অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটে গেছে!
শাহেদ জামাল চাকরি পেয়ে গেছে। তার ধারনা তার মতো এত এত সিভি আর কেউ জমা দেয় নি। বিডি জবস এ তার চোখ সব সময় ছিলো। মাসের পর মাস সিভি জমা দিয়ে গেছে সে, অথচ কেউ তাকে ডাকেনি। কিন্তু শাহেদ জামাল মনে মনে প্রতিদিন অপেক্ষায় ছিলো- আজ বুঝি ডাকবে। কেউ একজন ফোন করে মিষ্টি গলায় ইন্টারভিউ'র জন্য ডাকবে। ফোনে রিং বাজলেই শাহেদ এর বুক কেঁপে উঠতো। মনে হতো ইন্টারভিউর জন্য কল এসেছে। সেই মহান কল এসেছে। কল আসার পরই শাহেদ জামালের মনে হয়েছে এই চাকরিটা তার হবে। অবশ্যই হবে। ইন্টারভিউ কল পাওয়ার পরেই শাহেদ নীলাকে ফোন দিয়ে বলেছে, তুমি দেখো নিও এই চাকরিটা আমার হয়ে যাবে। নীলা খুব খুশি। সে বলল, তুমি দেখো নিও আমাদের জীবনটা খুব আনন্দময় হবে।
ইন্টারভিউ বোর্ডে সাধারনত চার পাঁচ জন থাকেন।
শাহেদ জামাল যেদিন ইন্টারভিউ দিতে গেলো, দেখা গেল মাত্র একজন বসে আছেন। তাও তিনি বেশ হাসি খুশি মানুষ। দেখতে মাই ডিয়ার টাইপ। বয়স পঁয়তাল্লিশ হবে বড়জোর। কোট টাই পরা। মাথার চুল সুন্দর করে আচড়ানো। বেশ সুন্দর চেহারা। তার টেবিলের উপর কোনো ফাইলটাইল নেই। শুধু দু'টা গল্পের বই পড়ে আছে। দু'টা গল্পের বই থেকে একটা তিনি পড়ছেন। ইন্টারভিউ নেওয়াতে তার মন নেই। তার সমস্ত মন পড়ে আছে বইটাতে। বইয়ের নাম 'দিবারাত্রির কাব্য'। এই বই শাহেদ জামাল পড়েছে। খুব ভালো বই। এই বই রবীন্দ্রনাথের গানের মতোন, কখনও পুরোনো হবে না।
ভদ্রলোকের নাম শামসুর আরেফিন।
তিনি 'ওবি' কোম্পানীর সিইও। সিইও সাহেবের ঘর খুব সুন্দর। দেয়ালে দারুন তিনটা পেইন্টিং আছে। একটা ছবি এত সুন্দর যে বারবার সেদিকে চোখ চলে যাচ্ছে। একটা মেয়ে সাইকেলে হেলান দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। তার সামনে একটা পুকুর। পুকুরের পানিতে তার ছায়া পড়েছে। পেইন্টিং ছাড়া আছে আলমিরা ভর্তি বই আর বই।
সিইও শামসুর আরেফিন বললেন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে পড়েছেন। রেজাল্টও অনেক ভালো। যাই হোক, মানিক বন্ধ্যোপাধ্যায় এর 'দিবা রাত্রির কাব্য' পড়েছেন?
শাহেদ জামাল বলল, পড়েছি।
শামসুর আরেফিন সাহেব দারুন আত্মবিশ্বাসের সাথে বললেন, আপনি যদি মানিক বন্ধ্যোপাধ্যায়ের আসল নাম বলতে পারেন- আমি আপনাকে চাকরি দিয়ে দেব।
শাহেদ বলল, চাকরির সাথে মানিক বন্ধ্যোপাধ্যায়ের সম্পর্ক কি?
