
প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্বের লিঙ্ক
তৃতীয় পর্বের লিঙ্ক
চতুর্থ পর্ব
মাইকেল মধুসূদন লন্ডন গিয়েও শান্তি পেলেন না।
তিনি লন্ডন গিয়েছেন ব্যারিস্টারি পড়তে। যাওয়ার আগে তার বিষয় সম্পত্তি দেখাশোনার দায়িত্ব যার কাছে দিয়ে গিয়েছিলেন, সেই লোক সব সম্পত্তি নিজের নামে করে নিয়েছেন। অথচ কথা ছিলো- প্রতিমাসে সে মাইকেল কে লন্ডনে চার শ' টাকা পাঠাবেন এবং কলকাতায় থাকা তার স্ত্রীকে প্রতিমাসে দেড় শ'' করে টাকা দিবেন। মাইকেল লন্ডনে উন্নত জীবনযাপন করতে গিয়ে বিরাট বিপদে পড়ে গেলেন। আজন্ম বিলাসিতা করা মানুষ তিনি। লন্ডনে গিয়ে অবস্থা এমন হয়েছে যে তার লেখাপড়াই প্রায় বন্ধ। উপায় না দেখে মাইকেলে বন্ধুদের কাছে চিঠি লিখে সাহায্য চাইলেন। কোনো বন্ধু সেই চিঠির জবাব দিলো না। এদিকে কলকাতায় থাকা মাইকেলের স্ত্রী বারবার চিঠি দিচ্ছে সংসারে অভাব। বাচ্চারা না খেয়ে আছে। মাইকেল হয়ে গেলেন পাগলের মতো।
শেষমেশ কোনো উপায় না দেখে মাইকেল-
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে একটা চিঠি দিয়ে জানালো তার টাকার প্রয়োজন। নইলে তার ব্যারিস্টারি পাশ করা হবে না। বিদ্যাসাগর চিঠি হাতে পেয়েই সাথে সাথে ধারধেনা করে মাইকেল কে টাকা পাঠিয়ে দিলেন। বললেন, অবশ্যই ব্যারিস্টারি পাশ করতে হবে। টাকা নিয়ে চিন্তা করার দরকার নেই। বিদ্যাসাগর বেঁচে আছেন। মাইকেল ব্যারিস্টারি পড়ায় মন দিলেন। ঠিক এমন সময় কলকাতা থেকে তার স্ত্রী কোনো রকমে জাহাজের ভাড়া ব্যবস্থা করে দুই সন্তান নিয়ে লন্ডন এসে হাজির হলেন। বাসা ভাড়া, চারজন মানুষের খাওয়া, ব্যারিস্টারি পড়ার খরচ। চিন্তায় চিন্তায় মাইকেল প্রায় কাঁত। আবার মদ খাওয়ার পরিমান বাড়িয়ে দিলেন। যদিও বিদ্যাসাগর তাকে অনুরোধ করেছিলেন মদ খাওয়া বন্ধ করো। দামী জিনিসপত্র যা ছিলো সবই বিক্রি করা হয়ে গেছে। এখন আর বিক্রি করার মতোন কিছু অবশিষ্ঠ নেই। অন্যদিকে বিদ্যাসাগর মাইকেল কে নিয়মিত টাকা পাঠিয়েছেন। ব্যারিস্টারি পাশ করতেই হবে।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নামে এক ছোকরা-
'দুর্গেশনন্দিনী' নামে একটা বই লিখে ফেললেন। শিক্ষিত মহলে সেই বই নিয়ে বেশ আলোচনা সমালোচনার ঝড় চলতে থাকলো। একদল বলল, এটাই বাংলা সাহিত্যের সার্থক উপন্যাস। এরকম আর কেউ লিখতে পারেননি। 'দুর্গেশনন্দিনী'তে আছে ভালোবাসা, আছে রাজনীতি, কূটনীতি। আর আছে একটুখানি কমেডি। হাজার হাজার কপি বিক্রি হয়ে গেলো- 'দুর্গেশনন্দিনী'। এরপর বঙ্কিমচন্দ্র লিখলেন 'কপালকুন্ডলা' নামে এক উপন্যাস। লোকজন কপালকুন্ডলা পড়ে অনেক খুশি। সবাই বলাবলি করছে এরকম উপন্যাস আর কেউ লিখতে পারেনি বাংলায়। বঙ্কিমচন্দ্র যাদু জানেন। তার লেখা পড়লে মোহবিষ্ঠ হিয়ে যেতে হয়। মাইকেলের লেখার চেয়েও বঙ্কিমচন্দ্র অনেক বেশী ভালো লিখেন। কপালকুন্ডলা উপন্যাসের দুটা লাইন এই রকমঃ ''তুমি অধম- তাই বলিয়া আমি উত্তম না হইব কেন''? ''পথিক, তুমি পথ হারাইয়াছ?'' লোকজন মাইকেলকে ভুলে গেলো। বঙ্কিমচন্দ্র কে নিয়ে নাচানাচি শুরু করলো।
