আমাদের শাহেদ জামাল নামে আমি আর লিখব না।
কারন, রিজেন্ট হাসপাতালের সাহেদ। হারামজাদা সাহেদ আমার 'আমাদের শাহেদ জামাল' শিরোনামে লেখাটার সমস্ত ইচ্ছাটাই নষ্ট করে দিয়েছে। আজই এই পোষ্টের মধ্য দিয়ে আমাদের শাহেদ জামাল (দশ) লেখা সমাপ্তি করবো। আমার ইচ্ছা ছিলো শাহেদ জামালকে নিয়ে ১০০টা পর্ব লিখব। কিন্তু আর লিখা হবে না। বিদায় শাহেদ জামাল।
শাহেদ বসে আছে রমনা পার্কে।
সমস্ত ঢাকা শহরের মধ্যে রমনা পার্কটা শাহেদের কাছে আজও খুব ভালো লাগে। চারিদিকে অনেক গাছপালা। অনেক বাতাস। রমনা পার্কও গাছের পাতার মতো রঙ বদলায়। সকালে একরকম লাগে, দুপুরে অন্যরকম আবার বিকেলে আরেক রকম লাগে। অবশ্য পার্থক্যটুকু সবাই ধরতে পারে না। সবার দেখার চোখ একরকম না। শাহেদকে আজ অনেক খুশি দেখা যাচ্ছে। সে পার্কে বসে পা নাচাচ্ছে। যখন শাহেদ তার পা নাচায় তার মানে শাহদ আনন্দে আছে। সে আজ পাঞ্জাবী পড়েছে। হালকা আকাশি রঙের পাঞ্জাবী। শাহেদ সাধারণ পাঞ্জাবী পড়ে না। যদিও তার অনেক গুলো পাঞ্জাবী আছে। সবচেয়ে বড় কথা পাঞ্জাবী পড়লে শাহেদকে দেখতে বেশ লাগে। নীলা'র ধারনা শাহেদকে পাঞ্জাবীতে সবচেয়ে ভালো দেখায়।
বহু বছর আগে একবার শাহেদ মরিশাস গিয়েছিলো।
মরিশাসের রাজধানী 'পোর্ট লুইস'। যেতে খুব বেশি টাকা খরচ হয়নি শাহেদের। শাহেদর বন্ধু সুমন নিয়ে গিয়েছিলো। সুমন বলেছিলো- চলে আয়, খুব সুন্দর দেশ। টাকাও ভালো ইনকাম করা যাবে। শাহেদ সত্যি সত্যি চলে গেলো মরিশাস। যেতে সময় লেগেছিলো দশ ঘন্টা। দিল্লী হয়ে যেতে হয়েছিলো। পৃথিবীর বড় বড় জাহাজ গুলো মরিশাসই বানায়।
সুমন শাহেদকে বলল, এখানে কাজের অভাব নাই। শাহেদ বলল, কি কাজ? সুমন বলল, মারিয়ানা বীচে অসংখ্য বিদেশী ন্যাংটো শুয়ে থাকে। তুই তাদের গায়ে স্টিকার লাগিয়ে দিবি। বিনিময়ে তারা তোকে টাকা দিবে। বকশিস দিবে। আমি বললাম, স্টিকার কোথায় লাগাবো। সুমন বলল, যেখানে লাগাতে বলবে সেখানেই লাগাবি। হাতে, রানে, বুকে, কোমরে, পেটে। আমি বললাম, আমি মুসলমানের ছেলে হয়ে এই কাজ করবো? সুমন বলল, টাকা কামাতে হলে এই কাজই করতে হবে। শুধু এটা না মেয়েদের ম্যাসেজ করেও দিবি। অনেক টাকা পাবি। আরে ব্যাটা বিদেশে এসেসিছ টাকা কামাতে।
