আমার দূর্ভাগ্যই বলতে হবে, আমার লেখার প্রথম অংশটি সম্পর্কে কেউ কোন মন্তব্য করেননি এবং যেখানে আমি আমার অভিজ্ঞতার কথা লিখা শেষ করেছিলাম, সে সম্পর্কেও কেউ কোন মন্তব্য করেননি। সুতরাং ধরে নিতেই হবে, আমার লেখাটি কোন লেখাই হয়নি। তারপরও লেখাটি আমি শেষ করবো। এ বিষয়ে আমার ধৈর্যের কোন কমতি নেই। কমতি থাকলে এই পর্যন্ত আসা আমার পক্ষে সম্ভবই হতো না।
তো অভিজ্ঞতার কথাটি শেষ করি।
প্রায় এক সপ্তাহের বিরতিতে আমি গেলাম বেতারে সেই প্রযোজকের কাছে। আমাকে দেখলেন, চিনলেন না। মনে করিয়ে দিলাম। মনে করার ভান করলেন। নাটকের পাণ্ডুলিপিটি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। বললেন, এতো ব্যস্ততা যে, ওটার কথাও তার মনে নেই। অগত্যা স্ক্রিপ্ট বের করে চোখ বুলাতে লাগলেন এবং লাল কালিতে আন্ডারলাইন করতে থাকলেন। তারপর স্ক্রিপ্টটি আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, মফস্বল থেকে এসেছো তাই, তাই লেখার মধ্যেও মফস্বলের গন্ধ রয়ে গেছে। ওটা ঝেড়ে ফেলতে হবে। খারাপ লাগলো কথাটা শুনে। মনে মনে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ব্যাটা, তুই কি লন্ডন থেকে এসেছিস নাকি?' কিন্তু মুখে সলজ্জ হাসিটা ধরেই রাখলাম। হাসিটা স্বীকারোক্তিমূলক। সত্যিই তো মফস্বল শহর থেকে সদ্য এসেছি। যাই হোক, উনি যে দয়াপরবশ হয়ে আমার স্ক্রিপ্টটি লালকালিতে দাগিয়েছেন, তাতেই আমি ধন্য। বললেন, কারেকশন করে নিয়ে আসুন। তারপর দেখবো। মনে মনে ভাবলাম, যে পরিমাণ লাল কালি লাগিয়েছিস বাবা, তাতে কারেকশন করার কোন উপায় নেই। পুরো স্ক্রিপ্টটা আবার নতুন করে লিখতে হবে। কি আর করা। আবারও সাতদিন সময় নিয়ে স্ক্রিপ্টটা কেটেকুটে নতুন করে লিখলাম। তারপর আবার গেলাম। এবারও উনি লাল কালিতে দাগালেন, তবে আধাআধি। আবার নিয়ে এলাম। ঠিকঠাক করে আবার গেলাম। এবারও উনি কাটাকাটি করতে দ্বিধা করলেন না। বললেন, আমার ডিরেকশন মতো না লিখলে আপনার নাট্যকার হতে অনেক সময় লাগবে। তৃতীয়বার দীর্ঘ সময় নিলাম। প্রায় একমাস। তবে ক্রিপ্ট-এ আর হাত দিলাম না। বরং আমার প্রথম স্ক্রিপ্টটা, যেটি নিয়ে আমি প্রযোজক মহোদয়ের কাছে প্রথম গিয়েছিলাম, হুবহু সেই ক্রিপ্টটি নিয়েই আমি উনার কাছে গেলাম দীর্ঘ একমাস পর। গিয়েই ইনিয়ে-বিনিয়ে বললাম, ভাইজান, আপানর সাজেশান আমার খুব কাজে লেগেছে। আপনার পরামর্শমতো দীঘ এক মাস সময় নিয়ে প্রাণান্ত পরিশ্রম করে ক্রিপ্টটি নতুন করে সাইজ করেছি। আপনার পরামর্শ না নিলে এটা সম্ভবই হতো না। এবার দেখুন হয়েছে কিনা। মজার ব্যাপার হলো, এবার উনি স্ক্রিপ্টটা যত্ম করে উল্টিয়ে উল্টিয়ে দেখলেন এবং ভূয়সী প্রশংসা করে বললেন, বাহ, বাহ! দারুণ সংলাপ। ঘটনারও ধারাবাহিকতা চমৎকার। খুব সুন্দর একটা নাটক হয়েছে। তারপর উনি পাণ্ডুলিপির ওপর লিখে দিলেন, নাটকটি প্রচারোপযোগী হয়েছে, প্রচার করা যেতে পারে'।
প্রিয় পাঠক, হাঁসছেন? আর আমার কান্না পাচ্ছে এই ভেবে যে, বেচারা প্রযোজক মহোদয় তবে কেন শুধু শুধু আমাকে প্রায় দু,মাস ঘোরালেন? কর্তব্যক্তিদের আচরণ বোধ করি এমনই হয়ে থাকে।
পাঠক, এবার আসি বাংলার বাণী পত্রিকায় কবিতা প্রকাশের ঘটনায়। কবিতা তো দিয়ে এলাম। কি হলো না হলো জানতে গেলাম ৭ দিন পর। সাহিত্য সম্পাদক মহোদয় কবিতাগুলো ড্রয়ার হাতড়ে অনেক কাগজ-পত্রের নীচ থেকে বের করলেন। তারপর একই কথার পুনরাবৃত্তি করলেন, আপনাদের কবিতায় কোন কাব্যময়তা নেই। কোন উপমা নেই, উৎপ্রেক্ষা নেই। শব্দ চয়নও সেকেলে। আধুনিক কবিতা পড়ুন, তারপর লিখুন, যান।
ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ফিরে এলাম। লাগলাম আধুনিক কবিতার পেছনে। ওই পত্রিকার বেশ ক'মাসের সাহিত্য সাময়িকী যোগাড় করে পড়লাম। তারপর সেই অনুযায়ী লিখলাম। নিয়ে গেলাম। এবার তিনি বললেন, চেষ্টা করেছেন বোঝা যাচ্ছে, তবে হয়নি। এতো সরল বর্ণনায় কবিতা হয়না। কিছুটা প্রচ্ছন্ন ব্যাপার থাকতে হয়। ফিরে প্রচ্ছন্ন ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে লাগলাম। কিন্তু কিছু কুল কিনারা পেলাম না। রাগ হলো খুব। কঠিন কঠিন শব্দ চয়ন করলেই কি শুধু কবিতা হয়। রেগে দিয়ে একটা কাজ করলাম। পত্রিকায় প্রকাশিত দশ-বারোটা কবিতার প্রতিটি শব্দ কাঁচি দিয়ে কেটে আলাদা করলাম। কয়েকশত শব্দ হলো। এবার এলোমেলোভাবে শব্দ নিয়ে পাশাপাশি সাজাতে লাগলাম। এভাবে অর্থহীন কয়েকটি লাইন বানালাম। মাত্র দুটি লাইনের চিত্র আপনাদের দেখাই, দৈবাৎ হরেক বিচিত্র কুহরে কিম্ভূত ক্ষয়িষ্ণু জল/অতনু রিক্ত ঘুর্ণি সফল পাথুরে মাকাল ফল'। আমার মনে হয়, স্বয়ং কবি কেন, কবির চৌদ্দ গোষ্ঠী এলেও কবিতাটির পাঠোদ্ধার করতে পারবেন না। কারণ, আদতে কবিতাটির কোন মানেই নেই। কবিতাটির শিরোনামও দিয়েছিলাম অর্থহীন পংক্তিমালা। যাই হোক, কবিতাটি (!) নিয়ে গেলাম এবং সাহিত্য সম্পাদক মহোদয়কে বললাম, অনেক যত্ন করে আপনার কথামতো আধুনিক শব্দচয়ন করে কবিতাটি লিখেছি দাদা। একটু যত্ম করে দেখবেন। উনি দেখলেন এবং পরবর্তী সংখ্যায় কবিতাটি ছাপাও হলো। আমার একটি কবিতার স্বীকৃতি মিললো। কিন্তু ছাপার অক্ষরে কবিতাটি দেখে সেদিন হতাবাক হয়ে বেশ কিছুক্ষণ বসে থেকেছি আর ভেবেছি, হায় কাব্য সাহিত্য তুমি কোথায় গিয়ে দাঁড়ালে!
পাঠক, একবারও হাঁসছেন? আমার কান্না কিন্তু যথারীতি। এই ভেবে চক্ষু সজল হয়ে ওঠে যে, এমন কাব্যবোদ্ধারা যদি বড় বড় দায়িত্বশীল জায়গায় বসে থাকেন তাহলে কাব্য-সাহিত্যের ভবিষ্যত কোন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়াবে?
পাঠক, আমার দুটি অভিজ্ঞতার একটিও কি তিক্ত মনে হয়নি আপনার কাছে? যদি হয়ে থাকে, তবেই আমার এই লেখার সার্থকতা।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




