somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

রাজীব নুর
আমার নাম- রাজীব নূর খান। ভালো লাগে পড়তে- লিখতে আর বুদ্ধিমান লোকদের সাথে আড্ডা দিতে। কোনো কুসংস্কারে আমার বিশ্বাস নেই। নিজের দেশটাকে অত্যাধিক ভালোবাসি। সৎ ও পরিশ্রমী মানুষদের শ্রদ্ধা করি।

একজন বিনোদিনী রাই দাস

২২ শে ডিসেম্বর, ২০২৩ রাত ৯:৫২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



সময়টা তখন ১৮৬২ সাল।
সাদা কালো ধূসর সময়। ভারতবর্ষের ক্ষমতা ইংরেজদের হাতে। ইংরেজরা চেষ্টা করছে ভারতের জন্য ভালো কিছু করতে। ভারতবাসী কেউ কেউ ইংরেজদের পক্ষে, কেউ কেউ বিপক্ষে। আবার কেউ কেউ কোনো পক্ষেই নেই। তাতে ইংরেজদের কোনো সমস্যা নেই। তারা দাপটের সাথে আছে। বরং ভারতীয়রা ইংরেজের ধীরে ধীরে বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে। ভারতের চন্দননগরে 'বাংলা ও ফরাসি' বিদ্যাচর্চার জন্য একটি স্কুল নির্মান করা হয়। স্কুলের নাম- 'ন্দননগর কানাইলাল বিদ্যামন্দির'। এদিকে ঢাকায় প্রথম রেল লাইন স্থাপিত হয়। এদিকে আসামে চলতো দাস বেচাকেনা। দাস কেনাবেচার জন্য ইংরেজ সরকার আইন করে দিয়েছিলো- রেজিট্রেশন ফ্রি ৪ টাকা ৪ আনা। এদিকে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ব্রাহাম লিংকন ক্রীতদাস মুক্তির ঘোষণায় স্বাক্ষর করেন।অন্যদিকে লন্ডনের কিংস কলেজের একটি ক্লাসে লেকচার দিচ্ছিলেন ম্যাক্সওয়েল। একটি প্রয়োজনে বিদ্যুৎ–চুম্বকীয় তরঙ্গের বেগ বের করলেন। দেখা গেল, এই বেগ হয়ে যাচ্ছে আলোর বেগের সমান। এভাবেই জোড়া লেগেছিল আলোর সঙ্গে বিদ্যুৎ–চুম্বকের। অনেকের মতেই নিউটন ও আইনস্টাইনের পরে সেরা পদার্থবিদ হলেন ম্যাক্সওয়েল।

অভিনেত্রী সুচিত্রা সেনের নাম আপনারা সবাই জানেন।
কিন্তু রাই বিনোদিনী দাসকে কি চিনেন? চিনলেও কতটুকু চিনেন? বাজারে রাই বিনোদিনীকে নিয়ে গল্পের শেষ নেই। অবশ্য বিনোদিনী নিজেকে সব সময় পতিতা বলেই পরিচয় দিয়েছেন। এক পতিতার ঘরেই জন্ম তার। মোটকথা যৌনপল্লীতেই তার জন্ম। বয়সে রাই বিনোদিনী রবীন্দ্রনাথের চেয়ে দুই বছরের ছোট। অবশ্য তারা দুজন একই বছরে দেহ ত্যাগ করেন। রবীন্দ্রনাথের বাসা থেকে বিনোদিনীর বাসার দূরত দুই মাইল। কিন্তু দুজনের মধ্যে সামাজিক দুরত্ব আকাশ পাতাল। রবীন্দ্রনাথের সাথে তার কখনও দেখা সাক্ষাৎ হয়নি। তবে জ্যোতিন্দ্রনাথের লেখা নাটকে বিনোদিনী অভিনয় করেছেন। অভিনয় করেছেন মাইকেলের লেখা নাটকেও। একবার গুজব উঠেছিলো- জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে বিনোদিনীর প্রেম হয়েছে। ঘটনা পুরোটাই বানোয়াট। ১৯৪১ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারী রাই বিনোদিনীর মৃত্যুর পর কোনো পত্রিকা তাকে নিয়ে দুই লাইন লিখেনি। লিখলে যে জাত যাবে! নাট্যসম্রাজ্ঞী বিনোদিনী দাসী ‘নটী বিনোদিনী’ নামে পরিচিত। কালজয়ী অনেক চরিত্রে এক দশকের বেশি সময় কলকাতার থিয়েটারে অভিনয় করেছেন এই অভিনেত্রী। নাটকের জন্য ভারতের অনেক অঞ্চলে তিনি গিয়েছেন।