পরের দিন শাহেদ একটা বাশের মধ্যে সূতা দিয়ে নানান রঙের স্টিকার বেঁধে মারিয়ানা বীচে গিয়ে পর্যটকদের সামনে গিয়ে বলতো, স্টকার স্টিকার। অনেকেই শাহেদকে ডাক দিত। বিশেষ করে মেয়েরা। শরীরের কত জায়গায় যে মেয়েরা স্টিকার লাগাতো! অবশ্য বেশ ভালো টাকা ইনকাম হতো রোজ। শাহেদ একাজ করলো পনের দিন। তারপর দেশে ফিরে এলো। তবে মারিয়ানা বীচের সৌন্দর্য শাহেদকে আজও মুগ্ধ করে। আকাশ আর সমুদ্র মিশে একাকার। এক পাশে বিশাল সবুজ পাহাড়। সমুদ্রের পাড়ে কত নারকেল গাছ! পুরো সমুদ্র ভরা নরনারীর জটলা। নীলাকে নিয়ে একবার মারিয়ানা বীচে যাওয়ার তার ইচ্ছা আছে।
এরপর শাহেদ ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় সৌদি গিয়েছিলো।
সৌদি গিয়ে শাহেদ মাত্র দুই মাস একুশ দিন ছিলো। জায়গাটার নাম ছিলো 'হাফার আল বাতেন'। একদম বর্ডারের কাছের একটা এলাকা। চারিদিকে শুধু মরুভূমি। সামান্য বাতাসে মরুভূমির বালু এসে চেহারা বদলে দিত। পানির খুব সংকট ছিলো। সৌদিতে শাহেদকে নিয়ে গিয়েছিলো তার বন্ধু বাবু। বাবু চমৎকার একটা ছেলে। প্রচন্ড রসিক মানুষ। বাবুর নিজের গেরেজ আছে। সে গাড়ির ডেন্টিং পেন্টিং করে।
শাহেদ সৌদি গিয়ে জানতে পারে সে এসেছে কাঠ মিস্ত্রির হেলপার হিসেবে। প্রথম দিনই শাহেদকে বলা হলো- লম্বা কাঠের ফালি গুলো কাঁধে করে নিয়ে আসতে। শাহেদ অনেক চেষ্টা করেও একটা কাঠের ফালি কাঁধ পর্যন্ত তুলতে পারলো না। তখন হেড মিস্ত্রি বলল, সামান্য একটা লম্বা ফালি করে কাটা কাঠ কাঁধে নিতে পারছো না? এই দেখো কত পাকিস্থানী আর ফিলিপাইন'ই গুলো কিভাবে কাজ করছে। শাহেদ বলল এ কাজ আমাকে দিয়ে সম্ভব না। আমি আর এক মিনিটও এই কাজ করবো না। বিদায়।
শাহেদ চলে এলো তার বন্ধু বাবুর গেরেজে।
বাবু বলল, বন্ধু কষ্ট করেই জীবনে বড় হতে হয়। আমি এই দেশে প্রথম এসে যে পরিমান কষ্ট করেছি না দেখলে তুই বিশ্বাস করবি না। বেতন ছিলো মাত্র বারো শ' রিয়াল। দেশে কিছুই পাঠাতে পাড়তাম না। বহু কষ্ট গেছে। না খেয়েও ছিলাম। কষ্ট করেছি বলেই আজ আমি নিজেই একটা গেরেজ দিতে পেরেছি। বন্ধু আপাতত তুই আমার গেরেজে'ই কাজ কর। পরে কিছু একটা ব্যবস্থা করবো। আমি আছি, তোর কোনো চিন্তা নেই।
সৌদিতে প্রচন্ড গরম। শাহেদ গরম সহ্য করতে পারে না। এর মধ্যে নেই কোনো বিনোদনের কিছু। সারাদিন গেরেজে রাতে বাসায় ঘুম। রাস্তায় একটু হাটাও যায় না। রাস্তায় বের হলেই পুলিশ কর্কশ গলায় বলতো, এভাবে রাস্তায় হাঁটার নিয়ম নাই। তোরা মিসকিন। যাই হোক, একদিন বাবু রাজধানী রিয়াদে গেছে। শাহেদ একা গেরেজে বসে আছে। তখন এক মোটা করে মহিলা গেরেজে আসলো। শাহেদ জানে মহিলা তার গাড়ি নিতে এসেছে। বাবু আগেই বলে গেছে। মহিলার গাড়ি নতুন রঙ করা হয়েছে।
