১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় দিন৷ এই ঐতিহাসিক দিনে মেহেরপুরের সীমানত্মবতর্ী গ্রাম বৈদ্যনাথ তলার (যা ঐ দিন থেকে মুজিবনগর হিসেবে খ্যাত) আমবাগানে বিশ্বের সংবাদ মাধ্যমের প্রতিনিধিদের সামনে প্রথম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের নবগঠিত মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়৷
বস’তপক্ষে সরকার গঠনের ভিতর দিয়ে ২৫ মার্চ দিবাগত রাত থেকে শুর” হওয়া সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ ৩ সপ্তাহের অধিককালের স্বতঃস্ফূর্ত পর্যায় অতিক্রম করে সংগঠিত রূপে আত্মপ্রকাশ করে৷ পাকিসত্মানি হানাদার বাহিনীর নির্বিচার গণহত্যা, সশস্ত্র আক্রমণ-অগি্নসংযোগ, নৃশংসতা-বর্বরতার তাণ্ডবে মুক্তাঞ্চল যখন ক্রমে সংকুচিত হচ্ছে; স্বতঃস্ফূর্ত সশস্ত্র প্রতিরোধ যখন সত্মিমিত ও বিধ্বসত্ম; রাজনৈতিক নেতৃত্ব যখন ছত্রখান ও সংযোগহীন তখন মুজিবনগর সরকারের প্রতিষ্ঠা ও শপথ গ্রহণ ছিল অত্যনত্ম এক সাহসী, যুগানত্মকারী ও সময়োচিত পদক্ষেপ৷
এই পদক্ষেপের ফলেই দখলদারমুক্ত স্বাধীন জাতি-রাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার বিজয় ত্বরান্বিত হয়৷ প্রকৃত বিচারে প্রথম স্বাধীন সরকার প্রতিষ্ঠার কাজটি খুব কঠিন ও জটিল ছিল৷ স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র, যা হলো আমাদের ম্যাগনাকার্টা বা স্বাধীনতার সনদ, তা প্রস’ত করা হয় এবং নিজস্ব রেডিও স্টেশন না থাকায় তা শিলিগুড়ির এক অনিয়মিত বেতার কেন্দ্র থেকে প্রথম প্রচার করা হয়৷ এই ঘোষণার ভিতর দিয়ে প্রথমেই সুস্পষ্টভাবে ঘোষিত হয় কেন, কোন ক্ষমতাবলে, কোন পরিস্থিতিতে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রটি গঠন করা হয়৷ এটা প্রস’তে জাতীয় মেধার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল৷ তখনকার বিশ্ব পরিস্থিতিতে যৌক্তিক ও আইনসম্মত ভিত্তি প্রতিষ্ঠা ছাড়া বিশ্ববাসীর সহানুভূতি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সমবেত করা বাসত্মবে অসম্ভব ছিল৷
যতোটুকু জানা যায়, ৯ এপ্রিল ‘৭১ সকালে তাজউদ্দীন আহমদ কলকাতা থেকে এক পুরোনো ডাকোটা প্লেনে করে প্রসত্মাবিত মন্ত্রিসভার সদস্যদের খুঁজতে বের হন৷ মালদহ, বালুরহাট, শিলিগুঁড়ি, রূপসা, শিলচর ঘুরে মনসুর আলী, আব্দুল মান্নান ও সৈয়দ নজর”ল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে ১১ এপ্রিল আগরতলা পেঁৗছান৷ সেখানে খন্দকার মুশতাক ও কর্নেল ওসমানী ছিলেন৷ আগরতলায় দীর্ঘ সময় আলোচনা ও বিতর্ক চলার পর তাজউদ্দীন প্রসত্মাবিত মন্ত্রিসভার গঠন ও আয়তন বহাল থাকে৷
