নয়াদিল্লীর রাজনীতিক, ব্যবসায়ী মহল ও উচ্চাশী পেশাজীবীরা তার বক্তব্যে ক্ষুব্ধ হবেন, খুবই স্বাভাবিক। কারণ তারা নিজেদের মতো করে ভাবতে চলেছেন যে, তাদের দেশ অর্থনীতি ও রাজনীতির একটি শক্তিকেন্দ্রে পরিণত হতে চলেছে প্রায়।
তারা দেখছেন দুনিয়ার চোখে ভারতের মর্যাদা বাড়ছে। কিন্তু ভূয়োদর্শী লেখিকার মন্তব্য নিক্ষেপণ বন্ধ নেই এবং পাশাপাশি মহলবিশেষের উষ্মা প্রকাশও অব্যাহত রয়েছে। তার প্রকাশিত রচনাসংগ্রহ ‘‘কিল্ড নোট্স্ অন ডেমোক্রেসির লিংস্নিং টু গ্রাস্ হপাস্’’ প্রসঙ্গে সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে অরুন্ধতি রায় বলেন, জনগণে প্রকাশমান ক্ষোভ ও ক্রোধকে আশ্বস্ত করা ও সেগুলোকে মূর্তরূপ দেয়ার জন্যই রাজনৈতিক রচনাগুলো আমি লিখি ও প্রকাশ করি।
তিনি বলেন, বাহ্যিক ঝলমলে প্রদর্শনীর পিছনের রূপটিকে প্রকট করে তোলাই হচ্ছে আমার কাজ।
অর্ধ-আত্মজীবনীমূলক ও আতংক সৃষ্টিকারী রাজনৈতিক উপন্যাস রচনার জন্য অতি মর্যাদাসম্পন্ন বুকার প্রাইজ অর্জন করেন রায় ১৯৯৭ সালে। পরবর্তীতে চিত্রনাটক রচনা ও চিত্রাভিনয়ে প্রবেশ সত্ত্বেও মূলত রাজনৈতিক বিষয়গুলোকে নিয়ে স্পর্শকাতর মন্তব্যে রায় আত্মপ্রকাশ অব্যাহত রেখে চলেছেন।
এ পর্যন্ত ৭টি বই ও অসংখ্য নিবন্ধ লিখেছেন রায়। সবগুলোতেই দেশের অন্ধকার দিকগুলোকে আলোর সামনে তুলে ধরতে চেয়েছেন তিনি। বড়ো বড়ো বাঁধ নির্মাণ, আণবিক বোমার মালিকানা অর্জন, হিন্দু জাতিয়তাবাদী রাজনীতি এবং সন্ত্রাস প্রতিরোধ যুদ্ধ কৌশলের নামে নাগরিক অধিকার ভারতে যেভাবে বিধ্বস্ত করা হচ্ছে এবং বিশেষভাবে উপজাতীয় লোকজনদের দুর্দশা যেভাবে দুঃসহ ও অবর্ণনীয় করে তোলা হচ্ছে- সেগুলোকেই সত্য স্বরূপে লোকজনের ও দুনিয়ার সামনে মেলে ধরার জন্য কলম চালিয়ে যাচ্ছেন অরুন্ধতি রায়। তার লেখায় স্পষ্ট অভিযোগ করা হচ্ছে, নয়াদিল্লী সরকার বড়ো বড়ো কর্পোরেশনের স্বার্থ রক্ষার্থে আম জনগণের কল্যাণকে বলী চড়াচ্ছে। ফ্যাক্টরি তৈরি করার গরজে লোকজনকে তাদের বসতভিটা থেকে পাইকারিভাবে উচ্ছেদ করে যাচ্ছে। অহিংস প্রতিবাদীদের আহবানে পাত্তা দিচ্ছেনা। রায় প্রশ্ন তোলেন, অর্থপতি হাঙ্গরদের সম্মিলিত শিল্পপুঁজির মুনাফা লোভ অক্ষুণ্ণ রাখার স্বার্থে লাখো মানুষকে তাদের ঘর বসত থেকে উচ্ছেদ করে ভারতের সরকার গণতান্ত্রিক নীতিমালার ধারকবাহক সাজে কীভাবে?