মহিলা গাড়ি নিয়ে চলে যাচ্ছিলো। শাহেদ বলল, টাকা দিয়ে যান। মহিলা বলল, তোমার সাহস তো কম না আমার কাছে টাকা চাও। শাহেদ বলল, টাকা না দিলে আপনি গাড়ি নিয়ে যেতে পারবেন না। মহিলা বলল, ঠিক আছে গাড়িতে উঠে বসো। আমি টাকা দিচ্ছি। শাহেদ গাড়িতে বসলো। মহিলা গাড়ি চালিয়ে শাহেদকে তার বাসায় নিয়ে এলো। বলল, তুমি বসো আমি টাকা নিয়ে আসছি। একটু পর মহিলা সম্পূর্ন উলঙ্গ হয়ে শাহেদের সামনে এলো। শাহেদ তো প্রচন্ড অবাক। মহিলা বলল, আসো। আনন্দ করো ইচ্ছা মতো। তবু আমি টাকা দিবো না। শাহেদ এক দৌড় দিয়ে গেরেজে চলে এলো। এবং তার সাত দিন পর নিজের দেশে ফিরে এলো।
নীলার কথা শাহেদকে আর ভাবতে হবে।
গতকাল নীলার বিয়ে হয়ে গেছে। নীলার কোনো দোষ নেই। নীলা আর কত অপেক্ষা করবে! শাহেদ সামান্য একটা চাকরী যোগাড় করতে পারেনি। তবু নীলা দীর্ঘদিন অপেক্ষা করে থেকেছে। তার পরিবারকে বুঝিয়েছে। শাহেদ মনে মনে প্রার্থনা করেছে নীলা যেখানেই থাকুক, সে যেন ভালো থাকে। সুস্থ থাকে আর আনন্দে থাকে। নীলার বিয়েতে শাহেদ যায় নি। শাহেদ কোনো কান্নাকাটিও করেনি। যদিও সে গতকাল রাত থেকেই না খেয়ে আছে। কিন্তু তার কোনো ক্ষুধাবোধ নেই। নীলাকে ভেবে ভেবে একটা জীবন পার করে ফেলতে পারবে। এটা তার কাছে কোনো ব্যাপারই না।
শাহেদ মারগিবের নামাজের কিছুক্ষন আগে রমনা পার্ক থেকে বের হলো। এখন সে শাহবাগ যাবে। আজিজ মার্কেট গিয়ে এক কাপ দুধ চা খাবে, একটা বেনসন সিগারেট খাবে। তারপর বাসায় ফিরবে। আজ রাতে সে নীলাকে নিয়ে একটা কবিতা লিখবে। আজকের কবিতাটা লেখা হলে- নীলাকে নিয়ে তার লেখা কবিতার সংখ্যা হবে এক'শো। কিন্তু শাহেদের আর বাসায় ফেরা হয়নি। নীলাকে নিয়ে এক'শ তম কবিতাটি লেখা হয়নি। এমন কি দুধ চা আর বেনসন সিগারেটেও খাওয়া হয়নি। শাহবাগ এসে রাস্তা পার হতে গিয়ে একটা বাসের নিচে চলে যায় শাহেদ। মুহুর্তের মধ্যেই সে মারা যায়। বাসের চাকায় তার মাথাটা থেতলে যায়। এভাবেই একটা নক্ষত্রের পতন হলো।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা আগস্ট, ২০২০ দুপুর ২:০০