আকাশ ফর্সা হতে শুরু করেছে।
আবদুল জলিল জানালা খুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, আয় আয়। দয়া করে আয়। ভীষন যন্ত্রনা হচ্ছে রে। আয় আয়। গত একমাসে আবদুল জলিল একটা কবিতা লিখতে পারেন নাই। অথচ কাগজ কলম নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে ছিলেন। একটা লাইন তো দূরের কথা, একটা শব্দ লিখতে পারেনি। না লিখতে পারার একটা যন্ত্রনা আছে। আবদুল জলিল আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, হে ঈশ্বর 'দয়া করো'। আমাকে করুনা করো। আমাকে লিখতে দাও। আমি আর তোমার কাছে কিচ্ছু চাই না। দীর্ঘদিন ধরে না লিখতে পারায় আমার ভীষন কষ্ট হচ্ছে। আয় আয় শব্দরা আয়। উড়ে উড়ে আয়। অলৌকিক কনো শক্তি আমার উপর এসে ভর কর। আমি মন ভরে লিখি। লিখে যেতে চাই। আমি আর কিচ্ছু চাই না।
আবদুল জলিলের বয়স পঁয়তাল্লিশ।
বিয়ে করেন নি। কারন বিয়ে করলে বউ নিশ্চয়ই অনেক যন্ত্রনা করতো। মন ভরে কবিতা লেখা যেতো না। এমনকি তিনি কবিতা লেখার জন্য চাকরি বা ব্যবসা করেন নি। তাতে যদি কবিতা না লিখতে পারেন। বাপ দাদার সম্পত্তি অনেক পেয়েছেন। খাওয়া, থাকা বা অন্যান্য খরচ নিয়ে তার কোনো চিন্তা নেই। আবদুল জলিল কখনও বিখ্যাত কবি হতে চান নি। শুধু কবিতা লিখতে চেয়েছেন। গত তেরো বছর ধরে তিনি কবিতা লিখছেন। এ পর্যন্ত তার কবিতার সংখ্যা সাতচল্লিশ টি। তার স্বাদ হয়েছিলো পত্রিকায় তার কবিতা ছাপা হোক। টানা দুই বছর সেই চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সাহিত্য পাতার সম্পাদক তার কবিতা ছাপাননি। একজন বলেছিলেন, পত্রিকায় কবিতা ছাপাতে হলে সাহিত্য পাতার সম্পাদককে কবিতার সাথে এক বোতল হুইস্কি দিতে হয়।
আবদুল জলিল সাহেব ব্যলকনিতে এসে দাঁড়ালেন।
তার মন আজ বেশ খারাপ। সারারাত তিনি ভেবেছিলেন কি নিয়ে কবিতা লিখবেন। পুরো কবিতাটা মাথায় সাজিয়ে রেখেছিলেন। অথচ একটা লাইন লিখতে পারলেন না। জ্যোস্না রাতে এক মেয়ে পুকুরে নেমেছে। আশে পাশে কেউ নেই। ফকফকা জ্যোস্নায় ভেসে যাচ্ছে বিশ্ব চরাচর। মেয়েটা একা মনের সুখে পুকুরে গোছল করছে। পুকুরের পানি একদম স্বচ্ছ। পুকুরের পানিতে চাঁদের ছায়া পড়েছে। যেন চাদটা পুকুরে নেমে এসেছে। সে-ও মেয়েটার সাথে স্নান করতে চায়। মেয়েটার গায়ে একটা সুতাও নেই। ভরাট বক্ষ, উন্নত নিতম্ব। সরু কোমর। মাথা ভরতি চুল। দূর থেকে একটা প্যাঁচা মুগ্ধ হয়ে মেয়েটাকে দেখছে। কিছু জোনাকী পোকা বারবার জ্বলছে, নিবছে। মেয়েটা গোছল করে পুকুরঘাটে আসে। ঠিক তখন মেয়েটা অশ্বথ গাছের কাছে কিছু একটা দেখে চমকে যায়। এই হচ্ছে কবিতার বিষয়। অথচ একটা লাইনও আবদুল জলিল লিখতে পারলেন না।
শাহেদ জামাল আজ আবদুল জলিলের বাসায় এসেছে।