বলাই বাহুল্য, অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের অনুপস্থিতিতে সরকার পরিচালনার মূল দায়িত্ব কার হাতে থাকবে এই সিদ্ধানত্মের অভাবে এবং সর্বোপরি জনপ্রতিনিধিদের সম্মিলিত সভার সিদ্ধানত্ম ব্যতিরেকে দ্র”ততার সঙ্গে সরকার গঠন ও শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান আয়োজন ছিল নেতৃত্বের দূরদর্শিতার পরিচায়ক৷ সরকার গঠনের কাজে বিলম্ব ঘটলে পরিস্থিতি ক্রমেই প্রতিকূল হয়ে উঠতো৷ আনুষ্ঠানিকতার চেয়ে প্রয়োজনটাই তখন হয়ে উঠেছিল জর”রি৷ প্রসঙ্গত, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার দায়িত্ব গ্রহণের বৈধতার প্রশ্নই কেবল তখন বিভিন্ন মহল থেকে তুলে ধরা হয়নি; সরকার গঠন এবং এমনকি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী শক্তিও মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব প্রদানকারী দল আওয়ামী লীগের মধ্যে তখন সক্রিয়৷ নানা বাধা বিঘ্ন, মতদ্বৈতার সুকঠিন ও অতিমাত্রায় জটিল বেড়াজাল অতিক্রম করে তাজউদ্দিন সরকার প্রতিষ্ঠা করে যে প্রতু্যত্পন্নমতিতা, দৃঢ়তা ও দূরদর্শিতার স্বাক্ষর রেখেছেন, তা জাতির ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকবে৷ ইতিহাস বিকৃতকারী স্বার্থান্বেষী মহল নেতৃত্বের এই অবদানকে আড়াল করে অস্বীকার করতে চায়৷ কিন’ চলমান গতিধারা প্রমাণ করছে, যতো দিন যাবে নিঃসন্দেহে এই অবদানের ঔজ্জ্বল্য চারদিকে আলোকিত করবে৷
স্বাধীনতার ৩৬ বছরের মাথায় দাঁড়িয়ে এ কথা আজ নির্দ্বিধায় স্বীকার করতে হবে যে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে মুজিবনগর সরকারের সামগ্রিক অবদান জাতি হিসেবে আমরা যথাযথ মর্যাদা ও সম্মানের আসনে বসাতে অপারগ হয়েছি৷ মুজিবনগর সরকারের যথাযথ মূল্যায়ন আমরা করতে পারিনি৷ কোনো কোনো মহল থেকে সৈয়দ নজর”ল ও তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে পরিচালিত মুজিবনগর সরকারকে অকার্যকর ও উদ্যোগহীন এক সরকার হিসেবে পরিচিত করাতে চায়৷ কোনো কোনো মহল মুক্তিযুদ্ধকে সর্বব্যাপী রাজনৈতিক গণসংগ্রাম হিসেবে না দেখে সেনাযুদ্ধ হিসেবে চিত্রায়িত করে মুজিবনগরের রাজনৈতিক সরকারকে মূল্যয়ণে প্রয়াসী হয়৷ কোনো কোনো মহল থেকে মুজিবনগর সরকারকে ভারতের পুতুল সরকার হিসেবে কালিমা লেপন করতে সচেষ্ট থাকে৷
বলার অপেক্ষা রাখে না, এসব প্রচার করা হয় বিশেষ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য৷ প্রকৃতপক্ষে মুজিবনগর সরকার ছিল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জনে সফল এক সরকার৷ ঠাণ্ডা যুদ্ধ যুগে জাতীয় ও আনত্মর্জাতিক জটিল ও ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ পরিস্থিতিতে স্বাধীন জাতি-রাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা জনগণের সশস্ত্র গণসংগ্রামকে এই সরকার স্বাধীনতার চূড়ানত্ম লক্ষ্যে পেঁৗছাতে সক্ষম হয়েছে৷ এই সরকার প্রবাসে থেকে এমন কোনো সমস্যা ও জটিলতা সৃষ্টি করেনি কিংবা দানা বাঁধতে দেয়নি যা লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাসত্মবায়নের পথে বিঘ্ন ঘটেছে৷ বাধা-বিঘ্ন ও জটিলতা সামাল দিয়ে ৯ মাসের মধ্যে হানাদার বাহিনীমুক্ত স্বাধীন দেশ এই সরকার উপহার দিয়েছে৷ এই নিরিখেই মুজিবনগরের প্রবাসী সরকার পূর্ণাঙ্গরূপে সফল ও সার্থক৷
