আজ পঁচিশ দিন ধরে আমি বাসা থেকে পলাতক।
কারণ, আমি বিয়ে করতে চেয়েছিলাম। আব্বা এই কথা শুনে বলল- হারামজাদা কামকাজ করো না, বিয়ে করবে? বউকে খাওয়াবি কি? আমি বললাম, রিজিকের মালিক আল্লাহ। আল্লাহ'ই একটা ব্যবস্থা করে দিবেন। মা বলল- তুই ভাদাইম্মা এবং অলস। তোকে কোনো মেয়ে বিয়ে করবে না। এযুগের মেয়েরা বোকা না।
আমি মাকে বললাম- মা, মেয়ে আমি ঠিক করে ফেলেছি। ইডেন কলেজ থেকে মাস্টার্স করেছে। দেখতে শুনতে ভালো। নানান ধরনের খাবার রান্না করতে জানে। এই কথা শুনে মা আমার দিকে 'হা' করে তাকিয়ে আছে। আব্বা বলল- তুমি আমার বাসা থেকে বের হয়ে যাও। আমি তোমার মুখ দেখতে চাই না। আমি এক বস্ত্রে এবং খালি পকেটে বাসা থেকে বের হয়ে গেলাম।
কোরয়ান-হাদীস পড়ে জানতে পারলাম-
আল্লাহ্ কুরআনে বলেছেন, "লাক্বাদ কা-না ফী রাসুলুল্লাহি উসওয়াতুন হা'সানা" -"তোমাদের জন্য রাসুলের জীবনই হলো সর্বোত্তম আদর্শ"। সুতরাং বিয়ের অনুষ্ঠানে সেটুকুই কেবল আবশ্যক যা আমাদের নবীজি করতে বলেছেন। এর বাইরে কিছু পালন না করলে কেউ যদি অখুশী হয় তাহলে আমরা কেবল বলতে পারি, "দুঃখিত, আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ঠ"। নবীজি বিয়েকে সুন্নত বলে উল্লেখ করেছেন। বিয়ে সওয়াবের কাজ। এটি খুবই দায়িত্বপূর্ণ পবিত্র ইবাদতও বটে।
আরও যা জানলাম- বিয়েতে রয়েছে বরকত।
পবিত্র কুরআনে সুরা নূর' এ অনেক গুরুত্বপূর্ন কথা বলা হয়েছে। তিরমিযী শরীফে লেখা আছে- ''তিনটি বিষয়ে দেরী নয়-
১। সময় হলে নামাজে,
২। লাশ এসে গেলে জানাযায়,
৩। সমমানের পাত্র পেলে বিয়েতে। বিয়ের শুরু হযরত আদম ও হাওয়া (আঃ) হতে। একজন সুপুরুষ ও সৎকর্মশীল নারী দেখে বিয়ের বন্ধন হওয়া উচিত। বরের আর্থিক স্বচ্ছলতা বিবেচনা করে মোহরানা ধার্য্য করা চাই। নবীজি বলেন, ''তোমাদের মধ্যে সেই উত্তম যে তার স্ত্রীর কাছে উত্তম''। স্ত্রীদের বলা হয়েছে, ''আল্লাহ ছাড়া কাউকে সেজদা করতে যদি বলতাম তবে স্ত্রী কর্তৃক স্বামীকে সেজদা করতে বলতাম''। সুতরাং স্বামী স্ত্রী উভয়েই একটি সংসার সুখের করতে দায়িত্ব নিতে হবে।
পথে পথে ঘুরে ঘুরে নানান চিন্তা ভাবনা করে দেখলাম-
এবং হাদীস অনুযায়ী এখন আমার বিয়ে করা উচিত না। কিন্ত নীলাকে যদি এখন বিয়ে না করি- তাহলে তার পরিবার তাকে অন্য কোথাও বিয়ে দিয়ে দিবে। নীলাকে ফোন করে বললাম- তুমি কোনো চিন্তা করো না। আমি সব ব্যবস্থা করছি। নীলাকে মিথ্যা আশ্বাস দিলাম। নীলা বলল- বিয়ে পরে করো, এখন বাসায় এসে আমাকে আংটি পরিয়ে যাও। বোকা মেয়েটা বুঝে না- একটা আংটি কেনার টাকাও এখন আমার কাছে নেই। পঁচিশ দিন পর বাসায় গেলাম। বাসার পরিস্থিতি স্বাভাবিক। ছোট বোন বলল- ভাইয়া কি পাগলামী শুরু করছে? আমি বললাম ভাত দে, অনেক ক্ষুধা লাগছে। বোন বলল- আগে সেলুনে যাও, তোমাকে দেখে তো মফিজ পাগলার মতন লাগছে।