ঘটনা চক্রে এক শীতের সন্ধ্যায় শাহেদ জামালের সাথে পরিচয় হয়েছে। (পরিচয়ের গল্পটা আরেকদিন করা যাবে) আবদুল জলিল বললেন, শাহেদ আপনি আমার বাসায় এসেছেন আমি খুব খুশি হয়েছি। আসুন আগে খাওয়া-দাওয়া সেরে নিই। তারপর আমরা আলোচনায় বসবো। শাহেদ আর জলিল সাহেব খেতে শুরু করলেন। টেবিল ভরতি খাবার। শাহেদ বলল, এত খাবার কেন? জলিল বললেন, আপনি আমার বাড়িতে আজ প্রথম এলেন। শাহেদ বেশ তপ্তি নিয়ে খেলো। প্রতিটা খাবার স্বাদ হয়েছে। মেনি মাছ আর পাবদা মাছ খেয়ে শাহেদ মুগ্ধ। মাছের পেট ভরতি ডিম। দেশী মাছ। দেশী মাছের ডিম খেতে দারুন। ইলিশ মাছের ডিম যেমন মজা ঠিক তেমনি প্রতিটা দেশী মাছের ডিমও অত্যাধিক স্বাদ। তবে রুই মাছের ডিম কেন জানি ভালো লাগে না। এই শহরে শাহেদের সবচেয়ে ভালো লাগে নীলাদের বাসার খাবার। অথচ সেদিন রুই মাছের ডিম খেয়ে সে আরাম পায়নি।
শাহেদ এবং জলিল সাহেব মুখোমুখি বসে আছেন।
শাহেদ বলল, আপনাকে কবিতা লিখতে হলে- একজন বিশেষ নারীর ভালোবাসা পেতে হবে। নারীসঙ্গ ছাড়া জীবনে আপনি কিছুই অর্জন করতে পারবেন না। আপনার কোনো উন্নতি হবে না। নারীকে জানতে হবে, বুঝতে হবে, ভালোবাসতে হবে। উপভোগ করতে হবে। তাহলেই আপনি কবিতা লিখতে পারবেন। আপনার বয়স খুব বেশি হয়নি। এখন বিয়ে করুণ। স্ত্রীকে ভালোবাসুন। জড়িয়ে ধরুন। চুমু দিন। যত ঘনিষ্ঠ হবেন, আপনার জড়তা কেটে যাবে। তারপর দেখবেন ম্যাজিক। হু হু করে একটার পর একটা শব্দ আমার মাথায় আসতেই থাকবে। আপনি অনগর্ল লিখে যেতে পারবেন। জলিল শাহেব বললেন, প্রিয় শাহেদ আপনি আমার চোখ খুলে দিলেন। এতদিন আমি কি প্রচন্ড ভুলের মধ্যে ছিলাম। বলেই জলিল সাহেব কেঁদে ফেললেন। কাঁদতে কাঁদতেই বললেন, কেন যে আপনার সাথে আরো আগে পরিচয় হলো না! শাহেদ বলল, আপনি একজন বিখ্যাতা কবি হবেন। এই আমি বলে রাখলাম।
এরপর হু হু করে বেশ কয়েকটা ঘটনা ঘটে গেলো।
আবদুল জলিল বিয়ে করলেন। গ্রামের সহজ সরল একটা মেয়েকে। মেয়েটা সহজ সরল সুন্দর। রুপে কোনো উগ্রতা নেই, বরং নমনীয়। বিয়ের তিন মাস পর আবদুল জলিল অনেক গুলো চমৎকার কবিতা লিখে ফেললেন। একজন প্রকাশক তার কবিতা গুলো পড়ে অনেক মুগ্ধ হলেন এবং আবদুল জলিলের কবিতার বই প্রকাশ হলো। বইয়ের নাম- 'এই সব শীতের রাতে আমার হৃদয়ে মৃত্যু আসে'। কবিতা প্রেমীরা আবদুল জলিলের বই কিনলেন। দেখা গেলো একমাসে তৃতীয় মুদ্রন শেষ। দৈনিক পত্রিকায় আবদুল জলিল সাহেবের বিশাল এক সাক্ষাৎকার ছাপা হলো। তিনটা টিভি চ্যানেল তার সাক্ষাৎকার নিলো। পরের বছর আবদুল জলিল বাংলা একাডেমিতে থেকে পুরস্কার পেলেন। দুইজন প্রকাশক আবদুল জলিলকে খুব করে ধরেছেন, তাদের যেন একটা পাণ্ডুলিপি দেন। 'এই সব শীতের রাতে আমার হৃদয়ে মৃত্যু আসে' বইটি আবদুল জলিল শাহেদ জামালকে উৎসর্গ করেন।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই মার্চ, ২০২৩ রাত ১:১২