somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ " ইলাবতী আর একটি অসম সাম্প্রদায়ীক প্রেমকথা "

০১ লা আগস্ট, ২০১১ রাত ১২:৫৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


পৃথিবীতে দুই দল মানুষ আছে। যাদের একদল রাতের বেলায় সুখনিদ্রা যায়। আর অন্যদল আমার মত নীরবে রাতকে ভালবেসে যায়। রাত্রি শব্দটার মাঝে জাগতিক সমগ্র পবিত্রতা খুঁজে বেড়ায়। আসলে পবিত্রতা না ; কিছু স্মৃতি, কিছু সুখ, কিছু মায়াভরা মুখ, একটু খানি হাসি অথবা কৃত্তিম ভালোবাসার সন্ধান করে। মানুষগুলো দিন দিন স্বার্থপর হয়ে যাচ্ছে আর সেই ফলস্রুতিতে দ্বিতীয় দলটি ভারী হচ্ছে। কখনো জানালা, কখনো খোলা ছাদ আবার কখনো উন্মুক্ত রাস্তার পাশের প্রশস্ত ফুটপাথ। এরা অন্ধকার আকাশ দেখে, কালো বৃষ্টির ফোঁটা দেখে, দেয়াল জুড়ে স্বপ্ন আঁকে। এদের কেউ কেউ আবার গান শুনে, কখনো কখনো একই গান বার বার শুনে, গান শেষ হয়ে যে আবার রিপিড হচ্ছে সেটা আর খেয়াল থাকে না। আমি কিন্তু গানের ব্যাপারে একটু ভিন্ন। যখন আমার মন খুব বেশী খারাপ থাকে তখন ইচ্ছে হলে গান শুনি। এখন গান শুনছি, কারন? কারন আজ আমার মন খারাপ। ভয়ানক মন খারাপ। আজ আমি তোমাদের সেই মন খারাপের গল্প শোনাব। সময় হবে কি তোমাদের? শত ব্যাস্ততার মাঝে আমাকে নাহয় একটু সময় দাও তোমরা। শুনেছি তোমরা নাকি আজকাল শুধুই মৃত্যু, মুখোশ, তান্ডবের গল্প শুন, আজ নাহয় এই শহরে মৃত্যু ঘটে যাওয়া একটি ভালবাসার গল্প শুন।

হ্যাঁ গল্পের নায়ক আমি। আমিও একদিন সেই সুখনিদ্রা যাপনকারীদের দলে ছিলাম। আমার কোন পিছুটান ছিল না, বাঁধা ছিল না, কোন উচ্চাকাংখা ছিলনা। বেশ ভালই সময় যাচ্ছিল আমার। নদী, নৌকা, মাঝি এবং বন, লতা আর পাখি সবই ছিল আমার। আমি ছিলাম আমার। একসময় আমার সুখনিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটাতে আসে এক রূপকন্যা। আমার চোখে নরম ঠোঁট ছুঁইয়ে নিদ্রা ভাঙ্গায় আমার। সেদিনের পর থেকে আজ পর্যন্ত আমি জানি না সুখনিদ্রা কি।

ইলাবতী তার নাম। আমি ছোট করে ইলা বলেই ডাকতাম। এতে করে সে বরং খুশি ছিল। আমি হাসলে অপলক তাকিয়ে থাকতো। আমি কথা বললে মিষ্টি করে হেসে শুধু ঘাড় নাড়াত। একজন নাড়ীর সৌন্দর্যের যা থাকে ইলাবতীর তার চেয়ে একটু বেশী ছিল। দেবী দুর্গার মত ভরাট অক্ষিযুগল আর আরব্য রূপকথায় রাজকন্যার মত দেহের গড়ন। গোলাপি ঠোঁটের দিকে তাকালে মনে হতো সদ্য জন্ম নেয়া শিশুর ন্যায় পঙ্কিলতা মুক্ত ওষ্ঠ যুগল। কখনো কখনো ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করত, পাশাপাশি ওর সেই পবিত্রতা নষ্ট হতে পারে ভেবে অপরাধবোধ জেগে উঠত। নাহ ! সেই ওষ্ঠে আর ওষ্ঠমিলন হয়নি। মাঝে মাঝে খুব কাছে যাওয়া হত তারপর? তারপর আবার দুজনই সংযত আর একরাশ চাঁপা হাসি।

