
যেসব মেয়েরা বাসা বাড়িতে কাজ করে-
তাদের বলা হয়- গৃহপরিচারিকা, চাকরানি, বুয়া ইত্যাদি। আমাদের সবার বাড়িতে দুই তিনজন করে চাকরানি আছে। ঢাকা শহরের মানুষ যেন কাজের লোক ছাড়া চলতেই পারে না। অবশ্য একটা সংসারে কাজ তো কম না। অনেক কাজ। সবচেয়ে কষ্টের কাজ হচ্ছে কাপড় ধোয়া, ঘর মোছা। যেদিন বাসায় বুয়া আসে না, সেদিন গৃহিনীর মন মেজাজ অত্যাধিক খারাপ থাকে। বাংলাদেশ দরিদ্র দেশ। বেশির ভাগ কাজের লোক আসে গ্রাম থেকে। সাত বছরের বাচ্চা মেয়েকেও দেখেছি বাস বাড়িতে কাজ করতে। আবার ৫০ বছরের বৃদ্ধাকেও দেখেছি মেসের লোকদের জন্য রান্না করতে। মেসে যারা থাকে এদের মধ্যে দুই একজনের চরিত্র অতি খারাপ। তাঁরা বয়স্ক বুয়ার দিকে খারাপ নজর দেয়ে। খারাপ ইঙ্গিত করে। কেউ কেউ ইঙ্গিতে সাড়া দেয়।
আমাদের এলাকায় দুজন স্বামী স্ত্রী আছেন।
তাঁরা বেশ ধনী। এবং ভালো মানুষ। তাদের বাসায় কাজ করে মরিয়ম নামে এক মেয়ে। বয়স ১৬ হবে। মেয়েটা যখন গ্রামে ছিলো। ঠিকভাবে তিনবেলা খেতে পেতো না। একদম শুকনো ছিলো। শহরে আসলো। এখন সে পেট ভরে তিনবেলা খেতে পায়। ইউটিউবে সিনেমা দেখতে পারে। মাস শেষে টাকা পায়। সেই টাকা গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়। গ্রামে তার বাবা মা ও ভাই বোনেরা খেয়ে পড়ে বেঁচে আছে। দরিদ্রতার কারনে তার লেখাপড়া হয়নি। অনেকে বলেন, গার্মেন্স হবার পর থেকে কাজের লোক পাওয়া যায় না। বস্তিতে যারা থাকে তাঁদের বেশির ভাগই বাসা বাড়িতে কাজ করে। স্বামী রিকশা চালায় অথবা ভ্যান গাড়ীতে করে সবজি বিক্রি করে। এখন তো ঢাকা শহরে যারা ছুটা কাজ করে- তাদের এক কাজ এক হাজার টাকা। যেমন কাপড় ধোয়া এক হাজার টাকা। ঘর মোছা এক হাজার টাকা। তিনটা কাজ করলে তিন হাজার। একজন বুয়া সারাদিনে ৪/৫ টা বাসায় কাজ করে।
আমাদের বাসায় তিনজন কাজের লোক আছে।
একজন শুধু সিড়ি মুছে দিয়ে যায়। নিচ তলা থেকে ছয় তলা পর্যন্ত। সে মাসে ১০/১২ দিন আসে না। এজন্য তাকে কিছু বলা হয় না। এই মহিলা আমাদের বাসায় ৭ বছর ধরে কাজ করছে। আমার ঘরে একজন কাজের লোক আছে। সে কাপড় ধোয়, ঘর মুছে, থালাবাটি ধুয়ে দিয়ে যায়। এই মহিলা কাজ করছে অল্প কিছু দিন ধরে। সে কাজ করার সময় তার ছোট ছেলেকে নিয়ে আসে। আমার ভাবীর ঘরে কাজের লোক দুইজন। কাজের লোকদের অনেক ভালো ইতিহাস আছে। আবার অনেক খারাপ ইতিহাসও আছে। অনেক কাজের লোক বাসা বাড়িতে কাজ করতে এসে তেল, নুন পেঁয়াজ চুরী করে। অবশ্য এমন কাজের লোক আমি কখনও দেখিনি। আমার ঘরে যারা কাজ করেছে- কেউ কোনোদিন চুরী করেনি। আমার ঘরের আলমারি সব সময় খোলা থাকে। বাসায় কেউ না থাকলে বুয়া একা কাজ করে দিয়ে চলে যায়। ঢাকা শহরে ভালো কাজের লোক পাওয়া মানে বিরাট ব্যাপার।
কাজের লোকদের সাথে আমি কোনোদিন খারাপ ব্যবহার করি নাই।
