somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মাহমুদুল হকঃ দীর্ঘ নির্জনবাসের কারাগারে স্বেচ্ছাবন্দী

০৯ ই মার্চ, ২০২০ রাত ১০:১৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



বইমেলায় মাশরুরের সাথে দেখা হলো। এমনিতে মেসেঞ্জারে প্রায় অনিয়মিতভাবে যোগাযোগ হয়, তবু সামনাসামনি দেখা হয়ে ওঠেনি আমাদের দীর্ঘদিন। দীর্ঘদিনের হিসেব করলে আসলেই অনেক অনেকদিন। প্রায় ৪/৫ বছরের গ্যাপ। একসময় মাশরুরের হলে গিয়ে কত আড্ডা দিতাম! সোনালি সেই দিনগুলো জীবনের উত্তাপে গলে গেছে, ফিরে পাওয়ার আকার দেয়ার কোন উপায় নেই আর। সেই মাশরুরের সাথে দেখা হয়ে গেলো। একথা সেকথার পর মাশরুরকে বললাম, "দোস্ত বই কিনে দে।" মাশরুরের হাতে ইতিমধ্যেই অনেক বই। আমি কিনতে চাইলাম হিরন্ময় কথকতা। পেন্ডুলাম প্রকাশনিতে গিয়ে জানলাম বই শেষ! মাশরুর আমাকে বিন্দুমাত্র হতাশ না করে তার কেনা বইটাই আমাকে দিয়ে দিলো। বন্ধুত্বতো একেই বলে! এভাবেই হাতে এলো কান্নাপর্বের লেখক আহমাদ মোস্তফা কামালের সম্পাদনায় রচিত মাহমুদুল হকের সাক্ষাৎকার সংগ্রহ "হিরন্ময় কথকতা"!

৫০/৬০/৭০/৮০ দশকগুলোতে যে পরিমাণ সাহিত্য আড্ডা হতো, সেসব আড্ডায় লেখা নিয়ে যতো কাটা ছেঁড়া হতো তার কিছুই হয় না এখন। এইতো মাত্র ১০/১২ বছর আগেও আজীজ মার্কেট কেন্দ্রিক যে আড্ডাস্থল ছিলো তা এখন বিলুপ্ত। ছবির হাটের আড্ডাতো বছর পাঁচেক আগেও ছিলো, এখন ছবির হাটের কোন অস্তিত্ব পাওয়া যাবে না। বর্তমান যুগে জীবন এতো বেশি প্রতিযোগীতার সম্মুখীন যে কোন গুণী লেখকদের বাসায় সপ্তাহান্তে জমিয়ে আড্ডা হয় কীনা তাও আমার জানা নেই।

কদিন আগে ফরিদ কবিরের আত্মজীবনী “আমার গল্প”-তে এমন অনেক আড্ডার কথা উঠে এসেছে। মাত্রই শেষ করা সাক্ষাৎকার সংগ্রহ “হিরন্ময় কথকতা”-তেও মাহমুদুল হক এমন অনেক আড্ডার কথা স্মৃতিচারণ করেছেন। সবগুলো সাক্ষাৎকারেই তিনি দুজন মানুষের বন্দনা করে গিয়েছেন, একজন শহীদ সাবের, অন্যজন শহীদ কাদরি। আরও অনেক অগ্রজ এবং সমসাময়িক লেখকদের সাথে আড্ডার স্মৃতিচারণ করেছেন। এরফলে মাহমুদুল হক পরিষ্ফুটিত হয়েছেন। তিনি অকপটে জানিয়েছেন, ‘আমার জীবনে যা কিছু কিঞ্চিৎ শিখেছি তা শহীদ কাদরির জন্যই।’ যেমনঃ ছোট একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করেই দিই এখানে। একবার এক পত্রিকায় শহীদ কাদরির কবিতা আর মাহমুদুল হকের গল্প, দুজনের লেখাই ছাপা হলো। তো পরবর্তী আড্ডায় সবাই শহীদ কাদরির লেখা নিয়ে প্রশংসা করলেও মাহমুদুল হকের লেখা নিয়ে কেউ কিছু বলছে না। উনি উশখুশ করছেন। আড্ডা শেষে শহীদ কাদরি তাকে বললেন, ‘শালা, আর কাজ পাও নাই। দুনিয়ার গয়নাগাটি দিয়ে ভরিয়ে রেখেছিস। ন্যাঙটা করে দে বেটা, ন্যাঙটা করে দে। তবে না গল্প হবে!’ এভাবে মাহমুদুল হক পরিণত হয়েছেন। আমরা পেয়েছি “জীবন আমার বোন”, “কালো বরফ” – এর মতো কালজয়ী উপন্যাস। তার সবগুলো উপন্যাসের ভাষা ছিলো একটা থেকে অন্যটা ব্যতিক্রম। নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার, নিজের লেখা নিয়ে ক্রমাগত নিরীক্ষার এই সাহস বর্তমান কয়জনেরইবা আছে? কিন্তু মাত্র ৭/৮ টি উপন্যাস আর বোধহয় একটি মাত্র গল্প সংকলন করেই থামিয়ে দিলেন কলম। একটা লাইনও লিখেন নি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। সময়টা প্রায় তিরিশ বছর!

