রাহেলার আজ খুশি থাকার কথা, কারন সে আজ বেতন পেয়েছে, হাজিরা বোনাস দুই’শ টাকা আর ওভার টাইমের সাত’শ টাকা সহ পেয়েছে, তারপর ও তার মন ভাল নেই, কোনবার’ই বেতন পেয়ে সে খুশি হতে পারে না। সে কোনদিন কাজে যায়না এমন হয়না শরীর যতই ক্লান্ত থাকুক যতগুলি নাইট তার গার্মেন্টস এ হয় সবগুলো সে করে, আর ভাবে এমাসে হয়ত অসুস্থ মা, আর গ্রামে মায়ের কাছে থাকা তার একমাত্র ছেলেটির জন্য হয়ত কিছু টাকা বেশি পাঠাতে পারবে। কিন্তু বেতন যেদিন পাই সেদিন’ই তার মন খারাপ হয়ে যাই কারন সেই বেশির হিসাব আর সে মিলাতে পারেনা। সারা মাস ওভার টাইম করে সে যতটা না ক্লান্ত হয়ে পড়ে, এই টাকা হাতে পেয়ে হিসাব মিলাতে যেয়ে তার চেয়ে কয়েকগুন বেশি ক্লান্ত হয়ে পড়ে সে।
অনেকের কাছে মাসের শেষ দিনগুলো চালানো কষ্টকর হয়, কিন্তু তার কাছে বেতন পেয়ে টাকা ভাগ করার দিনগুলোর মত কষ্টকর দিন আর নাই। একবেলা খেয়ে বা না খেয়ে অনায়াসে দিন পার করে দিতে পারে, এতে তার অভ্যাস আছে কিন্তু দোকানদারের টাকা, বাড়িওলার বাড়িভাড়া, অসুস্থ মায়ের ঔষধ, আর তার একমাত্র আদরের ছেলের সাধের লেখাপড়ার খরচ না দিয়ে তো কোন ভাবে পার পাওয়ার উপায় নেই। বাড়িওয়ালা বেতনের দিন গলির মোড়েই দাড়িয়ে থাকে কোনভাবেই সেদিন তার হাত থেকে নিস্তার নেই। দু’একশ টাকা পর্যন্ত সামনের মাসের জন্য বাকি রাখা যায় না। একবার রাহেলার মায়ের অসুখ বেড়ে যাওয়ায় মাকে ডাক্তার দেখানোর জন পাচশটা টাকা বাড়িতে বেশি পাঠাতে চেয়েছিল। কিন্তু তার তো কোনদিকে বেশি পাঠাতে হলে কোনদিকে কম ফেলতে হবে, বেতনের দিন বাড়িওয়ালা যথারিতি গলির মাথায় দাড়িয়েছিল ভাড়ার জন্য। সে এনেক করে বাড়িওয়ালাকে বোঝাবার চেষ্ট করলো তার মায়ের অসুখ এমাসে সে পাচশ টাকা কম দিয়ে আগামি মাসে দিয়ে দেবে, বাড়িওয়ালা কোনভাবে রাজি হলোনা। তার কথা, তুই আগামি মাসে বেতন তো বেশি পাবি না তাহলে আমাকে দিবি কোত্থেকে? যেকোন ভাবে ম্যানেজ করে দেবে বলায় বলেছিল, ম্যানেজ করতে পারলে এ মাসেই ম্যানেজ করে পাঠা।
আসলে সে কোথা থেকে ম্যানেজ করবে তার সাথের সবার ই তো তার মত অবস্থা। তার মার জন্য আর পাচশ টাকা বেশি পাঠানো হয়না, শুধুই দীর্ঘশ্বাস ছাড়া ছাড়া তার আর কিছুই করার নেই।