অবশ্য আমি কারো সাথেই খারাপ ব্যবহার করি না। আমি বুয়াকে (আমি কখনও বুয়া বলি না। আপা বলি) অনুরোধ করি আমাকে এক কাপ চা বানিয়ে দেন। বুয়া বলে আমার অনেক কাজ আজ পারবো না। তাকে আবার অনুরোধ করি। সে এক কাপ চা বানিয়ে দেয়। নিজের জন্যও এক কাপ বানায়। দুজন মিলে চা খাই। টুকটাক গল্প করি। এক বছর আমাদের বাসায় কাজ করেছিল মিনি নামের একটা মেয়ে। মেয়েটার বয়স ১৭। বেশ আধুনিক মেয়ে। সে তার বেতনের টাকা জমিয়ে একটা স্মার্ট ফোন কিনলো। আমাকে বলল, ফেসবুক খুলে দিতে। দিলাম। সে আমাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠালো। মিনি টিকটক করে। তার ফলোয়ার অনেক। অনেক লাইক পায়। মিনি মাসে একবার পার্লারে যায়। ভ্রু প্লাক করে। ফেসিয়াল করে। তার বাবা মা তাকে ডেকে নিয়ে গেলো। জোর করে বিয়ে দিলো। কিন্তু মিনি তিন মাস সংসার করতে পারলো না। স্বামী তাকে মারে। গালাগালি করে।
আমি এক বাসায় দেখলাম কাজের লোক ৭ জন।
অথচ বাসায় লোকসংখ্যা বাবা মা আর দুই বোন। চারজন সদস্যের বাসায় কাজের লোক ৭ জন। প্রতিটা মেয়ে গ্রাম থেকে এসেছে। কারো লেখাপড়া নেই। শহরে এসে তাঁরা খুশি। টিভি দেখতে পায়। বাংলা সিনেমা দেখতে পারে মন ভরে। সুযোগ পেলে ড্রাইভার আর দাড়োয়ানের সাথে প্রেম প্রেম খেলা খেলে। খারাপ লোকদের বাসায় কাজ করলে কাজের লোকদের অনেক কষ্ট। ঠিকভাবে খেতে দেয় না। থাকার জন্য ভালো ঘর দেয় না। রান্না ঘরে ঘুমাতে হয়। গালি দেয়। তুই তুকারি করে। আবার ভালো মানুষের পাল্লায় পড়লে তাদের ভালো হয়। ভাগ্য ফিরে যায়। যেমন আমাদের এলাকায় একটা বাড়ি আছে। পাঁচ তলা বাড়ি। বাড়ির মালিক তার বউ বাচ্চা নিয়ে আমেরিকা চলে গেছে। বাড়ির দায়িত্ব দিয়ে গেছে বুয়ার হাতে। বিশ্বস্ত বুয়া। সে এখন বাড়ির কর্তী।
আমাদের গ্রামের কথা বলি।
আমার দাদা দাদী বেঁচে থাকতে একটা মেয়ে আসে। বাচ্চা মেয়ে। তার বাবা মা নেই। মেয়েটার বয়স ৬ বছর। নাম জরিনা। সেই জরিনা টানা ২৪ বছর দাদা দাদীর সাথে গ্রামে থাকলো। দাদা দাদী তাকে নিজের মেয়ের মতো মানুষ করলো। সামান্য কিছু লেখাপড়া শেখালো। দাদা দাদীর ইচ্ছা মৃত্যুর আগে তাঁরা জরিনার বিয়ে দিবেন। কিন্তু দাদা দাদী জরিনাকে বিয়ে দেবার আগেই মরে গেলো। কিন্তু মরে যাওয়ার আগে জরিনার বিয়ের দায়িত্ব দিয়ে গেলো আমার আব্বাকে। আব্বা এই দায়িত্ব সঠিক ভাবে পালন করলো। এক ভালো লোকের সঙ্গে জরিনার বিয়ে দিলো। বিয়ে বেশ ধুমধাম করেই দেওয়া হলো। সেন্টার ভাড়া করা ভলো। তিন শ' লোক দাওয়াত করা হলো। জরিনা এখন তার স্বামীর সাথে ঢাকা থাকে। স্বামী সন্তান নিয়ে সে ভালো আছে। তার তিন সন্তান। সে আমাদের বাসায় প্রায় আসে। এবং দাদা দাদী এবং আব্বার কথা স্মরণ করে কিছুক্ষন কান্না করে।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ দুপুর ১:০২

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




