যুগ যুগ ধরে নানা দেশের, নানা জাতির লোকেরা ভারতে এসেছে, ভারতকে শাসন করেছে, বসতি স্থাপন করে থেকেছে। বছরের পর বছর এদেশে থাকতে থাকতে তাদের রীতি-নীতি, আদব-কায়দা, শিল্প-সংস্কৃতি-ভাষা, খাওয়া-দাওয়ার ধরন বদলেছে স্বাভাবিকভাবেই। তবে এই বদল একতরফা নয়, পারস্পরিক। এই মানুষগুলির জীবনযাত্রার ধরন বদল এনেছে ভারতীয়দের মধ্যেও।
ইউরোপীয়দের মধ্যে সমুদ্রপথে পর্তুগিজরাই প্রথম বাঙলায়, তথা ভারতীয় উপমহাদেশে এসে পৌঁছায় ও বাংলাসহ উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বাণিজ্য কুঠি নির্মাণ করে। এই জলপথ আবিষ্কারের মাধ্যমেই কিন্তু শুরু হয়েছিলো ইউরোপ ও ভারতের মধ্যে বাণিজ্য। এই জলপথ ব্যবহার করেই ইউরোপীয় বণিকেরা আসা শুরু করে ভারতে। শুরু করে তাদের বসতি স্থাপন। একে একে আসে স্পেন, ফ্রান্স, হল্যান্ড এবং ইংল্যান্ডের বণিকেরা। এই জলপথ আবিষ্কার এর সঙ্গে সুচনা হয় এই অঞ্চলের নতুন ইতিহাসের।
পর্তুগাল দেশটির অবস্থা তখন একেবারেই ভালো ছিলো না।
আর্থ-সামাজিক দিক থেকে দেখলে পর্তুগালকে সেসময় ইউরোপের বেশ গরীব দেশ বলা যেতে পারে। বাংলা থেকে আসা সুতি ও সিল্ক মসলিনের কথা ভাস্কো দা গামার কানে পৌঁছেছিল কালিকটে থাকা কালেই। দুই দশকের চেষ্টার পর ১৫৩৭ সালে অবশেষে পর্তুগিজরা বাঙলার বুকে শক্ত মাটি পায়। এরপর ধীরে ধীরে সপ্তগ্রামের ব্যাবসা বাণিজ্য পুরোপুরিভাবে পর্তুগিজদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়, এবং আরো প্রায় চার দশক পর মুঘল সম্রাট আকবরের ফর্মানের বলে পর্তুগিজরা হুগলীতে স্থাপন করে এক নগরী। ভাস্কো দা গামা মোটেও ভালো লোক ছিলো না। বহু ভারতীয়কে হত্যা করেছে। সমুদ্র পথে কোনো জাহাজ পেলে ডাকাতি করেছে, এবং জাহাজে থাকা সমস্ত লোকদের খুন করেছে। হিন্দু আর মুসলমানের উপর ছিলো তার অনেক রাগ।
ভাস্কো দা গামা একজন পর্তুগীজ অনুসন্ধানকারী এবং পর্যটক।
তিনি আজও পর্তুগালে এতটাই জনপ্রিয় যে পর্তুগালের জাতীয় কবিতা লুসিয়াদসের নায়ক। তার জন্মটা হয়েছিল ১৪৬৯ খ্রিস্টাব্দে পর্তুগালের দক্ষিণ-পশ্চিমে, সাগরের পাড়ের কাছেই সিনেস শহরে। তিনিই ইউরোপীয় প্রথম ব্যক্তি যিনি সাগর পাড়ি দিয়ে ভারতে আসেন। ভাস্কো দা গামা ইভরা শহরে লেখাপড়া করতেন। ১৪৯২ সালে রাজা ভাস্কো দা গামাকে পাঠালেন এক মিশনে, ফ্রেঞ্চ জাহাজ দখল করতে হবে। কাজটা এত নৈপুণ্যের সাথে করলেন তিনি, যে দা গামার সুনাম ছড়িয়ে পড়ল। ভাস্কো দা গামা ও তার সঙ্গীরা ছিলেন খ্রিষ্টান ধর্মানুসারী।