বাসত্মব বিচারে মুজিবনগর সরকারের অবদান নিয়ে যথাযথ মূল্যায়ন ও প্রচার হয়েছে বেশ কম৷ এই সরকার কোনো দলীয় সরকার ছিল না; যথার্থ অর্থেই তা ছিল একটি জাতীয় সরকার৷ জাতীয় সরকারের চরিত্র বজায় রাখার জন্য যথাযথ প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছিল বলেই এই সরকার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাসত্মবায়নে সফল হতে পেরেছিল৷ এই সরকারের বিভিন্নমুখী কাজ পর্যালোচনা করলেই বুঝতে পারা যাবে, ছত্রখান অবস্থা থেকে কিভাবে এই সরকার সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যাভিমুখী এক পরিকল্পনার মধ্যে মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে গিয়ে সফলতায় পেঁৗছে দিয়েছে৷
রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন গ্র”পকে যথাসম্ভব ঐক্যবদ্ধ করা মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের ছিল অন্যতম প্রধান শর্ত৷ এই সরকার সুকৌশলে এই ঐক্যের একটা রূপ দেয়৷ এই সরকারের প্রচেষ্টায় গঠিত হয় প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ৷ আওয়ামী লীগ একক দল হিসেবে সবকটি আসনে বিজয়ী এবং অপর দলগুলোর কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই, এই যুক্তি দেখিয়ে আত্মম্ভরিতা ও দলীয় সংকীর্ণতার পথে যায়নি মুজিবনগর সরকার৷ যদিও এমন মনোভাব আওয়ামী লীগের মধ্যে ছিল তবুও মুজিবনগর সরকার তাকে আমল দেয়নি৷ র”শপন্থী, চীনপন্থীসহ সকল দল ও গ্র”পকে দল-ধর্ম-মতনির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ করার লক্ষ্য নিয়েই মাওলানা ভাসানী, মণি সিংহ, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ ও মনোরঞ্জন ধরকে উপদেষ্টামণ্ডলীতে নির্বাচিত করা হয়৷
প্রবাসে সীমাবদ্ধতা ও আর্থিকসহ নানাবিধ সংকটের মধ্যে থেকেও মুজিবনগর সরকারের কূটনৈতিক তত্পরতা ছিল অসামান্য৷ চীন-মার্কিন-পাকিসত্মান অক্ষশক্তির চরম বিরোধিতা সত্ত্বেও বিশ্ববাসী ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর সমর্থন ও সহানুভূতি আদায় ও সাহায্য প্রাপ্তি ছিল মুক্তিযুদ্ধ বিজয়ের অন্যতম প্রধান শর্ত৷ এই কাজটি অত্যনত্ম পরিকল্পিতভাবে সুচার”রূপে অগ্রসর করে নেয় মুজিবনগর সরকার৷ একদিকে মার্কিন-চীন চাপ সামলানো আর অপরদিকে ভারত-সোভিয়েত ও গণতান্ত্রিক বিশ্বের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সমর্থন ও সাহায্য নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ ত্বরান্বিত করতে মুজিবনগর সরকার যে কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছে, তা অতিমাত্রার প্রশংসার দাবি রাখে৷ কৌশলগত কারণে কুচক্রী খন্দকার মুশতাককে পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেখে মুজিবনগর সরকারের কূটনৈতিক সাফল্য ছিল সত্যিকার অর্থেই বিস্ময়কর৷
মুজিবনগর সরকারের গঠন, কাঠামো ও কার্যাবলী পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, প্রবাসে নানা সীমাবদ্ধতা ও সংকটের মধ্যে থাকা সত্ত্বেও সরকার সামরিক-বেসামরিক প্রশাসনকে সুচার”রূপে পরিকল্পিতভাবে গুছিয়ে তোলে৷ যথাযথভাবেই বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থা গঠন এবং তা সক্রিয় করা হয়৷ পরিকল্পনা কমিশন, শিল্প-বাণিজ্য বোর্ড, ত্রাণ পুনর্বাসন কমিটি, শরণাথর্ী কল্যাণ বোর্ড সবকিছুই চালু করে পূর্ণাঙ্গ সরকারের রূপ প্রদান করা হয়৷ বিশ্ববাসীর সমর্থন আদায়ে ও জনগণের আস্থা সুরক্ষায় তা প্রভূত ভূমিকা রাখে৷ আঞ্চলিক প্রশাসনকেও তখনকার সময়ের উপযোগী ও সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য থেকে চালু করা হয়৷ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রণালয়, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়, তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়ের তত্কালীন ছোট-বড়ো কাজগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে কতোই না দেশপ্রেম, একাগ্রতা ও সততা নিয়ে নানা বাধা-বিঘ্ন ও সংকট সত্ত্বেও মুজিবনগর সরকার সুপরিকল্পিত কাজ অগ্রসর করেছিল৷
এ ক্ষেত্রে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রচারের বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়৷ শব্দসৈনিকদের একত্র ও উত্সাহিত করে দেশবাসী মনোবল দৃঢ় ও ঐক্যবদ্ধ রাখতে এই কেন্দ্র যে ভূমিকা পালন করেছে, তা মুজিবনগর সরকারের অক্লানত্ম প্রচেষ্টার ফলেই সম্ভব হয়েছে৷ সার্বিক বিচারে বলতেই হবে, মুজিবনগর সরকার যদি সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনকে গুছিয়ে কার্যকর না রাখতো তবে ডিসেম্বরে বিজয়ের পর আইনশৃঙ্খলা বজায় রেখে প্রাথমিক পুনর্বাসন ও পুনর্বাসনের কাজ যথাযথভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব হতো না৷ লাখ লাখ শরণাথর্ী আর সেই সঙ্গে ভিটেমাটি ছেড়ে দেশের অভ্যনত্মরে থাকা লাখো-কোটি জনগণকে পুনর্বাসিত করার প্রাথমিক কাজটা ছিল মুজিবনগর সরকারের ধারাবাহিক কাজেরই সাফল্য৷
পাকিসত্মানি কারাগারে বন্দী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জীবন রক্ষা এবং তাকে মুক্ত স্বদেশের মাটিতে ফিরিয়ে আনা ছিল প্রবাসী তাজউদ্দীন সরকারের বিশাল এক সাফল্য৷ আগস্টের প্রথমদিকে খবর প্রকাশ হয় যে, পাকিসত্মানের সামরিক আদালতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বিচার শুর” হবে৷ সঙ্গে সঙ্গে মুজিবনগর সরকার শুর” করে কূটনৈতিক তত্পরতা৷ ব্রিটিশ পার্লামেন্টের ১৫০ জন সদস্য তার নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করে৷ যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেস পাকিসত্মানে সাহায্য বন্ধ করার প্রসত্মাব পাস করে৷ ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহও বিশ্ববাসীকে এই বিচারের বির”দ্ধে দাঁড়ানোর জন্য মুজিবনগর সরকার সর্বোতভাবে তত্পরতা পরিচালনা করে৷
প্রসঙ্গত, বঙ্গবন্ধুর বিচারকে কেন্দ্র করে ত্রয়ী কুচক্রী খন্দকার মুশতাক, তাহের উদ্দিন ঠাকুর ও মাহবুব আলম চাষী ষড়যন্ত্র-চক্রানত্মের জাল বিসত্মার করে৷ স্বাধীনতা চাও নাকি মুজিবের প্রাণরক্ষা ও মুক্তি চাও_ এই প্রচারণা দেশবাসী বিশেষত প্রবাসী বাঙালিদের ভিতর ছড়ানো হয়৷ এমনকি বঙ্গবন্ধুর প্রাণ ও মুক্তির বিনিময়ে সমঝোতা করার প্রসত্মাব দিয়ে ঐ ত্রয়ী কুচক্রীর উদ্যোগ ও প্ররোচনায় প্রচারপত্র বের করা হয়৷ এই অবস্থায় মুজিবনগর সরকার দৃঢ় অবস্থান নিয়ে ঘোষণা করে যে, বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসি দেওয়া হলে, মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে বন্দী পাকিসত্মানি সব সৈন্যকে খতম করা হবে৷