ইলার ভালবাসার কাছে আমার ভালবাসা ছিল অতীব নগণ্য। হাল জমানার আধুনিক একটা মেয়ে সারারাত বসে মালা গেঁথে সকালে প্রেমিকের হাতে দেবে সেটা কি তোমরা বিশ্বাস করো? আমি মিথ্যা বলছি না। আরো শুনবে? ইলা আমার হাত টেনে নিয়ে ওর দুহাতে ঘষে দিত আর বলতো," তুমি একদিন আমার হবে, এই হাত দিয়ে তখন আমায় কি আদর করে দেবেনা গো ?" ওর পাগলামীতে আমি মুচকি হেসে ভাবতাম, "আমার মত আটপৌরে একটা অকর্মার কাছে তুই এতকিছু আশা করিস কেনরে পাগলী। আমি যদি না পারি , আর আমার সাধ্যই কতখানি? "

আমার আফসোস ছিল আমি কেন ইলার মত করে ভালবাসতে পারি না? একদিন রিকশার সাথে ধাক্কা লেগে আমার হাতটা কেটে গেলো। সে কি কান্না পাগলীর। আমি ওকে শুধু বলতাম, এত ভালোবাসো কেন মেয়ে? একদিন কিন্তু এর জন্য কাঁদতে কবে তোমাকে। মুখটা ভার করে রাখত। ও জানতো আমি ওর রাগ ভাঙ্গাবো না। তাই নিজে থেকেই বলতো, " তুমি এমন কেন গো? অন্য ছেলেদের দেখি প্রেমিকাকে কত আদর করে, আর তুমি আমার দিকে ঠিকভাবে তাকাওই না। আমি কি এত খারাপ গো? " ইলার গাল টিপে দিয়ে বলতাম, "ওরে পাগলী আমার, খারাপ তুমি না, আসলে আমিই খারাপ। তোমার কাছ থেকে স্বার্থপরের মত ভালবাসা নিয়েই যাই, তোমাকে আর দেইনা।" ওর মুখে সুন্দর একটা হাসির রেখা ফুটে উঠত। পাগলী আমাকে বলতো, " আমাদের বিয়ের পরে আমাকে এভাবে আদর করে দেবে তো ?"

এরই মাঝে একদিন দেখা গেলো ইলাবতীর চোখ ছল ছল করছে। আমি ভ্রু কুচকে জিজ্ঞাসা করলাম কেন? " বাবা আমার বিয়ে ঠিক করেছে। যত তারাতারি পারে তারিখ ফেলতে চাইছে। তুমি কিছু একটা করোনা গো। আমি তোমাকে ছাড়া ভাবতে পারিনা কিছু। অন্য একজনের সাথে ঘড় করবো ভাবতেই গাঁয়ে কাটা দেয়। কি গো? তুমি চুপ কেন ?" শুভ্র দুটি গাল বেঁয়ে অশ্রু ফোয়ারা দেখেছি সেদিন। প্রেমিকার চোখের জল হাতের তালুতে নিয়ে দেখেছি। স্বচ্ছ জ্বলে আলক রেখা বিচ্ছুরনের তত্ত্ব খুঁজেছি।

আমি আমার ফ্যামিলিতে বলেছিলাম ইলার কথা। মা কিছুতেই রাজি হলো না। তার একই কথা, কোন হিন্দু মেয়েকে সে ঘড়ে তুলবে না। মেয়ে মুসলিম হলে মেনে নেয়া যেত। আমি মেয়ের সাথে যোগাযোগ করলে মা বিষ খাবে। অবশেষে জন্মদাত্রী মায়ের কাছেই আমাকে হার মানতে হল।

ইলাকে বলার মত কোন বাক্য আমার ছিল না। আমি একটা চিঠিতে নিজের অপারগতা জানিয়েছিলাম। তারপরে কি হয়েছিল জানি না। অনেকদিন পর ইলার এক মাসতুত বোন আমাকে একটা চিঠি দিয়েছিল। ইলার চিঠি।

প্রিয়

আমি জানি আমি কোন কালেই তোমার যোগ্য ছিলাম না। কিন্তু যোগ্যতা নয়, ভালবাসা দিয়ে তোমাকে জয় করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমি পারলাম না। ধর্ম নামের এক অদৃশ্য বাঁধা আমাদের এক হতে দিল না। তুমি পরজনমে বিশ্বাস করো? শুনেছি তোমাদের ধর্মেও নাকি পরকাল আছে। আমি সেখানে তোমার সাথে দেখা করবো। তোমাদের ঈশ্বর নিশ্চয়ই এতটা নিষ্ঠুর হবেন না। তুমি ভালো থেকো। নিজের খেয়াল রেখো। চশমাটা না নিয়ে বের হতে ভুলে যেও না। শার্টের হাতার বোতাম লাগাতে যেন ভুল না হয়। চুলের সিঁথিটা পাল্টে দিও না। বামপাশের সিঁথিতে তোমাকে একদম অবুঝ মনে হয়। সিগারেটের নেশাটা কমিয়ে দিও, জানি তুমি ছারতে পারবে না। আর শোন, তোমাদের ধর্ম মতে খুব সুন্দরী টুকটুকে একটা মেয়েকে বিয়ে করে আনবে। আমার জন্য মন খারাপ করো না বাবু। তুমি আমার লক্ষিটি হয়ে থেকো। যখন আমাকে খুব মনে পরবে হাত বাড়িয়ে দিও। কখনো বাতাস আবার কখনো বৃষ্টি হয়ে আসব। অজান্তে কোন ভুল করলে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখো। আমি তোমার শেষ চিঠিটা সাথে নিয়ে শেষ বিদায় নিলাম। ভালো থেকো তুমি। শেষবারের মত বলি, " ভালবাসি"

