মানুষ যা বুঝতে পারে না, যার কারন ব্যখ্যা করতে পারে না, যা কিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, ও যাকে ভয় পায় তাকেই ঈশ্বর বলে মানে। তবে তার জন্য সে নিজে দায়ী নয়। তার পিতামাতা, জন্মগত পরিবেশ, পরিবার ও পারিপার্শ্বিক সমাজ ছোটবেলা থেকে তাকে এমন কাল্পনিক একজনের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। চারপাশের সবার দেখাদেখি, সে ভীষণ শক্তিশালী এমন কাউকে কল্পনা করে নেয়। যিনি ভালো করলে পুরষ্কার দেন ও খারাপ করলে শাস্তি দেন- মৃত্যুর পর। আল্লাহ বলেছেন, "তবে কী তারা স্রষ্টা ছাড়াই সৃষ্টি হয়েছে, নাকি তারা নিজেরাই নিজেদের স্রষ্টা" [আত তূরঃ৩৫] কীভাবে নাস্তিকেরা, স্রষ্টাকে অস্বীকার করে! আমাদের কিডনি, হার্ট, ব্লাড সার্কুলেশন, চোখের কী সুন্দর গঠন, কি সুন্দর নিঃশ্বাস নিচ্ছি- এগুলো নিয়ে নিজেই একবার চিন্তা করুন! হাইজেনবার্গ সাহেব বলেছিলেন, “The first gulp from the glass of natural sciences will turn you into an atheist, but at the bottom of the glass God is waiting for you.”
বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে, অদূর ভবিষ্যতে পুরো বিশ্ব নাস্তিক হয়ে যাবে এমনটা ভাবা ঠিক না। তবে অতীত থেকে বর্তমান পর্যন্ত বিচার বিশ্লেষন করলে বলা যায়- মানুষের মনে ধীরে ধীরে ঈশ্বরের প্রতি ভয় ও ভক্তি দিন দিন কমছে। ধর্ম এখন হয়ে উঠেছে, মুষ্টিমেয় কিছু ধর্মগুরুর (ধর্মব্যবসায়ীও বলতে পারেন) অর্থ ও ক্ষমতার লালসা চরিতার্থ করার আর রাজনীতিবিদদের হাতিয়ার। মানুষ আজকাল তেতো সত্যির থেকে মিষ্টি মিথ্যে শুনতেই বেশি পছন্দ করছে। নাস্তিকেরা ভাবেন 'এক সুন্দর সকালে এই বিশ্বের সবাই নাস্তিক হয়ে যাবে- তাতে এই বিশ্বের লাভ বই ক্ষতি কিছু হবে বলে তো মনে হয় না। ধর্ম ছাড়াও এই বিশ্বসংসার বেশ ভালো ভাবেই চলবে'। মহাবিশ্বের কারিগরস্বরূপ ঈশ্বরকে নিয়ে নাস্তিকদের মনে যে সন্দেহের অবকাশটুকু রয়েছে সেটা মূলত এই কারণেই এবং এই সন্দেহ দূর করা কোনো ধর্মগ্রন্থের কর্ম নয় বলেই নাস্তিকেরা মনে করেন। গাড়ির উদ্ভাবক কার্ল বেঞ্জ। তাহলে মানুষের উদ্ভাবক কে? নৃবিজ্ঞানের বই খুলে যদি পড়তে শুরু করেন নিশ্চিত ভাবে আপনিও ভেবে অবাক হবেন যে, এই আজকের দিনের আধুনিক মানুষ মাত্র কয়েক লক্ষ বছর আগেই এসেছে। তারপর এসেছে ধর্ম। আগে ঘরের দরকার না আগে মানুষের দরকার?
নাস্তিকদের মূল দর্শন, যুক্তি-প্রমান-তথ্য দ্বারা যা প্রতিষ্ঠিত তাই বিশ্বাসযোগ্য। আমি মনে করি, 'একজন আসল আস্তিক হওয়ার জন্য অবশ্যই একজন ভালো নাস্তিক হওয়া প্রয়োজন'। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ বিবেকানন্দ হতেই পারেন। আস্তিকতা বা নাস্তিকতা দুটি সুন্দর দর্শন। দর্শন থাকে মননে। তবে, কর্মে সঠিক থাকলে জীবন ঠিকই তার প্রবাহে চলবে। মানব শিশুকে জঙ্গলে ছেড়ে দিলে, বা সভ্যতা থেকে আলাদা করে রাখলে তারা কোন ধর্মই শেখে না। প্রকৃতীর নিয়ম গুলো শেখে। তারা হয় মুক্তমনা। অর্থ্যাত 'যার মন বন্ধী করে রাখা যায় না। মুক্তমনা মানে তো মনের দরজা খুলে রাখা। মন যখন সত্যের সন্ধান করে তখন সে মুক্ত'। ধার্মিকেরা মনের জানালা খুলতে ভয় পায়। ধর্মীয় গ্রন্থ গুলোও তাদের মনের ঝানালা খুলে দিতে পারে না। 'ধর্মগ্রন্থগুলো মনের জিজ্ঞাসা না মিটিয়ে, চোখ বুজে মেনে নেওয়ার নির্দেশ দেয় তখন কারো কারো মন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে, ধর্মবিমুখ হয়ে ওঠে'। ধর্মবিমুখ লোকজনদের সমাজ নাস্তিক বলে। জীবনে সব থেকে বড় অনুচিত কাজ হল- মনের দরজা বন্ধ রাখা। আমি যা জানি- সেটাই সত্য, বাকি সব মিথ্যা এত টাইপ অজ্ঞানতার জন্ম দেয় ধার্মিকদের।