কিন্তু রায়ের সমালোচনায়ও ঘাটতি নেই। তাঁর উপন্যাস ভালোবাসেন, এমন লোকেরা বলেন, রায় তার বক্তব্যে এমন চরমে পৌঁছে যাচ্ছেন যে, তার সঙ্গে সংলাপে বসার অবকাশ অবশিষ্ট থাকছে না।
দিল্লীভিত্তিক মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রচারকামী প্রতিষ্ঠান লিবার্টি ইন্সটিটিউটের ডিরেক্টর বরুণ মিত্র বলেন, ‘‘শব্দ ও ভাষার কুশলী কারিগরিতে রায় জনগণের মধ্যে এতোখানি প্রভাব ছড়িয়ে ফেলেছেন যে, ভিন্ন কোনো মত বা বক্তব্যে কান দেয়ার কোনো গরজই তিনি অনুভব করছেন না। প্রতিষ্ঠানের প্রধানকে সম্বোধন করে কিছু বলার গরজ তিনি দেখছেন না। তিনি সরাসরি হাতুড়ি হাতে তুলে নিয়েছেন। একটানা আক্রমণ-সমালোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন। বরুন মিত্রের মতে ভারতীয় গণতন্ত্রের ধারাপথ থেকে অরুন্ধতি রায় পুরোপুরি ছিটকে পড়েছেন- বেসামাল হয়ে বসেছেন।
ভারতের গণতন্ত্রের অনুশীলন বিস্ময়কর মাত্রা অর্জন করেছে।
ঘৃণাসূচক অসংখ্য মেইল মন্তব্য নিজের রচনার প্রতিদান হিসেবে পেয়ে থাকেন রায়। তাকে হিন্দুবিরোধী বলা হয়। জাতি বিদ্বেষীও বলা হয়। বলা হয় যে, তার বিষাক্ত কলম দিয়ে ভারতের মানমর্যাদায় তিনি কালি লেপে চলেছেন। মুম্বাইয়ে গত বছর ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার সময় ভারতীয় পুলিশের সন্ত্রাস বিরোধী কার্যকলাপের বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করে রায় বক্তব্য দেয়া শুরু করলে ভারতের একটি টিভি চ্যানেল তার উদ্দেশে চরম অবমাননাকর মন্তব্য নিক্ষেপ করে।
কিন্তু যাদের দুঃখ-দুর্দশার কথা চিরকাল চাপা থেকে যায় ও লোকজন জানতে পায় না। সেই হাজারো লাখো মানুষ অরুন্ধতি রায়কে তাদের ভরসার একমাত্র স্থল হিসেবে মানেনি।
বিবাদ-সংঘাতের এলাকাগুলোয় এবং সুদূর দেহাতগুলোয় ঘুরে ঘুরে গণপ্রতিরোধের কাহিনীগুলো তিনি সংগ্রহ করেন।
১৯৯৮ সালে ভারত পরমাণু পরীক্ষা চালালে এর বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদী লেখাগুলো রায় লেখেন, ভারতের বিভিন্ন ভাষার সংবাদে সাময়িকীতে এবং পোস্টারে ও পুস্তিকায় সেগুলোর ব্যাপক প্রচর লক্ষ্য করা যায়। রায়ের একটি উক্তি সম্প্রতি একটি ফিলিস্তিনী প্রাচীরে দেয়ালচিত্র স্বরূপ শোভা পেতে দেখা যায়। ভারতের জনপ্রিয় সংবাদ সাময়িকী ‘‘আউটলকে’’র সম্পাদক বিনোদ মেহ্তা বলেন, রায়ের রচনা যে সারা জাগায়, তা কল্পনাতীত। যারা রায়ের বক্তব্যে একমত নয় তারাও তার লেখা পড়েন হয়তো বা তাকে ঘৃণা করার জন্য।
বিনোদ মেহতা বলেন, ‘‘গণতন্ত্রের আওতায় যাঁরা বাইরে রয়েছেন এবং জনজীবন প্রশ্নে গুরুত্বপূর্ণ বিতর্ক যাঁদের কর্মকান্ডে জন্ম নিয়েছে, রায় তাদের প্রসঙ্গে আলোচনা করেন আন্তরিকতার সঙ্গে।
মাওবাদী বিদ্রোহীদের কথা প্রসঙ্গত এসে যায়। অজস্র পুলিশ ও পুলিশ কর্মকর্তাকে ভারতের উপজাতীয় অঞ্চলগুলোয় এরা হত্যা করেছেন, ভারত বিরুদ্ধে বড়ো আকারের সামরিক অভিযান শুরু করলেও এদেরকে দেশের জন্য একক বৃহত্তম অভ্যন্তরীণ হুমকি আখ্যা দিলে উপজাতীয় অভ্যুত্থানের কারণ বিশ্লেষণ করে ন'পাতার একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেন রায়। চলতি মাসে লেখাটি আউটলুকে বেরোয়।
রায় লেখেন ভারত সরকার এ পর্যন্ত ঐ উপজাতীয়দের সহিংসতা ও অবজ্ঞা ছাড়া আর কিছু দেয়নি। উপরন্তু আজ সরকার নেমেছে তাদের শেষ সম্বল ভিটেমাটিটুকু তাদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিতে। উপজাতীয়দের অস্ত্র হাতে তুলে নেয়ার পেছনের কারণ রয়েছে বৈকি।
কিছু লোক অভিযোগ করেন, রায় বিদ্রোহে ইন্ধন যোগাচ্ছেন।
জবাবে রায় বলেন ‘‘আপনাদের সবার মিলিত নীরবতাকে আমি ভাঙতে চাচ্ছি।’’
রায় বলেন, তালে তাল দিয়ে চলবো এবং লোকে বাহবা বলে আমার পিঠে থাবা দেবে- আমি সেই পাত্র নই। তিন বছর আগে তার এক লেখায় রায় লেখেন লুটেরা, সুবিধাভোগী ও তাদের স্তাবকেরা চায়, ‘‘আমি শাড়ি পরি, চুপচাপ থাকি, ঘর থেকে বেরোনো বন্ধ করি, বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে দিন কাটাই এবং লম্বা চুলে বসে বসে বিনুনি করতে থাকি।’’ রায়ের মন্তব্য সেটি হবে না।
মূল: রাম লক্ষী। আরব নিউজ অবলম্বনে সৈয়দ আহমদ হোসেন।