আকাশ সংস্কৃতির আগ্রাসন নিয়ে রচনা শিখেছি
ছোটবেলায়। আকাশ সংস্কৃতির কুফল নিয়ে এখন লিখতে বললে ছোট বেলার মুখস্থ শেখাটা
অনেকটা সেকেলে হয়ে যাবে।আকাশ সংস্কৃতির বর্তমান হাল দেখে ভবিষ্যৎ বাতলানো অনেকটা
সায়েন্স ফিকশন লেখার মত হয়ে দাঁড়িয়েছে । আমার মনে আছে কয়েক হাজার তরুণ প্রজন্মকে
সামনে নিয়ে বছর কয়েক আগে চট্টগ্রাম ইঞ্জিনিয়ার্স ইনিষ্টিটিউট মিলনায়তনে নোবেল জয়ী
ড মুহাম্মদ ইউনুসের সেই ফুল ছড়ানো ভাষণের কথা। ফুল ছড়ানো বলছি এই জন্যে যে তাঁর
পুরো ঘন্টাখানেকের বক্তৃতায় হাতে তালি ছাড়া কেউ অভিবাদন জানায় নি। বুঝলাম নোবেলটা
এমনিতেই কেউ হাতে এসে তাঁকে দিয়ে যায় নি।
তিনি তরুণ সমাজকে আগামী ৫০ বছর পরের বাংলাদেশ
নিয়ে সায়েন্স ফিকশন লিখতে অনুরোধ করেছিলেন ।তিনি আরো বলেছিলেন - আমি হলফ করে বলতে
পারি আগামী ৫০ বছরের পরের বাংলাদেশ তোমাদের লেখা সায়েন্স ফিকশন থেকে ভিন্নতর ও
অধিক অগ্রসর বাংলাদেশ হবে।
বাংলাদেশে আকাশ সংস্কৃতির আগ্রাসন নিয়ে সায়েন্স
ফিকসন আমি লিখব না।কারণ আগ্রাসনটা আরো বহু ব্যাপকতা পাবে। তবে আমি আকাশ সংস্কৃতির
বিবিদ কুফল নিয়ে আমি সংকিত। পুস্তকে পড়া অপসংস্কৃতির আগ্রাসন থেকেও এটা ব্যাপক।
আজকের বাংলাদেশে ডিস এন্টেনার শহর থেকে গ্রাম
অবধি অবাধ বিচরণ করছে।
কৃষক থেকে সমাজের সর্ব স্তরের মানুষরা বিনোদন
হিসেবে টেলিভিশন দেখছে। যেখানে ডিস এন্টেনার মতো অবাধ বিনোদনের কাছে বিটিভি হেরে যাচ্ছে
প্রতিনিয়ত । ব্যাপারটা তবুও খারাপ হতো না যদি ডিস এন্টেনার এসব চ্যানেল গুলো বাংলাদেশী
হতো। ঢাকায় বসে ডিস লাইনে যে চ্যানেলগুলো দেখা যায় তা ২৮০ কিলোমিটার দূরে আমার গ্রামেও
দেখা যায়। অঁজপাড়া গা’য়ে বিদেশী চ্যানেলের
সংস্কৃতি পরিবর্তনটা অবুঝ এসব মানুষদের কেমনে বুঝাবেন। যেখানে শহুরে শিক্ষিত
বালক-বালিকা থেকে শুরু করে কর্মজীবি- গৃহিনীরা পর্যন্ত বিদেশী আনন্দদায়ক অনুষ্টানে
মশগুল হয়ে নিজের সংসারকে সেভাবে সাজাতে মনোযোগ দিচ্ছেন সেখানে বাকীদের বুঝানো
নিরর্থক।
বাংলাদেশী আনন্দ পিয়াসু এসব মানুষরা বিদেশী
অনুষ্ঠানে ঝুঁকে পড়ার প্রবণতাটা বাড়ার অন্যতম কারণ বাংলাদেশী বেসরকারী টিভি চ্যানেলগুলোর
প্রয়োজনীয় আনন্দদায়ক অনুষ্ঠানের অভাব। বাংলাদেশী
এসব বেসরকারী টিভি চ্যানেলগুলোর আনন্দদায়ক অনুষ্ঠান বলতে খবর,টক সো,গুটিকয়েক নাটক
আর পুরানো কিছু সিনেমা-যেখানে বয়স ভিত্তিক অনুষ্ঠানের বড়ই অভাব। কিন্তু বিদেশী চ্যানেলগুলোতে
ছোটদের জন্য কার্টুন থেকে শুরু করে টিনেজদের জন্য এডভেঞ্চার সিনেমা-খেলা,
গৃহিনীদের জন্য সিরিয়াল , পুরুষদের জন্য খেলা-সিনেমা-এডাল্ট প্রোগ্রাম । কী দেখানো
হয় না এসব চ্যানেলে ? কিন্তু সে হিসেবে বাংলাদেশী চ্যানেলগুলো সময়ের সাথে তাল
মেলাতে পারে নি। তবে বর্তমানে কিছু চ্যানেল ভিন্নধর্মী অনুষ্ঠান চালু করছে। তবে তা
পর্যাপ্ত নয়।
বিদেশী অনুষ্ঠানের প্রতি ঝুঁকে যাওয়া এসব
