আসলেই তো, ভালোবাসা জিনিসটা যে কী! কবি-সাহিত্যিকরা তো ভালোবাসা ভালোবাসা করতে করতে জীবনটাই শেষ করে দিলেন। গীতিকার-সুরকারদের অবস্থাটাও দেখুন একটু! শত শত বছর ধরে এই একটা বিষয় নিয়ে এত অসংখ্য অগণিত গল্প কবিতা উপন্যাস আর গান লেখা হয়েছে যে, আমরা ভালোবাসাকে কবি আর গীতিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতেই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। কিন্তু নিরেট বিজ্ঞান কী বলে? বিজ্ঞানীরা মানুষের আর দুটো অনুভূতি- ক্রোধ আর ভয় নিয়ে গবেষণাগারে অনেকদিন ধরেই কাজ করছেন। কিন্তু ভালোবাসা? দুর্ভাগ্যজনকভাবে খুব বেশি কাজ হয়নি এ নিয়ে। হয়তো বিজ্ঞানীরাও মনে করেছেন যে এটা কবি-সাহিত্যিকদেরই কাজ। তাঁদের যথেষ্ট সময় আছে ভাষা দিয়ে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে প্রকাশ করার। যাহোক শেষ পযর্ন্ত তাঁরা আর বসে থাকতে পারেননি। গত কয়েকটি বছর ধরেই বেশ কজন পিএইচডি ডিগ্রীধারী প্রাণরসায়নবিদ আর নৃতাত্ত্বিকরা ভালোবাসার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা খুঁজতে যে পরিশ্রম করে চলেছেন, একটা ভালোবাসার কবিতা বা গান লেখার পরিশ্রমের চেয়ে তা কোন অংশে কম নয়! কী পেলেন তাঁরা এ পযর্ন্ত? চলুন দেখি ভালোবাসাকে অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নীচে ফেলে একটু জেনে নিই এমন কী রহস্য লুকিয়ে আছে এর মাঝে!
ভালোবাসা কি শুধুই আবেগ? অথবা রিরংসার অন্য নাম? জন্মায় কোথায় এটা? হৃদয়ে? নাকি অন্য কোথাও? প্রচুর গবেষণার পর এসব প্রশ্নের যে উত্তরগুলো বিজ্ঞানীরা খুঁজে পেয়েছেন, সাধারণভাবে সেগুলোকে কিছুটা উদ্ভট ও বিস্ময়কর বলে মনে হয়। বিজ্ঞানীদের দোষ নেই, তাঁরা ভুল কোন কিছু বের করেননি। আমরা বিজ্ঞানমনষ্ক চোখে ভালোবাসাকে দেখতে সাচ্ছন্দ্য বোধ করিনা বলেই এমন হয়, যেহেতু ওভাবে দেখলে ভালোবাসাকে বেশি একটা ভালো নাও লাগতে পারে! যাহোক বিজ্ঞানীদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ভালোবাসা আসলে বিবর্তন বিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান আর রসায়নশাস্ত্রের ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। ভালোবাসা আসলে হাজার বছর ধরে বয়ে চলা মানুষের একটি পুরোপুরি অন্তর্গত প্রচেষ্টার বহমান স্রোতধারা। আর এ স্রোতধারাটি হচ্ছে মানব সমাজকে টিকিয়ে রাখার প্রকৃতি-নির্ধারিত শক্তি ও কৌশল। লস অ্যাঞ্জেলেসের লয়োলা ম্যারিমাউন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মাইকেল মিলস একটিমাত্র বাক্য দিয়ে এর ব্যাখ্যা করেছেন, “Love is our ancestors whispering in our ears.” এখন প্রশ্ন হলো- কবে, কোথায়, কেন শুরু হয়েছিল এই ফিসফিসানি? বিজ্ঞানীরা মনে করছেন খুব সম্ভবত