মধ্যরাত্রে শরীর কাঁপিয়ে জ্বর আসলো।
সাথে তীব্র মাথা ব্যাথা। কাউকে যে ডাকব সেই শক্তিটুকুও শরীরে নেই। ফযরের আজানের পর জ্ঞান হারালাম। তারপর আমার আর কিছু মনে নেই। জ্ঞান ফেরার নিজেকে আবিস্কার করলাম হাসপাতালে। আমার পাশে সব প্রিয় মানুষেরা কিন্তু নীলা নেই। নীলাকে খুব দেখতে ইচ্ছা করছে। মেয়েটা আমাকে এই অবস্থায় দেখলে খুব কষ্ট পাবে। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম- আমার খুব কঠিন কোনো অসুখ হয়েছে। কি অসুখ ? আমি কি মরে যাবো ? মাথা ব্যাথা শুরু হলেই তখন চোখে কিছু দেখতে পাই না। মনে হয়, মাথার ভেতর কে যেন হাতুড়ি দিয়ে পিটাচ্ছে।
আমি হাসপাতালে যাওয়ার তিন দিন পর নীলা আমাকে দেখতে এলো।
আমার খুব অবনতি হয়েছে। এখন সারাক্ষনই চোখে ঝাপসা দেখি- প্রতিদিন মাথা থেকে থোকা থোকা চুল পরছে। গায়ের রঙ হঠাত করে খুব কালো হয়ে গেছে। নীলা আমার বুকের মাথা রেখে অনেকক্ষন কাঁদল। যাওয়ার আগে নীলা- শক্ত করে আমার হাত ধরে বলল- আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। তোমার কিচ্ছু হবে না। আল্লাহ এত নিষ্ঠুর হতে পারবেন না। আমি মনে মনে বললাম- আল্লাহ অনেক নিষ্ঠুর নীলা, আল্লাহ অনেক নিষ্ঠুর। গভীর রাতে আমার অবস্থা খুব খারাপ হলো। নার্স ডাক্তার'রা ছোটাছুটি শুরু করলো। আমাকে পরপর দু'টা ইনজেকশন দিল ডাক্তার। আমি গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম।
আমি এখন এক ধরনের ঘোরের মধ্যে আছি।
সব কিছুই স্বপ্ন স্বপ্ন লাগে। বাস্তব-অবাস্তব মিশে একাকার হয়ে গেছে। চোখ বন্ধ করলেও দেখি, খোলা রাখলেও দেখি। কোনটা স্বপ্ন কোনটা সত্যি বুঝতে পারটেছি। অন্য রকম একটা জগতে প্রবেশ করেছি। সে জগতে সময় বলে কিছু নেই, দিন-রাত বলে কিছু নেই। একটু পরপর এসে কে যেন এক আকাশ ভালোবাসা নিয়ে আমার কপালে হাত রাখছে হাতটা খুব ঠান্ডা। তার হাত ভর্তি চুড়ি। চুড়ির ঝন ঝন শব্দটা ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে- এই হাত ধরে ঢাকা শহরের অনেক পথ হেঁটেছি। এখনও হাঁটছি, অন্ধকার একটা পথে। একা একা। ঠান্ডা হাতের স্পর্শ এবং চুড়ির ঝনঝন শব্দ শুনতে পাচ্ছি না। আমার খুব ভয় ভয় করছে। অন্ধকার এবং অজানা পথটা একাএকা কিভাবে পাড়ি দিব। আমার চোখ থেকে দু'ফোটা পানি গড়িয়ে পড়লো।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৩ রাত ৮:২০