বাংলাদেশী দর্শক এখন আন্তর্জাতিক ক্রেতা হিসেবে দাঁড়িয়েছে। এসব পণ্য ও সেবা
প্রদানকারীর কাছে পণ্য মার্কেটিংয়ের ব্যাপারটা আর দেশ কেন্দ্রিক নয়।
১৭ কোটি মানুষের বাংলাদেশের এই বাজার ধরার জন্য
মুখিয়ে আছে বাইরের দেশগুলো।দেশীয় বিনোদনের বিপর্যয়ে বিদেশী চ্যানেলগুলোয় যেসব বিজ্ঞাপণ
দেখানো হয় তার জন্য দেশকেন্দ্রিক মার্কেটিংয়ের আর তেমন প্রয়োজন নেই। মেয়েদের
প্রসাধনী থেকে শুরু করে চকলেট পর্যন্ত সবকিছুই বিদেশী বিজ্ঞাপণে আমরা কিনে নিচ্ছি
দেদারসে যেমন-গার্নেয়ার, লিভন,নিভিয়া, মেন্টস ইত্যাদি। কিন্তু আমাদের বিনোদন
প্রেমীরা যদি বিদেশী চ্যানেল নির্ভর না হত
কিংবা তা দেশে নিষিদ্ধ হত তবে এসব পণ্যের বিজ্ঞাপণ করার জন্য ওসব কোম্পানী গুলো
আমাদের দেশীয় টিভিগুলোতে বিজ্ঞাপণ দিতয়ে বাদ্য হত ।লাভবান হত দেশীয় মিডিয়া। এতো
বললাম এখনকার পরিস্তিতির কথা।তবে মূল শঙ্কাটা এই জায়গায় নয়।
বর্তমানে বাংলাদেশী অনেক পণ্য তৈরীকারী ও
সেবাদানকারী অনেক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে বিজ্ঞাপণ দেয়া কমিয়ে ভারতের চ্যানেলগুলোতে
দেয়। উদাহারণ- প্রাণ। তাদের টার্গেটটা ভিন্ন। তারা দুই দেশে বিজনেসের সুবিধার্থে
বিজ্ঞাপণ গুলো ভারতীয় চ্যানেলে দেয়। তার অন্যতম কারণ বাংলাদেশের বেশীরভাগ মানুষ ভারতীয়
চ্যানেল দেখে অভ্যস্ত। কদিন পর হয়তো তারা বাংলাদেশে কোন বিজ্ঞাপণই দিবে না-কারন
অনেক বাংলাদেশী নিজেদের চ্যানেলগুলোতে ঢু মারতে যায় না।যা সামনের দিনগুলোতে আরো
ব্যাপকতা পাবে। যার ধরুন বাংলাদেশী চ্যানেলগুলোর ভবিষ্যতে বিজ্ঞাপণ পাওয়াটা দূরুহ
হয়ে উঠবে।যার ফলস্রুতিতে বাংলাদেশী পণ্য সেবাদানকারীরে মুখোমুখী হবে চায়না কিংবা
ভারতের মত কম মূল্যের পণ্য ও সেবার কাছে হেরে যাবে। ধবংসে পতিত হবে আমাদের
ইন্ডাষ্ট্রি গুলো।
আর ইন্টারনেট ভিত্তিক সমাজে
ইউটিউব,গুগল,জিমেইল,ফেইসবুক যে হারে পণ্য বিজ্ঞাপণে নেমেছে তাতে দেশের টাকা গুলো আমরা
বিদেশীদের অনায়াসে দিয়ে দিচ্ছি। আইপি
এড্রেস চেক দিয়ে আমার দেশের বিজ্ঞাপণগুলো তারা আমাদের দেখিয়ে টাকাটা
তাঁদের(গুগল,ইউটিউব,ফেইসবুক ইত্যাদি) পকেটে পুরে নিচ্ছে , সেটা কী আর বলতে ? আমরা
যতই ইন্টারনেটের প্রতি ঝুঁকে যাচ্ছি ততই আমাদের পয়সাগুলো তাদের পকেটে যাবে। চায়না
তাই তাদের ১৩০ কোটি মানুষের বাজারে আদৌ কাউকে ডুকতে দিচ্ছে না। এজন্য তারা নিজেদের গুগল,ইউটিউব,ফেইসবুক
ইত্যাদি আলাদা ডোমেইনে নিজেরাই সার্ভিস দিচ্ছে। নিজের টাকা নিজেরাই রেখে দিচ্ছে।
বাংলাদেশ সরকারের এমন একটি পদক্ষেপ নেয়ার চেষ্টা করা উচিত।
জনপ্রিয় আকাশ সংস্কৃতির এই যুগে কিংবা ইন্টারনেট
ভিত্তিক সমাজটাকে সময় থাকতে সরকারের কব্জায়
না আনলে ফলাফলটা যে নিহাত নিজের পায়ে কুঁড়াল মারার মত হবে তা সময়ই বলে দিবে ।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই জুলাই, ২০১৫ রাত ১১:০৩