এটা আমার গ্রামের গল্প।
আমাদের গ্রামে একটা পরিবার ছিলো। ছিলো বলা ঠিক হবে না। এখনও আছে পরিবারটি। এই পরিবারের কর্তার মোট ১৩ জন ছেলে মেয়ে। চার নম্বর ছেলের নাম মহাব্বত খা। আমার আজকের গল্প মহাব্বত খা'কে নিয়েই। মহাব্বত খা'র পিতা অভাবী মানুষ। পিতা এত গুলো ছেলে মেয়ের সঠিকভাবে দেখভাল করতে পারে না। একবেলা ভাত তো অন্যবেলা মুড়ি খেতে হয়। কিন্তু জমিজমা তাদের ভালোই আছে। সেসব জমি আবাদ হয় না।
মহাব্বত খা একটা ছাগল চুরী করলো।
অভাবের কারনে মহাব্বত খা তার বন্ধুর সাথে পাশের গ্রামের এক বাড়ি থেকে বড় একটা ছাগল চুরী করলো। সেই ছাগল আলামিন বাজারে বিক্রি করে দিলো। তখন সপ্তাহে একদিন আলামিন বাজারে হাঁট বসতো। হাঁটে ছাগলের দাম উঠলো পাঁচ শ' টাকা। সেই সময় পাঁচ শ' টাকার অনেক দাম। এদিকে গ্রামের সবাই যেন ফেলল ছাগল চুরীর কথা। এমন কি সাক্ষীও আছে। গ্রামের মুরুব্বীরা মিলে দরবার বসালো। মহাব্বত খা দরবারে নিজেকে নির্দোষ প্রমান করতে পারলো না।
রাতে মহাব্বত খা না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।
রাতে পিতাজ্বী মহাব্বত খাকে ডেকে তুললো। পিতার হাতে মোটা লাঠি। পিতা বললেন, তুই চুরী করলি কেন? বংশের নাম ডুবালি। তোর কেন টাকার দরকার হলো? যদি সত্যিই তোর টাকার দরকার হয় তাহলে আমাকে বলতে পারতি। জমি বিক্রি করে তোকে টাকা দিতাম। আমার নগদ টাকা নাই কথা সত্য। কিন্তু অনেক জমিজমা আছে। পিতা রাগে ফুঁসছে। আজ তোকে মেরেই ফেলব। মহাব্বত আলী এক দৌড়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো। পালিয়ে গেলো। আর ফিরে এলো না।
মহাব্বত আলী নিখোজ দুই বছর হয়ে গেছে।
তার পিতা অনেক খোঁজ খবর নিয়েছে। কোথাও তাকে পাওয়া যায় নি। মহাব্বত খা লঞ্চে চাকরী নিয়েছে। বাবুর্চির হেল্পার হিসেবে। দুই বছরের মাথায় মহাব্বত খা একজন পাকা বাবুর্চি হয়ে গেছে। তার ইনকাম বেশ ভালো। অনেক টাকা জমিয়ে ফেলেছে। একলোকের মাধ্যমে মহাব্বত খা তার গ্রামের বাড়িতে টাকা পাঠায়। টাকা পেয়ে তার ভাইবোন আর বাবা মা অনেক খুশি হয়। একদিন লঞ্চে মহাব্বত খার বড় দুই ভাই দেখা করতে আসে। দুই ভাইকে খুব খাতির যত্ন করে। বাড়ির জন্য অনেক কিছু কেনাকাটা করে দেয়। হাতে কিছু টাকাও দিয়ে দেয়। মহাব্বত খার উপর পরিবারের লোকজনের কোনো রাগ নেই।
বিশ বছর পার হয়ে যায়।
ততদিনে মহাব্বত খার ছয় বোনের মধ্যে চার বোনের বিয়ে হয়ে যায়। বিয়েতে আসতে না পারলেও মহাব্বত খা টাকা পাঠিয়েছে নিয়মিত। এখন মহাব্বত খা লঞ্চের বাবুর্চি নয়। লঞ্চে চোরাই মালামাল আনা নেওয়া করে। তাতে অনেক লাভ। চোরাই মালের টাকা স্থানীয় থানায়ও কিছু দিতে হয়। এখন মহাব্বত খা লাখ লাখ টাকার মালিক। তার পরিবারের অভাব কিছুটা মিটেছে। মহাব্বত খা গ্রামে যায় মাঝে মাঝে। পিতার হাত ভর্তি করে টাকা দিয়ে আসে। মহাব্বত খা নিজে লঞ্চ চালাতে পারে, লঞ্চের ইঞ্জিন সমস্যা হলে ঠিক করতে পারে। সব সময় নদীপথে যাতায়াত করা লোকজন মহাব্বত খাকে চিনে। এবং পছন্দ করে।
তেত্রিশ বছর পরের কথা।
মহাব্বত খা আজ এমভি মাছরাঙ্গা ও এমভি সূর্যমূখী দুটা জাহাজের মালিক। তার বাবা মারা গেছে। কিছুদিন আগে তার মা মারা গেলো। ১৩ ভাই বোনের মধ্যে তিন জন মারা গেলো। মহাব্বত খা বিয়ে করেছে। তার একছেলে এক মেয়ে। মেয়ে নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে। মেয়ে লেখাপড়ায় অনেক ভালো। মহাব্বত খা আজও গ্রামে গিয়ে শান্তি পায় না। পুরোনো আমলের লোকজন জানে মহাব্বত খা চোর। চুরী করে গ্রাম থেকে পালিয়েছে। পারতপক্ষে মহাব্বত খা গ্রামে যায় না। আমৃত্যু মহাব্বত খাকে চোর খেতাবি নিয়ে মরতে হবে। তার শান্তি নেই। সে চোর। ছাগল চুরী করেছে।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই অক্টোবর, ২০২১ বিকাল ৩:২৮