বিনোদিনী দেখতে কেমন ছিলেন?
শ্যামলা গায়ের রঙ। হালকা পাতলা ছিপছিপে। ভরাট গাল। সরু কোমর। সব কিছু মিলিয়ে অতি সামান্য চলাফেরা। কিছু চটক অবশ্যই ছিলো। গতাই তো এই বিনোদিনী রাইকে নিয়ে তৎকালীন জমিদারেরা মারামারি পর্যন্ত করেছেন। বিনোদিনীর বাড়ির সামনে লাঠি নিয়ে পাহাড়া বসাতে হয়েছিলো। নিজের সাজ পোশাক নিয়ে বিনোদিনীর অনেক বিলাসিতা ছিলো। ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করতেন তিনি। টাকা খরচ করতেন প্রচুর। টাকা গহনা যে কোনো দামী বস্তুর বিনিময়ে এমনকি ভয় দেখিয়ে ধনীরা বিনোদিনীর সান্নিধ্য আশা করতো। বিনোদিনী যতটা পারতো এড়িয়ে যেতো। বারবণিতার পরিবেশ থেকে একেবারে ছোট বয়েসে বাংলা মঞ্চে অভিনেত্রী হিসাবে আত্মপ্রকাশ করা চারটেখানি কথা নয়। সানী লিওনের যুগ আর বিনোদিনীর যুগ সম্পূর্ন বিপরীত। বিনোদিনীর প্রথম অভিনয় ছিল ১২ বছর বয়সে। নাচ গানে পারদর্শী বিনোদিনী খুব তাড়াতাড়ি অভিনয়ে দক্ষ হয়ে ওঠেন এবং একজন প্রথম শ্রেণীর অভিনেত্রী হিসাবে খ্যাতি লাভ করেন। 'বিল্বমঙ্গল' ছিল বিনোদিনীর জীবনের শেষ নাটক। বিনোদিনীর ভাগ্য ভালো তাকে তসলিমা নাসরিনের মতো বিতাড়িত হতে হয়নি নিজ জন্মভূমি থেকে। ভাবলে কষ্ট হয়, অসংখ্য দূর্নীতিবাজ বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কোটি টাকার গাড়িতে চড়ছে, এমপি, মন্ত্রী হচ্ছে। আর একজন লেখিকা ইচ্ছার বিরুদ্ধে পরবাসে।

বিনোদিনীর পাঁচ বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয়।
কিন্তু স্বামীর সঙ্গে তাঁর তেমন কোনো যোগাযোগ ছিল না। স্বামী তাকে বিয়ের পরের দিন ফেলে চলে যায়। এবং অন্য জায়গায় বিয়ে করে। তারপর বিনোদিনী তিনজনের রক্ষিতা ছিলেন। সেই সময় রক্ষিতা রাখা অতি মামুলী ব্যাপার ছিলো। যার টাকা আছে তার কয়েকটা করে রক্ষিতা আছে। ইসলামেও দাসী ভোগ করা জায়েজ। যাইহোক, স্টার থিয়েটারে কাজ করার সময় বিনোদিনী খ্যাতির তুঙ্গে। স্বয়ং জনপ্রিয় এবং বিখ্যাত রামকৃষ্ণ পরমহংস টিকিট কেটে তার নাটক দেখেছেন। মুগ্ধ হয়ে তাকে আর্শীবাদ করেন। সর্বমোট বিনোদিনী ৫০টি নাটকে ৯০ টি চরিত্রে অভিনয় করেন। বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে মাত্র পঁচিশ/ছাব্বিশ বছর বয়সে বিনোদিনী অভিনয় ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। পরে বঙ্গদেশে যখন গ্রামোফোন রেকর্ড চালু হয়, তখন গায়িকা হিসেবে তাঁর দ্বিতীয়বারের মতো আর্বিভাব ঘটে। বিনোদিনী রাগে দুঃখে অভিমানে ১৮৮৬ সালে মাত্র বাইশ তেইশ বছর বয়সে অভিনয় জীবন থেকে স্বেচ্ছা-নির্বাসন গ্রহণ করেন তারপর আর কোনদিনই অভিনয় জগতে ফিরে আসেননি। বিনোদিনী 'আমার কথা' নামে একটি আত্মজীবনী প্রকাশ করেন ১৯১২ সালে। সেই সময় বিনোদিনীর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ শিক্ষিত সমাজের মধ্যে তুমুল আলোড়ন তোলে।

