জীবনের প্রথম কিছু অভিজ্ঞতা। প্রথম অর্জন, সেটা আনন্দেরই হোক আর বেদনারই হোক, প্রথম সন্তানের মতোই। অন্তত আমার কাছে।
আমি এক গোত্রছাড়া কবি। কখনো কখনো গল্পকার, নাট্যকার কিংবা অন্যকিছু। তবে গোত্রছাড়া হলেও মাত্রাছাড়া নই। লেখায় কিছু ছন্দ, কিছু মাত্রা, কিছু উপমা-উৎপ্রেক্ষার কারিশমা সব সময়ই থাকে। এটা গর্বভরেই বলি। কারণ, পড়ালেখাটা বাংলা সাহিত্যেই। তা হলে কি হবে! জগন্নাথ থেকে তো! বন্ধু-বান্ধবদের ভাষায়-জগাবাবুর পাঠশালা';ওখানে আবার কি শেখায়?
কিছুই শেখায় কি না জানি না। তবে আমি শিখেছি। আমার ক্যারিয়ারে আমি ভাল কিছু শিক্ষক পেয়েছিলাম। তাদের মধ্যে রতন সিদ্দিকী একজন। বাংলা সাহিত্যের বহুজান্তা। জগাবাবুর পাঠশালয়(!)আমি তাকে পেয়েছিলাম। পেয়েছিলাম তার জ্ঞান-ভাণ্ডারের বেশ কিছু ধন-রত্মও। তাই কিছুটা গর্ব করার সাহস পাই অন্তত। যাই হোক, বর্তমানে আমার একটা পরিচিতি দাঁড়িয়েছে (গর্ব করার জন্য বলছি না, শ্রেফ লেখার প্রয়োজনে আমার পরিচিতিটা কিছুটা জাহির করা প্রয়োজন হয়ে দাঁড়ালো)- আমি বেতার এবং টেলিভিশন নাট্যকার হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছি। প্রায় ৩০টির মতো বেতার নাটক এবং ১৩টির মতো টিভি নাটক অনএয়ার হয়েছে। হাতে আছে বেশ কয়েকটি ঈদের নাটক, ধারাবাহিক এবং একটি মেগা-সিরিয়ালের কাজ। পত্র-পত্রিকায় মাঝে-মাঝেই লেখা-টেখা আসছে। কাব্য রচনাতেও হাত পাকিয়েছি। এ পর্যন্ত প্রায় দুশো কবিতা সম্বলিত ১০-১২টা ডায়েরী ভরে উঠেছে লেখায়। আগামী ২১-এর বই মেলায় একটি কাব্যগ্রন্থ, একটি উপন্যাস এবং একটি শিশুতোষ গ্রন্থ রচনার প্রস্তুতিও এগিয়ে চলেছে সমানতালে। প্রকাশকরা প্রায়ই তাগাদা দিচ্ছেন। সাংবাদিকতায়ও মোটামুটি সফলতার দিকে এগিয়ে চলেছি। একটি অনলাইন সংবাদ সংস্থা ও অনলাইন সংবাদপত্রের বিনোদন বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। মোদ্দাকথা, লেখক হিসেবে এখনকার পরিচিতিটা একেবারে ফেলনা নয়।
ভাবতে ভালই লাগে হাঁটি-হাঁটি পা করে আমার মৃদু-উত্থানের কথা। আবার তিক্ততায় ভরে ওঠে মন, যখন মনে পড়ে ক্যারিয়ারের শুরু দিককার কথা। প্রতিভার মূল্যায়ন করতে আসলে আমরা কতোটুকু উদার?
প্রিয় পাঠক বন্ধু, কিছু অভিজ্ঞতার কথা বলি। আমার ধারণা এমন অভিজ্ঞতা অল্প-বিস্তর অনেকেরই থাকে। তবে আমারগুলো ব্যতিক্রম। একটু ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়ে নতুন এই বন্ধুটির লেখাটা পড়েই দেখুন, অভিজ্ঞতাগুলো ব্যতিক্রম মনে হয় কিনা।
১.
সুদূর পাবনা জেলার এক মফস্বল শহরের ছেলে আমি। চলনবিল বিধৌত এলাকার সন্তান হওয়ায় চলনবিলের মতেই প্রসারতা ছিল মনের। জানার আগ্রহ যেমন ছিল বেশি, তেমন সৃষ্টির নেশাও ছিল অদম্য। ছোটবেলা থেকেই আমি খুব বেতার শুনতাম। বাংলাদশে বেতার। বিশেষ করে বেতারের নাটকগুলো আমাকে খুব তাড়িত করতো। মুগ্ধ হয়ে শুনতাম আর ভাবতাম আমিও লিখবো। লিখতে হলে প্রচুর পড়তে হয়। কথাটি আমাকে বলেছিলেন পাবনার কবি ওমর আলী। '৯৮-এর বাংলা একাডেমীর একুশে বইমেলায় যখন আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় তখন মুখবন্ধ লিখতে গিয়ে তিনি কথাটি লিখেছিলেন। তখন থেকেই প্রচুর পড়তাম, নানা ধরণের বই। গল্প, কবিতা, উপন্যাস, ইতিহাস, ভূগোল, সাধারণ জ্ঞান, মনোবিজ্ঞান আরো কতো কি!