পর্তুগিজদের ভারতে আসার মূল উদ্দেশ্য ছিল দুটি – এক, বাণিজ্যের মাধ্যমে বিপুল অর্থোপার্জন ও ঐশ্বর্য ও প্রাচুর্য মণ্ডিত জীবনযাপন এবং দুই, খ্রিস্টান ধর্ম প্রচার। পর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো-দা-গামা ভারতের মাটিতে পা রেখেছিলেন ১৪৯৮ সালে। এর মাত্র ৪০ বছরের মধ্যেই পর্তুগিজরা জাঁকিয়ে বসেছিল ভারতের গোটা পশ্চিম উপকূল জুড়ে। ভাস্কো দা গামারা ছিলেন পাঁচ ভাই বোন। বাস্কো দা গামা ৩য়। তার একমাত্র বোনের নাম তেরেসা।
কালিকটের রাজা ছিল সামুদিরি।
ভাস্কো দা গামা যেদিন কালিকট বন্দরে এসে নামেন, সেদিন ছিল ১৪৯৮ সালের ২০ মে, ৫১৯ বছর আগের কথা। আগত বিদেশীদের ৩,০০০ নায়েরের উপস্থিতিতে রাজকীয় সম্মাননা দেয়া হয়। গামা রাজাকে উপহার দিলেন, উজ্জ্বল লাল কাপড়ের চারটি জোব্বা, ছয়টি টুপি, চার ধরণের প্রবাল, বারটি আলমাসার, সাতটি পিতলের পাত্রসহ একটি বাক্স, এক সিন্দুক চিনি, দুই ব্যারেল (পিপা) তেল এবং এক পিপা মধু। কিন্তু এগুলো খুব তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে নিলেন রাজা, মোটেও আকৃষ্ট হননি। সোনা রূপা নেই- এ কেমন কথা! ভাস্কো দা গামা ভারতে ব্যবসায় করার জন্য অনুমতি চাইলেন। কিন্তু রাজা প্রত্যাখ্যান করলেন। বললেন, এখানে ব্যবসা করতে হলে অন্যদের মতো সোনা দিয়ে খাজনা দিতে হবে। (উল্লেখ্য, কালিকট ছিল সে সময়ে আরব সাগরের তীরবর্তী দক্ষিণ ভারতের বিখ্যাত বন্দর।)
তৃতীয় বার ভারতে এসে মারা যান ভাস্কো-দা-গামা।
সালটা ছিল ১৫২৪। তাঁর মৃত্যুর পর সেন্ট ফ্রান্সিস গির্জাতেই তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। ১৪ বছর পরে তাঁর দেহ লিসবনে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু এখনও এই গির্জায় রয়েছে তাঁর সমাধিফলক। ১৫০২ খ্রিস্টাব্দে তিনি ভারতে আসার জন্য দ্বিতীয় বার যাত্রা করার সময়ে দা গামা হজগামী ও হজ থেকে ফিরছে এমন দুটি জাহাজকে আক্রমণ করেছিলেন, যার সকল যাত্রীই ছিলেন ধর্মপ্রাণ মুসলিম। তিনি সেই সমস্ত যাত্রীদের হত্যা করেছিলেন। এর পরেও তাঁর বিভিন্ন বর্বরতার যে উদাহরণ পাওয়া যায়, তাতে একটা কথা স্পষ্ট, তিনি সুস্থ মনের অধিকারী ছিলেন না। সর্বদাই তাঁর এই ধরনের নৃশংস কাজের মুসলিমরা নিন্দা করেছে।
# ২০১৬ সালের মার্চে ওমানের কাছে সাগরের তল থেকে ভাস্কোর ডুবে যাওয়া এক জাহাজ উদ্ধার করা হয়েছিল, নাম ছিল এসমেরালদা।
# ১৪৯৯ সালে পর্তুগালের রাজা ম্যানুয়েল সিনেস শহরটি ভাস্কো দা গামাকে পুরস্কার হিসেবে প্রদান করেন।
# ভারতে তার প্ৰথম ভ্ৰমণ কে বিশ্ব ইতিহাসে মাইলফলক বলে বিবেচনা করা হয়।
# ১৫৮০ সালে মুঘল সম্রাট আকবরের ফরমানের দৌলতে পর্তুগিজরা বাঙলায় একটি নগরী পত্তন করার অধিকার পায়।
# ১৫৩৭ সাল নাগাদ পর্তুগিজরা বাঙলার চট্টগ্রাম এবং সপ্তগ্রামে পাকাপাকিভাবে ব্যবসা করতে শুরু করে।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই আগস্ট, ২০২০ রাত ৮:২১