নাস্তিকেরা যখন বেশি যুক্তি দিয়ে চিন্তা করে, ঈশ্বর, ভগবান বা আল্লাহর অস্তিত্ব মানুষের কল্পনাপ্রসূত। কল্পনার রাজ্য থেকে বের হয়ে এলেই নাস্তিকেরা মনে করেন, ঈশ্বর নামের ধারণাটি আধুনিক সমাজে সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয়। ধর্মের আফিমে বুঁদ না হয়ে তাই এখন বেশি সংখ্যক মানুষ নাস্তিক হচ্ছে। আস্তিক বা নাস্তিক হওয়াটা যথেষ্ট নয়, 'জরুরি হচ্ছে জগতের মোহ-মায়া-লোভ-লালসা-হিংসা-বিদ্বেষ ত্যাগ করা, সকল জীবের উপকার করা, নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করা'। আস্তিক হয়েও কেউ বড় বড় অপরাধ করতে পারে, আবার কেউ নাস্তিক হয়ে কোন কিছু পাবার আশা না করে সবার উপকারও করতে পারে। ধর্মকর্ম পালন করা বা পালন করার ভান করা উভয়েই লাভজনক। ব্যবসা বাণিজ্য সব কিছুতে ধর্ম পালন করার বিশেষ সুবিধা আছে, এতে সিন্ডিকেট ব্যবসা ভালো জমে। খাতুনগঞ্জের প্রতিটি সিন্ডিকেট ব্যবসায়ী ধর্মীয় লেবাসে চ্যাম্পিয়ন। তাদের চিন্তায় সারাক্ষন কিভাবে দ্বিগুন লাভ করা যায়, প্রাকৃতিক দুর্যোগে মাল সরিয়ে কৃত্রিম মূল্য বাড়ানো যায়, তারা সেই চিন্তায় মশগুল থাকে। নাস্তিকদের কোন ধর্মীয় লেবাস নেই। দাড়ি ও টুপিওয়ালা যে লোকটি ঘুষ ও সুদ খাচ্ছে, খাদ্যে ভেজাল দিচ্ছে, পণ্য মজুদ করছে আবার মসজিদে নামাজেও যাচ্ছে, তার সাথে নাস্তিকের কি বা পার্থক্য? কিন্তু সমাজে তার অনেক কদর যেটা নাস্তিকের নেই বললেই চলে।
'আমাদের এলাকায় একটা রেস্টুরেন্ট আছে। রেস্টুরেন্টের মালিকের সাথে আমার বেশ খাতির। বয়স তার আমার মতোই হবে। তবে তার মুখ ভরতি দাড়ি। অল্প বয়সী একজনের মুখ ভরতি দাড়ি দেখতে ভালো লাগে না। অনেক আগে একজন সচিব আমাকে বলেছিলেন, বয়সের আগেই যারা দাড়ি রাখে তাদের বিষয়ে সাবধান। এরা মন্দ লোক। যাই হোক, একদিন আমি রেস্টুরেন্টের মালিককে প্রশ্ন করলাম- আপনি তো আধুনিক মানুষ। গান শুনেন, নাচেন, প্রেম করেন আবার আপনার বয়সও বেশী না- তবে মুখ ভরতি দাড়ি কেন? তিনি বললেন, দাড়ি রেখেছি ব্যসায়িক সুবিধার জন্য। আপনি তো ব্যবসা করেন না, তাই বিষয়টা বুঝতে পারবেন না। ব্যসার সাথে দাড়ির কি সম্পর্ক সেটা আমার বোধগম্য হলো না'।
একজন মানুষ যেদিন বুঝে যায় বহুদিন ধরে আঁকড়ে রাখা বিশ্বাস বা সংস্কার গুলোর কোন ভিত্তি নেই, সেই উপলব্ধিটাই অবিশ্বাস। অবিশ্বাস শিখিয়ে দেওয়া যায় না, ক্রিটিকাল চিন্তা করে নিজে নিজে এটা অর্জন করতে হয়। নাস্তিকেরা এটাই করে থাকেন। এভাবেই নাস্তিক হয়। মন্দিরের যে 'পুরোহিত', যিনি ঈশ্বরের সেবায় রত থাকেন, তাকেই গ্রেফতার করে পুলিশ ধর্ষণের দায়ে। গির্জার ফাদারকে ধর্ষনের অভিযযোগে পুলিশ গ্রফতার করে। মসজিদের যে মোয়াজ্জিম, খাদেম বা মাদ্রাসার শিক্ষক তাকেই পুলিশ গ্রেফতার করে ধর্ষনের অপরাধে। সে যাই হোক, মজার বিষয় হচ্ছে তথাকথিত আস্তিক অথবা নাস্তিক কারোর সাথেই এখন আমার মতের মিল হয় না। পৃথিবীর বড় বড় নাস্তিকরা কিন্তু বেশ পন্ডিত ব্যক্তি, মানুষ হিসেবে তাঁরা সত্যই মানবিকতার পরিচয় দিয়েছেন। আমি ব্যক্তিগত ভাবে সেই সব নাস্তিদের অন্তর থেকে শ্রদ্ধা করি।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে অক্টোবর, ২০২০ বিকাল ৫:১২