যাই হোক, কয়েকটি বেতার নাটক লিখেই ফেললাম। অনেক যন্ত নিয়ে, প্রচুর পড়ার অভিজ্ঞতা মিশিয়ে, মনের মাধুরী যুক্ত করে। পাশাপাশি চলতে থাকলো নতুন নতুন কবিতা লেখার চর্চা।
ওই বছরই চলে এলাম ঢাকায়। অনেক স্বপ্ন নিয়ে। কবি হবো, নাট্যকার হবো, দেশজোড়া মানুষ আমাকে চিনবে- এমনই দুঃসাহসিক কিছু স্বপ্নের ভেলায় ভেসেই তিলোত্তমা নগরীতে আসা। একটা রেফারেন্স নিয়ে এসেছিলাম এলাকা থেকে। বেতারের একজন সিনিয়র প্রযোজক (নাম বলে তাকে খাটো করতে চাই না)-এর কাছে তিনি তারই এক বন্ধু চিঠি লিখে আমাকে পাঠিয়েছিলেন। একটি নাটক এবং চিঠিসহ অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে তার সঙ্গে দেখা করলাম। চিঠিটি পড়ে মনে হলো তিনি কিছুটা স্মৃতিকাতর হলেন। তারপর আমার উদ্দেশ্যে বললেন, কৈ কি এনেছো দেখাও। আমি অনেক আগ্রহ নিয়ে তার হাতে নাটকটি তুলে দিলাম। পাণ্ডুলিপিতে আধখানি নজর বুলিয়ে উনি বললেন, হাতের লেখাতো মুটামুটি ভালই। ঠিক আছে রেখো যাও, সময় সুযোগ মতো দেখবো। রেখে এলাম। মনে অনেক আশা, পাণ্ডুলিপিটির একটা গতি হয়তো হবে। দেখা যাক।
পরদিন গেলাম তৎকালীন দৈনিক বাংলার বাণী পত্রিকা অফিসে। ইচ্ছে, সাহিত্য পাতার জন্য কিছু কবিতা জমা দেওয়া। খ্যাতিমান (বর্তমানে প্রয়াত) একজন কবি তখন সেই পত্রিকার সাহিত্য পাতা দেখেন। কাব্য-সাহিত্যের সমঝোদার বলে তার একটা খ্যাতি ছিল। তার কাছে যেতেই বললেন, বাড়ি কোথায়, কবিতা বোঝ কিনা, কবিতার সংজ্ঞা বলো, বিশ্বের কয়েকজন বিখ্যাত কবির নাম ও তাদের কবিতার কয়েকটি চরণ বলো। মনে হলো আমি তার সহকারি সম্পাদকের পদটার জন্য ইন্টারভিউ দিতে এসেছি। যাই হোক, সাহিত্য নিয়ে নাড়াচাড়া ছিল বলেই সে যাত্রা উৎরে যেতে পেরেছিলাম। অগত্যা তিনি কয়েকটি কবিতা নিলেন এবং না দেখেই ড্রয়ারে গুঁজে রাখলেন, বললেন, আগামী সপ্তাহে এসো। এখানেও কিঞ্চিত আশার আলোর ঝলকানি। কিছু একটা হবে হয়তো।
প্রিয় পাঠক হয়েছিলো। কিন্তু কি হয়েছিলো শুনলে আপনি যতোটা হতোবাক হবেন, আমার ধারণা, এমন বিচিত্র এবং বাস্তব অভিজ্ঞতার সম্মুখীন আপনি কখনো হননি।
আমার সৌভাগ্য কিংবা দূর্ভাগ্য যে, আমিই পৃথিবীতে একমাত্র ব্যক্তি, যার এমন কিছু অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার রয়েছে যা, অন্য কারো নেই- একথা আমি হলফ করে বলতে পারি।
কি বিশ্বাস হচ্ছে না? তাহলে কষ্ট করে আগামী দিন আমার লেখার বাকী অংশটা পড়ুন, তারপর মূল্যায়ন করুন, আমি ঠিক বলেছি কিনা। আর আমার বেতার নাটক এবং কবিতা ক'টির কি গতি হয়েছিল যদি তা কেউ আন্দাজ করে আমাকে ঠিক ঠিক বলতে পারেন, তবে আমি আপনার সারাজীবনের বন্ধু হয়ে রইবো, কথা দিলাম। একবার চেষ্টা করবেন কি?
(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জুলাই, ২০০৯ রাত ১০:৩৯

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




