দেশের বড় বিচক্ষণ-সচেতন-বিদগ্ধ-জনদরদী পত্রিকা সেটা। মানুষের ব্যক্তিগত আচরণ পরিবর্তন করে পত্রিকাটা সমাজ পরিবর্তনের ত্যাড়া আওয়াজ দেয়। ঝড়-বন্যা দুর্গতদের পাশে তাদের হরহামেশাই দেখা যায়, এসিড ঝলসিত নারী হলে তো কথাই নেই পাশে পাওয়া যাবেই যাবে। আরও পাওয়া যাবে ক্ষমতাসীন দলের পাশে, বহুজাতিক কোম্পানির পাশে। দালাল বেশে। পদলেহী বেশে। আততায়ী বেশে ঘাপটি মেরে। এরই একটি নমুনা আমাদের হাতে পাওয়া গেছে-সমুদ্রের তেল-গ্যাস ক্ষেত্র ইজারা নিয়ে:
প্রথমেই একটি বিষয় খোলাসা করা যাক। গত ৮ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী সমুদ্রের ৩টি তেল-গ্যাস ব্লক বিদেশী কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দিলেন (৯ সেপ্টেম্বর, যুগান্তর)। আমাদের জননন্দিত, জনপ্রিয় এই পত্রিকা প্রথম আলো বেমালুম চেপে গেল ব্যাপারটা। এ বিষয়ে টু শব্দ পর্যন্ত করল না তারা। দেশের সাধারণ মানুষকে নিয়ে চিন্তিত প্রথম আলো তার নিজের মুখে ঘোমটা টেনে জানান দিল জনগণের সম্পদ বিকিয়ে দিতে তাদের আপত্তি নেই। মুখে ঘোমটা টেনে বলাৎকারেও তাদের আপত্তি থাকার কথা না।
২ সেপ্টেম্বর তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি আয়োজিত মিছিলে পুলিশের হামলা হয়। রাস্তায় আনু মুহাম্মদকে লাঠি, লাথি মেরে তার দুই পা ভেঙে গুড়িয়ে দেয় সরকারি মাস্তান পুলিশ বাহিনী। অথচ দেশের সম্পদ রক্ষার আন্দোলনে ফুলবাড়ি থেকে ঢাকা সবখানেই আনু মুহাম্মদ আজীবন একনিষ্ঠ, একগুঁয়ে। তারপরেও শুধুমাত্র তার ওপর হামলার প্রতিবাদে ১৪ সেপ্টেম্বর আধাবেলা হরতাল ডাকা হয়নি-ডাকা হয়েছে দেশের সম্পদ রক্ষার জন্য। মানুষের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বাঁচানোর জন্য।
পিএসসি ২০০৮ ঘাঁটাঘাঁটি করলেই একজন আকাট মুর্খের কাছেও পরিস্কার হবে কার স্বার্থে এই চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে, দেশের সাধারণ মানুষ নাকি গুটিকতক আমলা-মন্ত্রী-চ্যালা ও বিদেশী কোম্পানির স্বার্থ রক্ষায়? পেট্রোবাংলার ওয়েবসাইটে এই চুক্তির উল্লেখ আছে। আমাদের সেই পত্রিকার সাংবাদিকরা নিশ্চয় দেখে-বুঝে-শুনে নিজেদের অবস্থান নিয়েছেন দালালির, মোসাহেবির।
সেই প্রধান জাতীয় দৈনিকই ১২ সেপ্টেম্বর সম্পাদকীয় মন্তব্যে জানাচ্ছে, ‘রাজধানীতে আধাবেলা হরতাল নিয়ে জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে’। এখন কথা হলো, তারা জনগণের এই মতামত পেল কিসের ভিত্তিতে? আমরা যতদূর জানি, ইন্টারনেটের মাধ্যমে দেশের গুটিকয় মেদওলা-গোলগাল চেহারার মধ্যবিত্তের মতামতের ভিত্তিতে তারা এটা প্রকাশ করেছেন। দোহাই পাড়া হয়েছে সাধারণ জনগণের। বোঝাই যাচ্ছে, ধোঁকাবাজি, জালিয়াতি আর চ্যালাগিরিতে তাদের অবস্থান আসমানের ওপর।
পত্রিকাটি এও জানাচ্ছে ‘মনে রাখতে হবে, হরতালের প্রথম আঘাত আসে শ্রমজীবী মানুষের ওপর।’ অথচ দেশের ১০০ ভাগ তেল-গ্যাস রপ্তানীর নামে পাচার হয়ে যাচ্ছে যার পুরোটাই শ্রমজীবী মানুষের মালিকানাধীন। পত্রিকাটির ভাষ্যমতে এটা দাঁড়ায় যে, আঘাতটা সাময়িক হলেই সমস্যা, দীর্ঘস্থায়ী হলে ক্ষতি নেই। ঈদের আগে ‘জনগণের ভোগান্তি বাড়বে এমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণযোগ্য নয়’। গ্যাস পাচারের মাধ্যমে জনগণের দীর্ঘস্থায়ী ভোগান্তিতে তাদের আপত্তি নেই। সরকারি, বহুজাতিক লুটপাট, লুণ্ঠনে তাদের আপত্তি নেই।
