গতকাল মা আমাকে মার্কেটে নিয়ে গেছে।
বলল, তোমার যা যা মন চায় কিনো। সাধারণত মায়ের সাথে আমার বাইরে যাওয়া হয় না। সবচেয়ে বড় কথা মায়ের সাথে আমার বনিবনা হয় না। মায়ের সাথে সবচেয়ে বেশি খাতির আমার ছোট ভাইয়ের। প্রায়ই ছোট ভাই মাকে নিয়ে মার্কেটে যায়। রেস্টুরেন্টে যায়। ডাক্তারের কাছে যায়। মায়ের সাথে শেষ কবে আমি ডাক্তার বা হাসপাতালে গেছি আমার মনে নেই। ছোটবেলা হয়তো মায়ের সাথে মার্কেটে গেছি। সেসব আজ আর মনে নেই। সেদিন মা নিজ থেকেই বলল, চল মার্কেটে যাই। যা যা কিনবে কিনে দিবো। জ্যাকপট!
গাড়ি গ্যারেজে। ডেন্টিং পেন্টিং করছে।
রিকশা করে গেলাম। মা আগেই বলে দিয়েছে ঢাকা শহরের সবচেয়ে বড় মার্কেটে চল। আমি বললাম, পর্যাপ্ত টাকা নিয়েছো? মা বলল, টাকা নিয়ে তোমার ভাবার দরকার নাই। প্রচুর ক্যাশ আছে। ক্যাশ শেষ হয়ে গেলে, কার্ড আছে। আমি বললাম, মা হঠাত আমাকে কেনাকাটা করে দিতে চাচ্ছো কেন? মা চুপ। আমি আর কিছু জানতে চাইলাম না। মা বেশি হাঁটতে পারে না। তবু আমার সাথে বেশ কয়েকটা মার্কেট ঘুরলো। একটুও বিরক্ত হলো না। বরং নিজে থেকেই বলল, চল এলিফ্যান্ট রোড যাই। সেখানে অনেক জুতোর দোকান আছে। বললাম, রাস্তায় ভয়াবহ জ্যাম। এত দূরে যাবো না।
কিনবো না, কিনবো না- করেও অনেক কিছুই কিনে ফেললাম।
কমদামী জিনিসপত্র মা পছন্দ করে না। ছোট দোকান থেকে কেনাকাটাও মা পছন্দ করে না। আমি দুটো জুতো কিনে নিলাম এপেক্স থেকে। সাড়ে সাত হাজার টাকা দিয়ে। মা বলল, তোমার মেয়ের জন্য কিছু নিয়ে নাও। আমি বললাম, ফারাজার ইদের কেনাকাটা শেষ। মা বলল, তবু কিছু কিনে নাও। ফারাজার জন্য জামা জুতো কিনে নিলাম। যাইহোক, মা জানে আমি রোজা রাখি না। বলল, দুপুর পার হয়ে যাচ্ছে- তুমি কিছু খেয়ে নাও। আমি লক্ষ্মী ছেলের মতো কোক আর বার্গার খেয়ে নিলাম। ঝামেলা বিহীন খাবার।
আমার নানা নানী ধনী মানুষ ছিলেন।
মা তার জন্মের পর থেকেই গাড়ী, বাড়ি, উন্নত জীবনযাপন সবই পেয়েছে। মাকে কোনো কিছুতেই নানা নানী বাঁধা দেয় নাই। আমার মা সিনেমা দেখতে খুব পছন্দ করতো। সেই সময়ের কোনো সিনেমা বাদ নেই, যা মা দেখে নাই। আমার মা দেখতে নায়িকা ববিতার মতো। কিন্তু এখন মা অসুস্থ। তার অনেক অসুখ। গত ত্রিশ বছর ধরেই মা ওষুধ খাচ্ছে। মায়ের কাছে শুনেছি, মা স্কুলে যখন পড়তো- তখন স্কুল থেকে পিকনিকে যেতো গুলশান। সেখানে নাকি অনেক গাছপালা আছে। আমরা চার ভাই ছাড়া দুনিয়াতে মার আর কেউ নেই। আব্বা তো করোনা'তে চলে গেল!
আমার মায়ের একটা ঘটনা বলি-
তখন আমার দেড় বছর বয়স। ঠিক করে হাঁটতে পারি না। আমাদের এলাকা থেকে কিছু দূরে আগুন লেগেছে। আমাদের বাসা থেকেই আগুনের ধোয়া দেখা যাচ্ছে। উঠানে আমার নানা নানী বসে আছেন। আমার মা দৌড়ে এসে আমাকে কোলে নিয়ে দূরে চলে যায়। আগুন পুরোপুরি নিভে যাওয়ার পর, মা আমাকে নিয়ে বাসায় আসে। তখন নানা নানী বললেন, পুষ্প নিজের ছেলেকে নিয়ে দৌড়ে পালিয়ে গেলি। নিজের বুড়ো বাবা মায়ের কথা একবার ভাবলি না? মা বলল, আমার কাছে সবার আগে আমার ছেলে। আমিই সেই কুলাঙ্গার ছেলে। কুলাঙ্গার বলেই হয়তো মা আমাকে বেশি ভালোবাসে।
মা এখন সারাদিন টিভি দেখে।
মার ঘরে বিশাল এক টিভি। ইউটিউবে পুরোনো দিনের সাদা কালো সিনেমা গুলো দেখে। পুরোনো দিনের গান শুনে। টিভি দেখতে দেখতে বিরক্ত হয়ে গেলে, মোবাইলে গেমস খেলে। অথবা ফেসবুকিং করে। মা নীচ তলায় একা থাকে। আমি ছয় তলায় থাকি। সিড়ি ভেঙ্গে মা আমাদের সাথে গিয়ে দেখা করতে পারে না। সিড়ি দিয়ে উঠা নামা করলেই মায়ের পা ফুলে যায়। এজন্য আমরা বাইরে থেকে বাসায় গিয়েই আগে মায়ের সাথে দেখা করি। গল্প করি। তারপর নিজের ঘরে যাই। মা গল্প করতে পছন্দ করে। মা প্রতিটা গল্প হাজার বার করে আমাদের শোনা হয়ে গেছে।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ২:৪১