মাইকেল লন্ডন থেকে প্যারিস গেলেন।
প্যারিসে লন্ডের চেয়ে খরচ কম। প্যারিস গিয়ে মাইকেল অনুভব করলেন, অনেকদিন দূরদেশে পড়ে আছি। এবার নিজ দেশে যাওয়া দরকার। স্ত্রী পুত্র, কন্যা রেখে মাইকেল কলকাতায় ফিরলেন। একমাত্র সম্বল ব্যারিস্টারী ডিগ্রী। কলকাতার সবচেয়ে দামী হোটেলে উঠলেন। কারন তার বাড়ি, জমি দখল হয়ে গেছে। পুরনো বন্ধুদের খুঁজে খুঁজে মাইকেল তাদের সাথে দেখা করলেন। সেই সাথে চলতে থাকলো ওকালতি। এবং ধীরে ধীরে আবার মদের প্রতি আসক্তি বাড়িয়ে তুললেন। পরিচিত লোকদের মামলা লড়তে থাকলেন একদম ফ্রি। যদি কেউ টাকা নিতে খুব অনুরোধ করে তাহলে মাইকেল বলেন কয়েক বোতল মদ কিনে দিয়ে যাও। টানা দুই বছর মাইকেল হোটেলে পার করে দিলেন। এবং ওকালতি বন্ধ করে দিলেন। তিনি বাংলায় ফিরেছেন অথচ তিনি বাংলায় লিখতে পারছেন না। লিখতে না পারার কষ্ট ভীষন কষ্ট। রাগে দুঃখে মাইকেল ওকালতি বন্ধ করে দিলেন।
প্যারিস থেকে মাইকেলের স্ত্রী ফিরে এলেন।
কারন, মাইকেল তাদের সাথে যোগাযোগ প্রায় বন্ধ করে দিয়েছিলেন। আবার দেখা দিলো মাইকেলের জীবনে অভাব। এদিকে মাইকেল কলম হাতে নিয়ে বসে থাকেন। কিন্তু কিছুই লিখতে পারেন না। তার হাতে লেখা আসে না। না লিখতে পারার দুঃখে মাইকেল প্রচুর মদ খেতে থাকলেন। সারারাত কাগজ কলম নিয়ে বসে থাকেন কিন্তু কিচ্ছু লিখতে পারেন না। দুঃখে কষ্টে মাইকেল সারারাত মদ খেতে থাকেন। অজ্ঞান হয়ে যাবার আগ পর্যন্ত মদ খেয়ে যান। সংসারে অভাব। দেখতে দেখতে মাইকেল অসুস্থ হয়ে পড়লেন। অন্যদিকে মাইকেলের স্ত্রীও ভীষণ অসুস্থ। চিকিৎসার খরচের টাকাও নেই মাইকেলের কাছে। কয়েকজন বন্ধু সামান্য কিছু টাকা দিয়েছে, সেই টাকা অতি সামান্য টাকা। সেই টাকা দিয়ে মাইকেল মদ খেয়েছে। টাকার অভাবে প্রায় বিনা চিকিৎসায় মাইকেল মারা গেলেন।
(শেষ পর্ব সমাপ্ত।)
তথ্যসুত্রঃ
১। তৎকালীন বঙ্গ সমাজ- শিবনাথ শাস্ত্রী
২। কলিকাতার কথা- প্রমথনাথ মল্লিক
৩। বিদ্যাসাগর ও বাঙ্গালী সমাজ- বিনয় ঘোষ
৪। পিতাপুত্র- অক্ষয়চন্দ্র সরকার।
৫। কলিকাতা দর্পন- রাধানাথ মিত্র
৬। মাইকেল মধুসুদনের পত্রাবলি- সুশীল রায়
৭। মধুসৃতি- নগেন্দ্রনাথ।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জানুয়ারি, ২০২৩ রাত ১০:০৮

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