ইতি
তোমার ইলা



ইলা চলে গেছে আজ তিন বছর হল। এখনো শেষদিনের অশ্রুটুক ভুলতে পারিনা। আমাদের ছোট ছোট হাসি কান্না জড়ানো সৃতি মনে পরে। বাইরে ঘুরতে বেরুলে ইলা আমাকে খাইয়ে দিত। আশেপাশের মানুষের মুখটিপে হাসি ও থোরাই কেয়ার করতো? একবার আমার সাথে দেখা করতে আসার সময় ছাতা কিনে এনেছিল। আমি নাকি রোদে কালো হয়ে যাব? ওর সাথে থাকলে আমাকে চোখে চোখে রাখত, অন্য মেয়ের দিকে চোখ যায় কি না কড়া খেয়াল রাখতো। সেই রূপকন্যা তুই আমাকে অন্য মেয়ের সাথে শংসার করতে বলে গেলি? শেষ চিঠিটা লিখতে তোর কত কষ্ট হয়েছে আমি জানি, আমি জানি। তুই ছাড়া আর আমাকে শাশন কে করবে বল? এতটা অভিমানি তুই? আমার যে কিছু করার ছিল না রে। শেষ বেলাতেও আমার সব দোষ নিজের ঘারে নিয়ে গেলি। আমি ভাবতাম আমি স্বার্থপর, নাহ আসলে তুই স্বার্থপর। যে দোষের ভার আমার বহন করার কথা সেটা তুই একাই নিয়েছিস। এতটা ভালবেসেছিলি কেনরে তুই? কেন?

কি গল্পটা কেমন লাগল তোমাদের? তোমাদের ব্যাস্ত সময়ের যেটুক নিলাম তার কিয়দাংশ কি উসুল করতে পেরেছ? ইলাবতীর গল্প তোমাদের শহরের কেউ মনে রাখেনি, রাখবেও না। ইলাবতীর ভালবাসা আসবে না তোমাদের সাপ্তাহিক সাহিত্য পত্রিকায়। তোমাদের সমাজের অসম সাম্প্রদায়ীকতা আজ একটি ভালবাসার হত্যাকারী। একজন প্রেমিকার হত্যাকারী। আর কতকাল? সাম্প্রদায়ীকতার আড়ালে তোমাদের রক্ষণশীলতা আর কুসংস্কারটা চেপে রাখছ কেন? মানুষকে ধর্ম দিয়ে বিভাজন না করে ধর্ম মানুষ দিয়ে বিভাজন করতে শেখো। আজ তোমাদের জানিয়ে গেলাম। এরপরেও কি তোমরা সাম্প্রদায়িকতার গ্যারাকলে আচ্ছন্ন থাকবে?











উৎসর্গঃ আমার বোন পৃথিলা আফনান কে। ওর সাথে একটি বাজি ধরেছিলাম। বাজিতে হেরে গেছে বেঁচারী। পৃথিলা দেখ ভাইয়েরা কত মহান, তুই হেরে গেলেও তোর কথামত সেই পুরস্কারটা তোকে দিলাম। /:)


উৎস: এই গল্পটা লেখার উৎসটা সত্যি চমৎকার। একটি একদমই সত্য ঘটনা থেকে কাল্পনিক গল্গ। আমার অতিপরিচিত একজনের বন্ধুর জীবনে সাম্প্রদায়ীকতা নিয়ে ভালোবাসা নষ্ট হয়েছে। তার বন্ধু তাকে ফেসবুকে একটি মেসেজ পাঠিয়েছিল। সেটা আবার আমাকে দেখালো আমার পরিচিত জন। একটা গল্পের প্লট হুট করেই মাথায় চলে আসে। সেই মেসেজটির স্ক্রিনশট এখানে না দিলেই নয়।


সর্বশেষ এডিট : ০১ লা আগস্ট, ২০১১ রাত ১২:৫৭
৯২টি মন্তব্য ৯১টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:০২



ইউটিউব হুজুর বললেন, মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে। তখন নাকি নিজ যোগ্যতায় ঈমান রক্ষা করতে হয়। আল্লাহ নাকি তখন মুমিনের সহায়তায় এগিয়ে আসেন না। তাই শুনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×