চারিদিকে কাশফুল!
শুভ্র সাদা কাশফুল। দেখতে ভাল লাগে। বাতাসে খুব সুন্দর করে দোলে একসাথে। যেন সমুদ্রের ঢেউ! অপ্রয়োজনীয় একটা ফুল। শহরের মেয়েরা কাশফুল দেখলে গালে ছোঁয়ায়। শাড়ি পড়ে তাঁরা কাশবনে গিয়ে ছবি তুলবে অবশ্যই। খুব আহ্লাদ দেখাবে। গ্রামের মানুষদের কাশফুল নিয়ে মাতামাতি করতে দেখা যায় না। তাঁরা কাশফুল, সবুজ ধানক্ষেত, পুকুর, দীঘি, খালবিল, অনেকরকম গাছপালা, বড় উঠান, খেলার মাঠ, হাঁট, রেললাইন, স্কুলঘর, সাইক্লোন বিন্ডিং ইত্যাদি দেখেই বড় হয়। গ্রামের মানুষ সবাই সবাইকে চিনে। শহরের মানুষ পাশের ফ্লাটের লোককেই চিনে না। শহরে চিপা চিপা গলি। মানুষের ভিড়। আর গ্রামের পরিবেশ অতি মনোরম।
একদম অজপাড়া গা।
দুইভাই বিলে মাছ ধরতে বসেছে। অনেকক্ষন পার হয়ে গেছে। কিন্তু বরশিতে কোনো মাছ ধরা দিচ্ছে না। বড় ভাইয়ের মেজাজ খারাপ। এদিকে ছোট ভাই ঘ্যান ঘ্যান করেই যাচ্ছে। তার ক্ষুধা পেয়েছে। এদিকে বড় ভাইয়ের পকেটে টাকা নেই। একটা মাছ ধরতে পারলে, বাজারে নিয়ে সে মাছ বিক্রি করলে ৪০/৫০ টাকা পাওয়া যেত। সেই টাকা দিয়ে দুই ভাই পেট ভরে পরোটা সবজি খেতে পারতো। ছোট ভাই বলল, বাবা তো খুব অসুস্থ। মরে গেলে আমরা খাবো কি? বড় ভাই এই প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারে না। বড় ভাই মনে মনে ভাবছে, বাবা মরে গেলে লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাবে। বাজারে সোলেমানের দোকানে কাজ করতে হবে।
দুই ঘন্টা বসে থেকে একটা মাছ পাওয়া গেলো না।
দুই ভাই মন খারাপ করে বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করলো। পুরো গ্রামের পথঘাট তাদের চেনা। ওয়াপদা সড়ক দিয়ে যখন ট্রেন ছুটে যায়, দুই ভাই তখন উঁচু সড়কে এসে দাঁড়ায়। ট্রেনের যাত্রীদের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে। দুই ভাইয়ের ধারনা যারা ট্রেনে চড়ে তাঁরা সুখী মানুষ, ধনী মানুষ। তাঁরা দুই ভাই কি কোনোদিন ট্রেনে চড়তে পারবে? দুই ভাই দীর্ঘদিন তাদের বাবার কাছে আবদার জানিয়েছে একদিন তাদের ট্রেনে উঠাতে হবে। ভ্যানচালক বাবা কথা দিয়েছে দুই ছেলেকে ট্রেনে উঠাবে। কিন্তু কবে আসবে সেই দিন। এর মধ্যে বাবা গঞ্জে গিয়ে একসিডেন্ট করেছে। ভ্যান ভেঙ্গে চুড়মার। টাকার অভাবে বাবার চিকিৎসা হচ্ছে না।
গ্রামের মধ্যে চৌধুরীরা সবচেয়ে ধনী।
চৌধুরী বাড়ির গিন্নী জানালা দিয়ে দেখলো দুই ভাই হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে। গোমস্তা পাঠিয়ে তাদের ডেকে আনলো। বলল, এই তোরা কোন পাড়ায় থাকিস রে? বড় ভাই বলল, উত্তর পাড়ায়। গিন্নী বললেন, আমার বাগানটা টা পরিস্কার করে দে। দ্যাখ পুকুরের বাম পাশটায় কি জংলা হয়ে আছে। দুই ভাই মিলে বাগান পরিস্কার করতে লেগে গেলো। ছোট ভাই বলল, গিন্নী মা যদি আগে কিছু খেতে দিতো তাহলে ভাল হতো। সকাল থেকে কিছুই খাইনি। বড় ভাই বলল, কাজ শেষ হলে অবশ্যই খেতে দিবে। চৌধুরীরা অনেক ধনী। খাওয়াবে, কিছু টাকাও দিবে। ছোট ভাই বলল, দাদা কি খেতে দিবে? পোলাউ কি দিবে? আস্তো ডিম কি দেবে?