এই সাক্ষাৎকার সংগ্রহ বইটিই মাহমুদুল হককে জানার সবচেয়ে ভালো উপায় বোধহয়। একজন লেখককে জানতে হলে তার সাক্ষাৎকারগুলো পড়তেই হবে। লেখকের জীবন ধারণ, ব্যাক্তিগত ভালোলাগা, বিশ্বাস, দেশ ভাবনা, ছেলেবেলা সহ সবকিছু সহজে জানা হয়ে যায় সাক্ষাৎকারে। যেমনঃ ব্যক্তিগত ভালোলাগা হিসেবে “লালসালু” উপন্যাসের প্রতি তার বারংবার মুগ্ধতা উঠে এসেছে। জানিয়েছেন মানিক বন্দোপাধ্যায়কে আমরা এখনও পুরোপুরি বুঝেই উঠতে পারিনি। মানিকের উপন্যাসগুলোতে রহস্যের যে গন্ধ রয়েছে তা এখনও অজানা!

সাক্ষাৎকারগুলোতে আরও যে বিষয়টি আমার নজর কেড়েছে তা হলো, মাহমুদুল হকের নির্মোহ জীবন। এমন নির্লিপ্তভাবে কেইবা যাপন করে গিয়েছেন আমার জানা নেই। মাহমুদুল হক হবার সাধ্য নেই, কিন্তু আমারও ইচ্ছে হয় এমন একটা নির্মোহ জীবন যাপনের।

তবে সাক্ষাৎকার কিংবা প্রশ্ন আর তার উত্তরের মাঝে কাউকে খুঁজতে যাওয়া অনেকটাই বোকামি। কারণ সাক্ষাৎকার প্রদানকারী যদি নিজেকে লুকিয়ে রাখেন তাহলে শত প্রশ্ন করেও বের করা সম্ভব নয়। যেমন বের করা যায়নি মাহমুদুল হক কেন ৮০ সালেই তার কলম থামিয়ে দিয়েছেন। তবে একটা ব্যাখ্যা তিনি দিয়েছেন। ব্যাখ্যাটা আমার মনঃপুত হয়নি (ব্যাখ্যা জানতে হলে বই পড়তে হবে)।

তবে সেই ব্যাখ্যার ফলে মাহমুদুল হকের খুবই সৎ একটা দিক উঠে আসে। তিনি ইনিয়ে বিনিয়ে বলতে চেয়েছেন তিনি হয়তো ছিলেন লিমিটেড এডিশন। তার ভেতর থেকে কোন লেখা আসেনি বলেই তিনি আর লেখেন নি। এতোটা সৎ কোন লেখক কখনও হতে পেরেছেন কীনা জানি না। লেখা না আসলেও লেখার চেষ্টা অব্যাহত থেকে যায়। হয়তো সাময়িক বিরতি নেয়, সেই বিরতিটাও লেখায় ফিরতে চেয়েই। কিন্তু মাহমুদুল হক যেন সেসবের ধার দিয়েও গেলেন না। তিনি কলম থামিয়েই দিয়েছেন। কাটিয়ে দিলেন মৃত্যুর অপেক্ষায় দীর্ঘ এক নির্জনবাস। বাংলা সাহিত্যের অপূরণীয় এই ক্ষতি কোনভাবে পূরণ হবে না।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই মার্চ, ২০২০ রাত ১০:২৪
৫টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

×