
১। মিনহাজের মাঃ
আমাদের বাসায় অনেক গুলো বুয়া।
আমার ঘরে কাজ করে মিনহাজের মা। মিনহাজের মায়ের সবচেয়ে ভালো দিক হচ্ছে সে প্রতিদিন কাজে আসে। অন্যান্য বুয়ারা মাসে কোনো না কোনো উছিলায় কমপক্ষে দশ দিন আসবে না। তবে মিনহাজের মা চার মাস পরপর গ্রামের বাড়ি যায়। তখন সে চার দিন আসে না। মিনহাজের বাবার নাম কাইয়ূম। সে গাড়ি চালায়। প্রায়'ই তার চাকরি চলে যায়। তখন সে আমাদের বাসায় নিচে বসে থাকে। লুকিয়ে লুকিয়ে সিগারেট খায়। মিনহাজের এক বোন আছে। বড় বোন। নাম তার শিখা। শিখা দেখতে যেন শরৎচন্দ্রের 'মহেশ' গল্পের আমিনা। কালো হলেও চেহারাটা ভীষন মায়ামায়া।
২। মিনহাজঃ মিনহাজের বয়স ৪/৫ বছর হবে।
সে অতি কুৎসিত কিছু গালি জানে। সবচেয়ে ভালো ও ভদ্র গালি সে দেয়, সেটা হচ্ছে- খানকী মাগী। মিনহাজ রেগে গেলে সে তার মা ও বড় বোন শিখাকেও এই গালি দেয়। আমি তাকে ভালো করে বুঝিয়েছি, যেন সে আর এই গালি না দেয়। কিন্তু কাজ হয়নি। এরপর আমি তাকে নানান রকম ভয় ভীতি দেখিয়েছি। তারপরও মিনহাজ গালি দিয়েছে। নেশা যেমন রক্তের সাথে মিশে যায়, গালি মিনহাজের রক্তের সাথে মিশে গেছে। দুঃখজনক কথা হচ্ছে মিনহাজের মা এবং বোন মেনে নিয়েছে। ছোট বাচ্চা গালি দিবেই। মিনহাজের বন্ধুরাও এরকম গালি দেয়। মিনহাজের মাকে বললাম, আপনার ছেলে এই অল্প বয়সে এত ভয়াবহ গালি শিখলো কি করে? সারাদিন রাস্তায় রস্তায় থাকে। সেখান থেকে শিকছে। সমস্যা নাই, বড় হলে ঠিক হয়ে যাবে।
৩। মিনহাজের বোন শিখাঃ
শিখার বয়স ৭/৮ বছর। গত বছর শিখা মাদ্রাসায় ভরতি হয়েছে। এখন সে বাধ্যতামূলক হিজাব পরে। আমি শিখার মাকে খুব করে বললাম, মাদ্রাসায় দিও না। স্কুলে দাও। মাদ্রাসার লেখাপড়া দিয়ে চাকরি পাওয়া যাবে না। ছেলে হলে না হয় মসজিদে আযান দিতে পারতো, কেউ মারা গেলে কোরআন খতম দিতে পারতো। দোকান উদ্ববোধন করলে মানুষ মিলাদ দেয়, মিলাদ থেকেও ভালো ইনকাম হয়। শিখা কি কোরআন হাদীস পড়ে চাকরী পাবে? শিখার মা বলল, ভাইজান, কোরআন হাদীস'ই জীবনের সব। ইহকাল পরকাল কোরআন হাদীস ছাড়া অন্ধকার। মাইয়া মানুষ বিয়া দিয়া দিমু ঝামেলা শেষ। আমার দায়িত্ব কোরআন হাদীস শেখানো। নইলে আমার মৃত্যুর পর আল্লাহরে কি জবাব দেবো! গরীবেরা আল্লাহকে অনেক ভয় পায়।
৪। মিনহাজের বাবাঃ
কাইয়ূম সারাদিন গাড়ি চালায়। ঢাকা শহরের রাস্তাঘাট সে ভালো করে চিনে না। গাড়ির মালিক তাকে সারাক্ষন বকাঝকা করে। কাইয়ূম কে দিয়ে গাড়ি চালানো ছাড়াও আরো অনেক কাজ করায়। বাজার করায়, লণ্ড্রীতে কাপড় আনা নেওয়া করায়। পানি, বিদ্যুৎ আর গ্যাস বিল দেওয়ায়। দুপুরে খাবার দেয় না। খাবার খেতে বাসায়ও যেতে দেয় না। তবে সেলারি মাস শেষে সঠিক সময়ে দেয়। শুক্রবার কাইয়ূমের ডে অফ। সেদিন সে মিনহাজকে নিয়ে কমলাপুর যায়। মিনহাজ ট্রেন খুব পছন্দ করে। আর পছন্দ করে চিপস। অবশ্য আজকাল কাইয়ূম শুক্রবারও সময় পায় না। কারন, শুক্রবার তার ডিউটি করতে হয়। ওভার টাইম তাকে দেয় না। একবার সে ওভারটাইম চেয়েছিলো বলে, তার মালিক তাকে লাথথি দিয়েছে। গাড়ির মালিকের চেয়ে, মালিকের স্ত্রী আরও ডেঞ্জারাস। মালিকের স্ত্রী বলে, এখন থেকে তোমার ডিউটি শুরু হবে ভোর সাড়ে পাচ টা থেকে। কারন, ডাক্তার আমাকে ভোরবেলা হাটাহাটি করতে বলেছে। আমি রমনা পার্কে গিয়ে হাটবো। মিনহাজের বাবা মনে মনে বলে, তুই হেটেই চলে যা রমনা পার্ক।
এবার আসল ঘটনায় আসিঃ
মিনহাজের মার জীবনে একটাই স্বপ্ন। সে তার স্বামীকে বিদেশ পাঠাবে। এজন্য সে সারাদিন মানুষের বাড়ি বাড়ি কাজ করে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত। বছরের পর বছর। মিনহাজের মার জীবনের স্বপ্নটা সত্যি করেছে। সে টাকা জমিয়ে তার স্বামী কাইয়ূমকে সৌদি পাঠিয়েছে। সৌদি গিয়ে কাইয়ূম এখন গাড়ি চালাচ্ছে। প্রথম মাসের বেতন পেয়ে সে ২৫ হাজার টাকা পাঠিয়েছে। পাচ বছর পর কাইয়ূম ঢাকা ফিরবে। ছেলেমেয়ে আর স্ত্রী রেখে কাইয়ূম সৌদি। কাইয়ূমের স্বপ্ন সে জমি কিনবে। জমিতে বাড়ি করবে। একটা পুকুর কাটাবে। পুকুরের ঘাট সিমেন্ট দিয়ে বাঁধাই করবে। কিছু ফসলী জমি কিনবে। মানুষ স্বপ্ন যেরকম দেখে, সেটা আসলে সব সময় সত্যি হয় না। কাইয়ূম এখন সৌদির মালাজ কারাগারে। তার অপরাধ তার গাড়িতে মদ পাওয়া গেছে। কাইয়ূম মদ খায় না। মদ খায় গাড়ির মালিক। অথচ অন্যায় না করেও সে জেলে। এদিকে ঢাকায় মিনহাজের মা কান্না করছে। আর নামাজ পড়ছে।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই জানুয়ারি, ২০২৪ বিকাল ৫:৪১

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