এবারের সমস্যাটা তার চেয়ে বেশি, তার আদরের ছেলে কখনো তার কাছে কোন কিছুর জন্য আব্দার করে না, এবার ছেলে তার কাছে একসেট স্কুল ড্রেস চেয়েছে, এতদিন তার স্কুল ড্রেস লাগে নাই, ক্লাস সিক্সে ওঠায় তার স্কূল ড্রেস দরকার, তাকে নাকি প্রতিদিন স্কুল ড্রেসের জন্য কান ধরে বেঞ্চের উপর দাড় করিয়ে রাখে। এর পর নাকি ক্লাসে ঢুকতে দিবে না। সে আগে কোনদিন তার মাকে একথা জানাইনি। তার ছেলে লেখাপড়ায় ভাল রাহেলা তার ছেলেটিকে লেখাপড়া শিখাতে চায়, ছেলের বাবার ও খুব ইচ্ছা ছিল ছেলে লেখাপড়া শিখে বড় হবে তাদের মত গার্মেন্টস এ চাকরি করতে না হয়। লোকটার কথা তার এখন খুব মনে পড়েছে, লোকটা বেচে থাকতে টাকা পয়সা আহমরি না থাকলেও তারা সুখে ছিল এতটা সমস্যা তাদের ছিল না। তারা দুজনে চাকরি করত সংসার সুন্দর ভাবেই চলে যেত। সবদিনের মত একদিন সকালে তারা দুজন এক সাথে বের হয়ে যায়, রাহেলা ফিরে আসল কিন্তু লোকটা আর ফিরলনা। কারো সাথে পাছে না থাকা সহজ সরল মানুষটা গার্মেন্টেসের মালিক শ্রমিকের টানাটানিতে নিরাপদ অশ্রয়খুজতে যেয়ে পুলিশের গুলিতে মারা পড়ল।
ছেলে তাকে কয়েকদিন আগে ফোন করে বলেছে, “আমি তো তোমার কাছে কখনো কিছু চাইনা, তুমি আমাকে একসেট স্কুল ড্রেস বানিয়ে দাও, স্কুল ড্রেসের জন্য প্রতিদিন আমাকে কান
ধরে ক্লাসে দাড় করিয়ে রাখে, তাতে আমার একটু ও লজ্জা লাগে না, কিন্তু এখন বলছে ড্রেস ছাড়া ক্লাসে বসতে দিবেনা, তাহলে আমি পড়বো কিভাবে। আমি খোজ নিয়ে দেখেছি নরমাল কাপড়ের ড্রেস বানাতে ৬০০ টাকার মত খরচ হবে। তুমি যদি পার এই মাসে টাকাটা পাঠিও।”
ছেলের লেখাপড়া রাহেলা কোনভাবে বন্ধ হতে দিবে না, সে না খেয়ে থাকলেও ছেলেকে এমাসে টাকাটা পাঠাবেই, সে মনে মনে ভাবতে থাকে কিভাবে ৬০০ টাকা বেশি পাঠানো যায়, সে একটা বুদ্ধি বের করে, বাড়িওয়ালাকে মিথ্যা বলবে রাস্তায় তার টাকা ছিনতাই হয়ে গেছে, অনেকের’ই তো হয়, ব্যাপারটাকে বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য প্রয়োজনে সে নিজের শরীরে ব্লেড দিয়ে দু একটা পোচ দিবে, সে দোকান থেকে সাথে সাথে একটা ব্লেড কিনে তার হাত ব্যাগে রাখে।
তার মাথায় এখন আর অন্য কিছু নেই, সে তার ছেলেকে সামনে দেখতে পায়, স্কূল ড্রেস পরে ছেলে তার সামনে দাড়িয়ে, কত সুন্দর না লাগছে তার আদরের মানিককে, সে হাটতে থাকে আর ছেলেকে দেখতে থাকে।হঠ্যাত তার পাশ দিয়ে দৌড়ে এসে একলোক তার ব্যাগটা টান দিয়ে ছিনিয়ে নিয়ে যায়।রাহেলা কিছুক্ষন কিছুই বুঝতে পারে না, সে স্তব্ধ হয়ে যায়, ঠাই দাড়িয়ে থাকে।তার কাছে এখন শরীরে পোচ দেওয়ার জন্য ব্লেড কেনার টাকাও নেই। কিছুক্ষন পরে সে নিজে নিজেই হেসে ওঠে, যাক টাকা ভাগ করার মত কষ্টকর কাজটাতো তার এমাসে করতে হবেনা, এটাই বা তার জন্য কম কি!

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