মানব প্রজাতির উন্মেষের প্রাথমিক লগ্নেই ভালোবাসা নামের ফুলটি মানুষের অনুভবে পুষ্পিত হতে শুরু করেছিলো; মস্তিষ্ক থেকে রক্তস্রোতে অসাধারণ কয়েকটা নিউরোকেমিক্যাল বা হরমোনের অবিরাম বা সবিরাম প্রবাহের কারণেই এটা শুরু হয়েছিলো। এই হরমোনগুলো পুরুষ ও নারী শরীরে একধরনের রোমাঞ্চিত অনুভূতি বা ‘Thrilling feeling’ জাগিয়ে তোলে মস্তিষ্ক থেকে শিরা- উপশিরায় প্রবাহিত হওয়ার মাধ্যমে। এই অনুভূতিটাই আরো বিস্তৃত হয়ে মিলনের লিপ্সা জাগায়, রোমান্টিক সংঘাত সৃষ্টি করে। এটা যে শুধু উৎপাদনের লিপ্সা তা নয়, বরং এর বাইরেও আরো বেশি কিছু। আর এই ‘বেশি কিছু’টাই হচ্ছে ভালোবাসা, চলতি ভাষায় আমরা একে প্রেম বা Affair বলে থাকি। ভালোবাসার এই নতুন দ্যোতনা নারী-পুরুষকে এক দীর্ঘস্থায়ী বন্ধনে আবদ্ধ করে, অন্যান্য প্রাণীর ক্ষেত্রে যা খুব একটা দেখা যায়না। বিখ্যাত আমেরিকান নৃতাত্ত্বিক ড. হেলেন ফিশার তাঁর “Anatomy of Love” বইতে পুরো বিষয়টাকে বলছেন প্রকৃতি-নিয়ন্ত্রিত (nature-controlled)। আমরা যাকে ‘মন’ বলে থাকি, তিনি মনে করছেন বিশুদ্ধ বিজ্ঞানে এর কোন অস্তিত্বই নেই। তাঁর বক্তব্য পড়ে ভড়কে যাবেননা যেন, “Love can preferably be outlined as the synthesis and secretion of certain magic chemical compounds from the brain to the bloodstream, stimulating some sort of physical responses (for example, an increase of blood pressure in the heart).” প্রেমে পড়া মানুষ সবসময় না হলেও প্রায়ই বলে, তাদের অনুভূতিতে এমন একটি শিহরণ বিচ্ছুরিত হয় যেন তারা ‘ভেসে যাচ্ছে’। খুব একটা ভুল বলেনা কিন্তু তারা। গবেষণায় সত্যিই প্রমাণ মিলেছে, মস্তিষ্কনিঃসৃত রাসায়নিক যৌগে তাদের শরীর অন্তসলিলায় ভাসছে। কেন নিঃসরণ ঘটে এই যৌগগুলোর? আবারো ড. ফিশার, “Only a little touch from the lover, or the scent of the lover, or even just looking at the lover can increase the synthesis and secretion of the hormones to such a great extent that the subject feels an irrepressible thrill.” এরপর শারীরিকভাবে যা ঘটে তার কিছু থাকে দৃশ্যমান, কিছু অদৃশ্য। পরিচিত ও দৃশ্যমান ফলাফল হচ্ছে- ত্বক (বিশেষ করে মুখমন্ডল) রক্তিম হয়ে ওঠা, হাতের তালু ঘেমে যাওয়া, নিশ্বাস ভারী হয়ে ওঠা। এসবই কারো প্রেমে পড়া বা কাউকে ভালোবাসা বা কারো প্রতি আকর্ষণ অনুভব করার লক্ষণ। বলা যায় এটাও একধরনের Stress বা চাপ। অবশ্য প্রচলিত অর্থে Stress বলতে যা বোঝায়, এটা একদমই সেরকম কিছু নয়। একে বরং বলা যেতে পারে ‘Exceptional stressed condition’, যা কিনা একজন মানুষকে করে তোলে উচ্ছ্বসিত, করে তোলে সুখী।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