মুজিবনগর সরকারের উপরোক্ত কাজগুলো ছিল ওতপ্রতভাবে জড়িয়ে এবং একটি ছিল অপরটির পরিপূরক৷ কোনো এক ক্ষেত্রে যদি দুর্বলতা কিংবা ব্যর্থতার ছিদ্র সৃষ্টি হতো তবে এই ছিদ্র দিয়ে বিষধর সাপ ঢুকে সবকিছুকে লণ্ডভণ্ড করে দিতো৷ ভারত-সোভিয়েত অক্ষশক্তির আস্থা ও অকুণ্ঠ সমর্থন লাভ করা তখন বাসত্মবেই সম্ভব হতো না৷ যথাসময়ে যথাযোগ্য সাহায্য-সহযোগিতা পাওয়া এবং তা কাজে লাগানো যেমন আর্ট, তেমনি বিজ্ঞানসম্মত৷ দেশপ্রেম, মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বাসত্মবায়নে একাগ্রতা ও দৃঢ়তা, আনত্মর্জাতিকভাবে শক্তির ভারসাম্য পক্ষে রাখার অপূর্ব নীতি ও কৌশল, জনগণ ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখার নমনীয়তা ও দক্ষতা, শক্তি সংহত রাখতে ধৈর্য ও মেধার সম্মিলন প্রভৃতি মুজিবনগর সরকারকে সাফল্য এনে দিয়েছিল৷
ব্যর্থ হওয়ার কোনো সুযোগ ঐ সরকারের ছিল না৷ সীমাবদ্ধতা-দুর্বলতা যদি কিছু থেকেও থাকে তবে তা ছিল পরিস্থিতির অনুষঙ্গ৷ যথাসাধ্য ভালোই যথার্থ ভালো আর আরো ভালো থাকে অকর্মণ্য ও দাম্ভিকের অক্ষম ঈর্ষায়৷ মুজিবনগর সরকার সত্যিকার অর্থেই আমাদের দেশের ইতিহাসের স্রষ্টা জনগণের চেতনা ও তত্পরতার তাত্পর্যমণ্ডিত ফসল৷ যাকে কখনো বাংলাদেশের জনগণের গৌরবমণ্ডিত মুক্তিযুদ্ধ থেকে পৃথক করা যাবে না৷ আমাদের জাতি-রাষ্ট্রের উত্সে তা সদাসর্বদা স্বগৌরবে সুপ্রতিষ্ঠিত থাকবে৷
মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্বে আসীন জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর একানত্ম ও বিশ্বসত্ম সহযোগী জাতীয় চার নেতা অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও সশস্ত্র বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক সৈয়দ নজর”ল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ও অপর দুই মন্ত্রী মনসুর আলী ও কামার”জ্জামান ঘাতকের নিষ্ঠুর বুলেটে জেলখানায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন৷ দুর্ভাগ্যের পরিহাস হলো, মুজিবনগর সরকারের অপর মন্ত্রী খন্দকার মুশতাক ছিলেন এই ৪ নেতা হত্যার হুকুমের পরিকল্পনা ও আসামি৷ মুশতাক মীরজাফর বিশ্বাসঘাতক এটা আজ স্বীকৃত কিন’ তাজউদ্দীন আহমদসহ জাতীয় চার নেতার যোগ্য মর্যাদা ও সম্মান জাতি হিসেবে এখনো আমরা স্বীকার করে নিতে পারিনি৷ এই স্বীকৃতি ও সম্মান প্রদান করা ছাড়া রক্তঋণ আমরা শোধ করতে পারবো না৷ জাতীয় বীরদের সম্মানিত না করে কোনো জাতি মের”দণ্ড সোজা করে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সক্ষম হয় না৷ কাউকে বড়ো কিংবা ছোট করে সামনের দিকে অগ্রসর হওয়া যায় না৷ মুজিবনগর সরকারকে জাতীয় ইতিহাসের সঠিক ও যথার্থ স্থানে বসানোর সংগ্রাম অব্যাহত থাকুক_ এটাই আজকের দিনের কামনা৷
১৬ এপ্রিল, ২০০৭
শেখর দত্ত : রাজনীতিক, কলাম লেখক৷

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