তাদের ঔচিত্যবোধেরও বেশ দাম দিতে হয়, ‘আন্দোলনে সাফল্য অর্জনের স্বার্থেই হরতালের মতো আত্মবিনাশি কর্মসূচি পরিহার করা উচিত।’ আমরা জানি, রাস্তার রাজনীতির মহান রাজনৈতিক ভাষা হরতাল। জনগণের অধিকার আদায়ের অস্ত্র হরতাল। জনগণের মালিকানাধীন সম্পদ রক্ষায় হরতাল। বুর্জোয়া দলগুলোর মতো নিজেদের স্বার্থ হাসিলের, লুটপাটের ভাগ না পাওয়ার বঞ্চনায় এই হরতাল না। ‘আত্মবিনাশি’ না, দেশের অর্থনীতি-বিকাশি এই হরতাল।
সমুদ্রের গ্যাসক্ষেত্র ইজারা দেওয়ার জন্য মডেল পিএসসি মডেল সম্পন্ন করেছে। এবং এই চুক্তি সম্পর্কে সরকার কোথাও কোনো আলোচনা উত্থাপন করেনি। এমনকি সংসদেও না। একেবারেই চুপচাপ নি:শব্দে আড়ালে কারও কোনো তোয়াক্কা না করে এই চুক্তি হয়ে গেল প্রথম আলোর মতো প্রধান গণমাধ্যমগুলোকে কাজে লাগিয়ে। তাহলে সরকার এই বিপুল সম্পদের বিক্রি করার সিদ্ধান্ত-সম্মতি কোথায় পেল? কিছু দিন আগে দেশের বিভিন্ন টিভি ও পত্রিকাগুলোয় স্থানীয় সরকার মন্ত্রীর একটি কথা পাওয়া গেল। ‘৫০ বছর গ্যাস মজুদ রাখার কথা বলার কারণে আওয়ামী লীগ ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসতে পারেনি।’ গ্যাস মজুদ রাখার নীতির কারণে তো মানুষ খুশি হয়ে তার দলকে বেশি বেশি ভোট দেওয়ার কথা ছিল, তার দলের জেতার কথা ছিল। আওয়ামী লীগ গ্যাস মজুদনীতি থেকে সরে আসল কার স্বার্থে কোন স্বার্থে? তাহলে কি দেশের রাজনীতির কলকাঠি অন্য কোথাও নাড়া হচ্ছে? মেরুদণ্ডহীন রাজনীতির পক্ষে ক্ষমতামাতাল হয়ে মুনাফাখোর বিদেশীদের হাতে দেশ বিক্রির পাঁয়তারা আমাদের সামনে পরিস্কার হচ্ছে ধীরে ধীরে। এভাবেই আমরা জানতে পারি। চুক্তি একটা হয়ে যাবার পর।
গণতন্ত্রের দেশে ‘সকলের’ মত প্রকাশের অধিকার আছে। ‘সকলের’ শব্দটাকে উর্দ্ধ কমা দিয়ে ঘিরে দেয়া হয়েছে খুব যথোচিত কারণেই। আমাদের বুঝতে যদি ভুল না হয় তাহলে সকল বলতে বোঝাবে: কৃষক--হতে পারে দূর কোনো আলোহীন গ্রামে তার বাড়ি, অথবা শহুরে মুটে-মজুর-শ্রমিক-হকার-বুদ্ধিজীবী-গণমাধ্যম-লেখক-শিল্পী-কবি-সাংবাদিক-ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-চা বিক্রেতা-মুদি দোকানি-এফবিসিসিআই-ব্যবসায়ী-উকিল ইত্যাদি এবং সর্বোপরি সরকারকেও বোঝাবে। মজার বিষয়টা হলো, বহুপেশাজীবী এই মানুষগুলোর মধ্যে মিল--তারা সবাই মত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে। কিন্তু কিছু লোকের প্রকাশ হয়, অধিকাংশের হয় না। প্রকাশ না হওয়ার দলটাই ভারি। এফবিসিসিআই তাদের মত প্রকাশ করেছে, তাদের সংখ্যা কত? কিন্তু ঐ কৃষকের কী উপায়?
এখন, সরকার, গণমাধ্যম, বুদ্ধিজীবী বা এই গোছের যারা তাদের সকলেরই নিজ নিজ মত প্রকাশের প্লাটফর্ম রয়েছে। একটু সহজ যোগ-বিয়োগের অঙ্ক কষলেই বেরিয়ে আসবে সেই প্লাটফর্ম নেই কাদের। লুণ্ঠন করে যারা তাদের নাকি শতবর্ষব্যাপী লুণ্ঠতের শিকার তাদের? তবে এর মধ্যেই সাধারণ মানুষের একটি মঞ্চ হয়েছে তেল-গ্যাস রক্ষা জাতীয় কমিটি। এই কমিটির আহ্বানেই সোমবারের হরতাল।