কোনো সম্পর্ক নেই। এই মুহুর্তে আমি তার একটি বই পড়ছি বলে এরকম সিদ্ধান্ত নিলাম।
শাহেদ জামাল বলল, উনার আসল নাম প্রবোধ কুমার বন্ধ্যোপাধ্যায়।
সিইও হেসে বললেন, অভিনন্দন।
সাহেদ জামালের চাকরি হয়ে গেল। এবং কুড়ি মিনিট পর তাকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার দিয়ে দেওয়া হলো। সামনের মাসের এক তারিখে জয়েন করতে বলা হলো।
এক তারিখ জয়েন। হাতে আট দিন সময় পাওয়া গেল।
শাহেদ জামাল অনেক খুশি। সে বাসায় গেলো। বাসায় ফেরার আগে কি মনে করে এক কেজি লাড্ডু কিনে নিলো। তার বাবা লাড্ডু খেতে ভালোবাসেন। চিৎকার করে বাসার সবাইকে তার চাকরি পাওয়ার সংবাদ দিলো। তার বাবা মা তাকে খুশিতে জড়িয়ে ধরলেন। আবেগে তার মা কেঁদে ফেললেন। এই করোনা কালে, একটা চাকরি পেয়ে পাওয়া বিরাট ভাগ্যের ব্যাপার। যেখানে মানুষের চাকরি চলে যাচ্ছে! বেতনও বেশ ভালো। বছরে তিনটা বোনাস। সবচেয়ে বড় কথা অফিস থেকে গাড়ি এসে সকালে নিয়ে যাবে, আবার বিকেলে বাড়ি দিয়ে যাবে। অবিশ্বাস্য! অনেকদিন পর শাহেদ জামাল পরিবারের সবার সাথে বসে দুপুরে খাবার খেলো। তার বারবার মনে হচ্ছে জীবনটা আসলেই আনন্দময়। মনে মনে সে মানিক বন্ধ্যোপাধ্যায়কে ধন্যবাদ দিলো।
বিকেলে সে নীলার সাথে দেখা করতে গেলো।
এবং কোনো ভনিতা না করে বলল, ঠিক তিনমাস পর তোমাকে বিয়ে করবো। তোমার বাবা মাকে বলে দিও। নীলা বলল, বলে দিব। তারা সন্ধ্যা পর্যন্ত একসাথে থাকলো। ফুচকা খেলো। বাদাম খেলো। বিনা কারনে রিকশা নিয়ে ধানমন্ডি থেকে নিউ মার্কেট গেলো। নীলাকে বাসায় পৌঁছে দিলো। নীলা চলে যাওয়ার সময় শাহেদ বলল, নীলা আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। কোনোদিন আমি তোমাকে দুঃখ দিব না। কথা দিলাম। আমি কথা দিলে কথা রাখি। নীলার চোখ ভিজে উঠলো। নীলার ইচ্ছা করলো শাহেদকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে।
শাহেদ বাসায় ফিরলো। রাতের খাবার তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে 'দিবারাত্রির কাব্য' নিয়ে বসলো। আজ সে বইটা আবার পড়বে। বড় অদ্ভুত একটি উপন্যাস। উপন্যাসটা পড়তে পড়তে ঘোর লেগে যায়। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র হেরম্ভ। উপন্যাসে হেরম্ভের জীবনে তিনটি মেয়ে আসে। উমা, সুপ্রিয়া এবং আনন্দ। হেরম্ভের জীবনে সব কিছু উলটপালট করে দেয় 'আনন্দ' নামের মেয়েটি। শাহেদ দিবারাত্রির কাব্য পড়ে শেষ করলো। তার ইচ্ছা করলো- মানিক বন্ধ্যোপাধায়কে বুকে জড়িয়ে ধরতে।
আজ এক তারিখ। শাহেদ জামাল অফিসে জয়েন করবে।
আজ তার প্রথম অফিস। শাহেদ জামাল ঠিক করেছে সে খুব মন দিয়ে অফিস করবে। তার সমস্ত প্রতিভা ঢেলে দিবে কোম্পানীর স্বার্থে। কোনোদিন অফিস ফাঁকি দিবে না। প্রচুর পরিশ্রম করবে। তার দায়িত্ব সে হান্ডেট পার্সেন্ট পালন করবে। বাসা থেকে বের হওয়ার সময় শাহেদ জামালের বাবা তাকে পাঁচ শ' টাকা দিলেন। শাহেদ জামাল মনে মনে বলল, বাবা তোমার কাছ থেকে আর টাকা নিবো না। এর পর থেকে আমি তোমাকে নিয়মিত টাকা দিব। সংসারের সমস্ত খরচ আমি করবো। এই বয়সে তোমাকে আর পরিশ্রম করতে দিবো না। তুমি শুধু বাসায় বসে পত্রিকা পড়বে আর টিভি দেখবে। শাহেদ জামাল তার বাবা মাকে সালাম করে বাসা থেকে বের হলো। শাহেদ জামালের মা ছেলের কপালে চুমু খেলেন। ভাবী হেসে বললেন, বেস্ট অব লাক দেবরজ্বী। শাহেদ জামাল মনে মনে ভেবে রাখলো- প্রথম মাসের সেলারি দিয়ে সবার আগে ভাবীর জন্য সে অবশ্যই একটা দামী শাড়ি কিনবে।
শাহেদ জামাল অফিস শুরু হওয়ার দশ মিনিট আগে এসে উপস্থিত হলো।
সিইও সাহেব শাহেদ জামালকে ডেকে পাঠালেন। এবং বললেন, আমাদের কিছু সমস্যা হয়েছে। আপনাকে নিতে পারছি না। অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারে লেখা আছে কোনো কারন দর্শানো ছাড়া আমরা অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার বাতিল করতে পারি। তবে আপনার সিভি আমাদের কাছে আছে। পরে সুযোগ থাকলে আপনাকে নেওয়া হবে। আপনাকে অসুবিধায় ফেলেছি। স্যরি ফর দ্যাট।
সিইও সাহেবের কথা শুনে যেন শাহেদ জামালের মাথায় পুরো আকাশটা ভেঙ্গে পড়লো। তার চোখে পানি চলে আসলো। অফিসের পিয়ন শাহেদ জামালকে বলল, স্যার চা খাবেন? শাহেদ বলল, দাও। পিয়ন বলল, স্যার আপনার এই রুমেই বসার কথা ছিলো। দেখুন রুমটা কত সুন্দর। শাহেদ জামাল দেখলো। রুমটা আসলেই সুন্দর। সেন্টাল এসি। সুন্দর টেবিল। টেবিলে কম্পিউটার। শাহেদ অবশ্য রুমটা নিজের মনের মতোন করে সাজিয়ে নিতো।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ বিকাল ৩:০৬