বাগানটা অনেক বড়।
পরিস্কার করতে গিয়ে অনেক বেগ পেতে হলো। কাজ শেষের দিকে। ছোট ভাই মনে মনে ভাবছে, না জানি কি কি খেতে দেন গিন্নী মা। আজ সে ইচ্ছে মতো খাবে। খাওয়া শেষে অনুরোধ করবে, কিছু খাবার যেন অসুস্থ বাবা মায়ের জন্য দিয়ে দেয়। দিবে না? নিশ্চয়ই দেবে। চৌধুরী ভাল মানুষ। এমন সময় চৌধুরী সাহেব বাইরে থেকে এসে উঠানে প্রবেশ করলেন। দুই ভাইকে দেখে বললেন, এই তোরা কারা? বাগানে কি করিস? দুই ভাই চৌধুরীর মুখভঙ্গি দেখে ভয় পেয়ে গেলো। চৌধুরী বললেন, তোরা নিশ্চয়ই চোর। আজ তোদের খাইছি। দুই ভাই ভয় পেয়ে দিলো দৌড়। চৌধুরী সাহেব দুই ভাইয়ের সাথে দৌড়ে পারবে না, জানা কথা।
গ্রাম দেশের বিকেল গুলো বড় বিষন্ন হয়।
আকাশে মেঘ জমেছে বেশ। রাগে দুঃখে ছোট ভাইয়ের চোখে পানি এসে পড়েছে। টানা আড়াই ঘন্টা পরিশ্রম করলো। পুরো বাগান পরিস্কার করলো। সারা শরীর ব্যথা হয়ে গেছে। অথচ কিছুই ভাগ্যে জোটলো না। এক বাটি মুড়ি আর একটুকরো গুড় পেলেও চলতো। খিদেয় পেট ছটফট করছে। বড় ভাই বলল, তাড়াতাড়ি পা চালা। মেঘ ডাকছে। বৃষ্টি নামবে। ছোট ভাই বলল, খালি পেটে কি করে জোরে হাঁটবো। বড় ভাই বলল, মা নিশ্চয়ই কিছু না কিছু ব্যবস্থা করেছে। ছোট ভাই বলল, আজ বাড়ি ফিরলে মা বকবে। মারতেও পারে। মার মন মেজাজ ভাল নেই। বড় ভাই বলল- চলল। চল। বাড়ি চল।
ঠিক এমন সময় বৃষ্টি নামলো। গাঢ় বৃষ্টি।
দুই ভাই ভিজতে ভিজতে বাড়ি ফিরছে। বৃষ্টি এলে টিনের ছাদ থেকে চুইয়ে চুইয়ে সারারাত পানি পড়ে। বাড়ি ফিরে দুই অপ্রত্যাশিত একটা আঘাত পেলো। তাদের অসুস্থ পিতা মারা গেছে। তাদের মা শোকে পাথর। দুঃখ কষ্ট ও বঞ্চনায় ভরা এই পৃথিবীটাকে এত সুন্দর করে বানানোর কি দরকার ছিলো ঈশ্বরের!
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জানুয়ারি, ২০২৩ রাত ১০:১৪