর একটা বাড়ি। বাড়ির সামনে বিশাল বাগান। এই বাগান রুবার নিজের হাতে করা। মেয়েটার রুপ যেমন আছে, তেমনি গুনও আছে।
রুবা তার বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান।
রুবা'র মা আমাকে বেশ আদর যত্ন নিয়ে সকালের নাস্তা দিলেন। নাস্তা দেখে আমি অবাক! তারা কি জানতেন আমি আসবো? এতো এতো আয়োজন! ইচ্ছে মতো খেলাম হাঁসের মাংস দিয়ে চালের আটার রুটি। সব শেষে চা। খাটি গরুর দুধের চা। চা-টা এত ভালো হয়েছে যে আমি পরপর দুই কাপ খেয়ে নিলাম। রুবার বাবার সাথে দেখা হলো না, উনি দাউদকান্দি গিয়েছেন। রুবার মা বললেন, দুপুরে তাদের বাসায় খেতে। তখন রুবার বাবা থাকবে তার সাথেও পরিচয় হয়ে যাবে। আমি বললাম, ওকে। এরপর রুবা বলল, চলুন আপানকে পুরো দেবিদ্বার ঘুরিয়ে দেখাই। গেলাম রুবার সাথে- উটখাড়া মাজার, বনকোট মুন্সী বাড়ি এবং বাঙ্গুঁরী বটগাছ। ইচ্ছা মতোন প্রকৃতির ছবি তুললাম। রুবার অনেক ছবি তুলে দিলাম। ছবি দেখে রুবা মুগ্ধ! দুপুরে রুবাদের বাসায় খেলাম। এমন ভালো রান্না বহু দিন খাই নি। দেশী রুই মাছের স্বাদটা যেন আজও মুখে লেগে আছে। সবার শেষে দিলো পায়েস। এমন ভালো পায়েস আমার জীবনে আমি খাই নি। আমি মন খুলে রান্নার প্রশংসা মকরলাম।
টানা চারদিন আমার কাটলো রুবার সাথে।
দারুন আনন্দময় সময় পার করেছি। বিদায় নেওয়ার সময় আমি রুবার চোখে পানি দেখেছি। রুবা'র চোখে পানি দেখে আমার ভীষন খারাপ লেগেছে। আমি রুবার চোখের পানি মুছে দিলাম। বললাম, আমাদের আবার দেখা হবে। কাঁদে না। প্লীজ কাঁদে না। ঢাকা এসে আমি রুবাকে প্রায় ভুলেই গেলাম। প্রায় চার মাস পর একদিন রুবা আমার বাসায় এসে উপস্থিত। আমি প্রচন্ড অবাক! রুবা আমার বাসার ঠিকানা পেলো কোথায়? তাছাড়া রুবা বেছে বেছে এমন দিনেই এসেছে, যেদিন বাসায় কেউ নেই। শুধু আমি একা।
রুবা বলল, তার বাবা মা তাকে বিয়ে দেওয়ায়র জন্য ছেলে খুঁজছে। সে আমাকে বিয়ে করতে চায়- যদি আমি রাজী থাকি। আমি বললাম, না আমি রাজী না। রুবা বলল, তার নামে অনেক বিষয় সম্পত্তি আছে। আমি বললাম, না আমি রাজী না। রুবা কাঁদতে শুরু করলো। বলল, তার নামে পীর ইয়ামেনী মার্কেটে তিনটা দোকান আছে। দোকান থেকে প্রতি মাসে নব্বই হাজার টাকা ভাড়া আসে। এই টাকা দিয়ে আমাদের সংসার সুন্দর চলে যাবে।
আমি রুবা'কে বললাম, বিয়ের কথা আমি এখন ভাবছি না। রুবা বলল, তুমি যদি বলো তাহলে আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করতে রাজী আছি। আমি বললাম, স্যরি। মেয়েটা খুব কাঁদছে। দেখে আমার খুব মায়া হলো। ছোটবেলা থেকেই মেয়েদের চোখের পানি আমি সহ্য করতে পারি না। আমি চোখের পানি মুছে দিয়ে বললাম, ছিঃ রুবা কাঁদে না। রুবা কাঁদতে কাঁদতে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। রুবা আমাকে ঠোঁট এগিয়ে দিলো। আমি বললাম, না। কিন্তু এক আকাশ ভালোবাসা নিয়ে রুবার কপালে একটা চুমু খেলাম। রুবা বেশ কেঁপে উঠলো। আরো শক্ত করে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। রুবা শরীরের গন্ধটা বেশ মিষ্টি। আমি বললাম, তুমি বসো। আমি আসছি। আমি দ্রুত রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার কিনে আনলাম। দুপুরে দু'জন একসাথে খেলাম। গান শুনলাম। হাতে হাত রাখলাম। এর মধ্যে রুবা আরও দু'বার কাঁদলো। ছাদে গেলাম। ব্যলকনিতে গেলাম। রুবা আমার হাত ধরে বলল, আমাকে ভুলে যাবে নাতো? বিকেলে রুবাকে বিদায় দিলাম। এরপর রুবার সাথে আমার আর দেখা হয়নি। আমি জানি না সে এখন কোথায় আছে? কেমন আছে? তবে জানতে ইচ্ছা করে। রুবাকে দেখতে ইচ্ছা করে।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জুলাই, ২০২০ রাত ১২:৫৫