১৮৬২ সালে জন্মগ্রহণ করেন বিনোদিনী। তাঁর মা ছিলেন যৌনকর্মী।
থিয়েটার ত্যাগের পর বিনোদিনীর একমাত্র বড় আদরের কন্যা শকুন্তলার জন্ম হয় এবং মাত্র ১৩ বছর বয়সে তার মৃত্যু হয় (১৯০৩ সালে)। ১৮৭৭ সালের শেষ দিকে, স্বয়ং গিরিশচন্দ্র ঘোষের সান্নিধ্য পেয়ে বিনোদিনী বিরাট পরিবর্তন হয়। তখন বিনোদিনীর বয়স মাত্র ১৪। বিনোদিনীর দুটা কবিতার বই প্রকাশ করেন ১৯১৮ সালে। বাসনা এবং কনক ও নলিনী। এবং আত্মজীবনী প্রকাশ করেন- ‘আমার কথা’ (১৯২০)। মূলত বিনোদিনী একজন সহজ সরল বাঙ্গালী নারী। সুচিত্রা সেনের মতো তার জীবন আনন্দময় ছিলো না। বিনোদিনী তার দুঃখী মায়ের কথা ভেবে মন খারাপ করে থাকতেন। তার ভাই অল্প বয়সে বিনা চিকিৎসায় মারা যায়। নিজের আদরের কন্যা অল্প বয়সে মারা যায়। বিনোদিনী নাচ গান ও অভিনয় করে অসংখ্য মানুষকে আনন্দ দিয়েছেন। কিন্তু তার জীবন কেটেছে দুঃখে দুঃখে। বিনোদিনী ইচ্ছা করে পতিতা হননি। তৎকালীন সমাজ তাকে পতিতা হতে বাধ্য করেছে। মাদার তেরেসাকে আমরা সম্মান করি। তিনি অনেক করেছেন। তাহলে আমরা কেন বিনোদিনীকে শ্রদ্ধা ভরে স্মরন করবো না? বিনোদিনী মসজিদ, মাদ্রাসা, মন্দিরের জন্য সব মুক্ত হস্তে দান করেছেন। অসংখ্য দরিদ্র ও অসহায় মানুষকে সাহায্য সহযোগিতা করেছেন।

তথ্যসুত্রঃ
আমার কথা, বিনোদিনী দাসী, ১৩২০, কলকাতা।
বিনোদিনী সমগ্র, সম্পাদনা- বুলবুল চৌধুরী, ২০০৮, সময়, ঢাকা।
বাংলা থিয়েটারের ইতিহাস, দর্শন চৌধুরী। পুস্তক বিপনী, কলকাতা।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে ডিসেম্বর, ২০২৩ রাত ১১:১৬
১৪টি মন্তব্য ১৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

গৃহবধূ থেকে প্রধানমন্ত্রী; অভিভাবক শূন্য হলো বাংলাদেশ |

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ৩০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:১২


খালেদা জিয়া। ইস্পাতসম বজ্রকঠিন দেশপ্রেমের নাম খালেদা জিয়া। যিনি ভালো বেসেছেন দেশকে, নিজের জীবনের চেয়েও দেশকে ভালো বেসেছেন। দেশের বাহিরে যার নেই কোন লুকানো সম্পদ। নেই বাড়ি, গাড়ি অথবা... ...বাকিটুকু পড়ুন

২০২৫ সালের সেরা মশকরা কোনটি

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ৩০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:১৪



ইয়ে মানে বছর শেষ। ২০২৫ সাল বিদায় নিচ্ছে । তা আপনার কাছে ২০২৫ সালের সেরা মশকরা কোনটি ?


আমার কাছে সেরা মশকরা হচ্ছে- এনসিপির জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতা করা।

আরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বেগম খালেদা জিয়াঃ এক দৃঢ়চেতা, সাহসী অধ্যায়ের সমাপ্তি

লিখেছেন সামহোয়্যারইন ব্লগ টিম, ৩০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১:৩৭



প্রিয় ব্লগার,
আমরা অত্যন্ত দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপার্সন এবং বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বেগম খালেদা জিয়া আর আমাদের মাঝে নেই, ইন্না লিল্লাহি ওয়া... ...বাকিটুকু পড়ুন

খালেদা জিয়ার মৃত্যু রাজনীতির মাঠে বিরাট শূন্যতা

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ৩০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:১৯

 
বাংলাদেশের রাজনীতিতে বেগম খালেদা জিয়া এক উল্লেখযোগ্য চরিত্র। সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের পর বিএনপির টালমাটাল পরিস্থিতিতে তিনি দলটির হাল ধরেন। সেনানিবাসে গড়ে উঠা দলটাকে রাজপথে বেড়ে উঠতে গৃহবধূ থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

খালেদা জিয়া মরিয়া প্রমাণ করিলেন , তিনি মরেন নাই ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ৩০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:৩৮


বেগম খালেদা জিয়া মারা গেছেন। এই খবরে জাতি শোকাহত। কিন্তু একদল মানুষ আছে যারা উনার মৃত্যুর পরেও নিজেদের রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক স্বার্থে তার মৃত্যু নিয়ে ঘৃণ্য মিথ্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে। বদনা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×