অভিবাসী বাঙালিদের কবিতা কীভাবে বেড়ে উঠছে, কতটা পার্থক্য তৈরি করছে বাংলাদেশের মূলধারার সাথে তা কিছুটা দেখার অবকাশ রয়েছে। প্রতিটি পরিবেশের নিজস্ব গন্ধ থাকে, থাকে এর স্বনির্ভর-নিষ্ঠা। এই ভিন্নতাকে বড় দাগে পরিবেশগত কারণ হিসেবে ধরা গেলেও ভাষা-সুর-মেজাজ খুব একটা বদলায়নি। তবু অভিবাসীর বেদনা এবং যে ভৌগলিক জগত থেকে তিনি উঠে এসেছেন সেই জায়গার মানুষজনের প্রাত্যহিক চাওয়া-পাওয়ার যথেষ্ট বৈপরিত্য বহন করে। বাংলাদেশের একজন কবি যেখানে কর্কষ-রাগী হয়ে উঠেন, একজন অভিবাসী সেখানে যথেষ্ট স্থির সার্চ-লাইটে দৃষ্টি রাখতে প্রয়াসী হন।
এসব বিষয়কে বিবেচনায় রেখে ‘অভিবাসী বাঙালি কবিদের কাব্যস্বরূপ’-কে তুলে আনার একটা ঝুকি নিতে হলো। প্রসঙ্গত বলে রাখি, প্রথমে ভাবনায় ছিল কেবল বিলেতে অবস্থানরত বাঙালি কবিদের কবিতা নিয়ে আলোকপাতে যাবো। এখন আর সেই ভাবনায় স্থির না থেকে একটু বৃহতভাবেই অগ্রসর হওয়ার সাহস যুগিয়েছি। ধারাবাহিকভাবে একজন বা কখনও দুজন-তিনজন করে আলোচনায় আসবো। এটি প্রাথমিক হোম ওয়ার্ক। গ্রন্থরূপে প্রকাশ করার সময় বিষয়টিকে পুনর্বিবেচনায় নেয়ার ইচ্ছে রাখি। আগাম ঘোষণা দিয়ে রাখি : পরবর্তী কবি নাহার মনিকা।
০১.
আহমদ ময়েজের কবিতার সঙ্গে বসবাস দুই দশকের উপরে। কিন্তু কোনো কাব্য গ্রন্থ নেই। করার ইচ্ছেটাও প্রবলভাবে দেখা যায় না। প্রতিবছরই আমরা অপেক্ষা করি আহমদ ময়েজের একটি কাব্যগ্রন্থ দেখতে পাবো। একটি পা-ুলিপি অনেকেই পাঠ করেছি ‘বিমূর্ত চরণে রাখি কলের ক্ষমা’। এই পর্যন্তই। তার কবিতার সঙ্গে পরিচয় ঘটে পত্রপত্রিকা-লিটলম্যাগ ইত্যাদির মাধ্যমে। কবিতা পাঠের আসরেও স্বকণ্ঠে কবিতা শোনার সুযোগ হয়েছে প্রচুর।
সেই আশির দশকের শেষের দিক থেকে শুরু করে বর্তমানে আহমদ ময়েজ-এর কবিতার চেহারায় কি কোনোভাবে রূপ বদল ঘটেছে? ’ইবলিসের চোখ’ কবিতাটির মাধ্যমেই আহমদ ময়েজের কবিতার সঙ্গে আমার পরিচয়। টানা গদ্যের আদলে, কোমল সুরের কবিতাটি যখন পত্রিকার পাতায় পড়ি খুব একটা আলাদা তো নয়ই বরং ৭০-৮০’র প্রধান কবিদের প্রচ-বলয় ধরেই তিনি অগ্রসর হতে চাচ্ছেন, এমত একটি ধারণা তৈরি হলেও আশাব্যাঞ্জক হতে আমি ভুল করিনি। একটা ছটপটানি তো ছিলই, সঙ্গে ছিল ইতিহাসলগ্ন-মিথলগ্ন ভাবাবেগে কাতর।
'চতুর্দিকের ঘন কুয়াশার চাদর ভেদ করে আমরা হেঁটে এলাম। আমাদের সঙ্গে কোনো অস্ত্র বা খাদ্য ছিল না। ছিল ধুলোয় ভরা একটি চাদর, আর চোখে মুখে দীর্ঘ পথ চলার ক্লান্তির ছাপ। আমাদের মনটা ছিল যাত্রাদিনের সূর্যালোকের মতোই নির্ভিক, প্রাণবন্ত। ক্লান্তি আমাদের বৃষ্টি-ভেজা-মেধা-হৃদয় স্পর্শ করতে পারেনি। আপাতত আমরা এটুকু জয় করেছি।'
এর পর একটু পরে উচ্চারণ করেন -
'আজ আমরা অনেকটা পথ চলে এসেছি - পুরাণ অনেক জিনিসের মতোই আমাদের প্রিয় সাথীদের রেখে, যাদের চোখ ইবলিশের দিকে ঘুরে গেছে।'
এখানে এসে তিনি বাঁক নিতে চেয়েছেন ভাষায়-কঠোরতায়। কিন্তু স্পষ্ট নয়। আশির দশকের এই কবিতাটির তুলনায় যখন নব্বইয়ে এসে তাঁর কবিতার মুখাবয়ব দেখি তখন একটি পোড়ামাটির গন্ধ উঠতে শুরু করেছে এবং খুব দ্রুত তার ভাষার ঋদ্ধতা প্রকাশ পেতে থাকে। এমন কি উপমারও কোনো ধারধানের বলে মনে হয় না। কখনও বাণীবদ্ধ হয়ে অগ্রসর হচ্ছে স্তবকের পর স্তবক। কবির ভেতর যে স্পর্ধা বাসাবাঁধলে একটি পরিণত সর্বনাশার দিকে অগ্রসর হতে দেখা যায় - কবি আহমদ ময়েজের কবিতা সেই আলোকেই হাঁটতে থাকে। এখন তিনি সেই ধারাবাহিকতার ভেতরই ’বাতাসে আগুনের জিব’ ধরে রেখেছেন। উচ্চারণ করছেন ‘কেটে দাও হে আলোর কিরিচ’। কবি নিজেকে এই ভাঙনের দিকে গড়িয়ে নেয়া খুবই জরুরি বলে বিবেচ্য।
'আমি তো খেয়েছি কবে আগুনের গান
ধাতুর গুড়া
যে আগুন বেঁধেছে আমার শৈশব-কৈশোর'
এর ভেতরই তার ভাষা ও চিন্তার বিবর্তন লক্ষ্যনীয়। তরুণ বয়সে যে পেলব সুর দিয়ে তিনি শুরু করেছিলেন, মধ্যবয়সে কবি হয়ে উঠেন স্পর্ধিত। মেঘের গম্বুজ স্পর্শ করতে করতে তার অভিলাষ নিম্নগামী না হলেও প্রিয়তমার পছন্দই তাকে ঝর্ণায় ডুবে থাকা পাথরের মুখ দর্শনে বাধ্য করে। এ ধরনের একটি স্পট-প্রচ্ছদ এঁকেছেন তার ‘স্বপ্নস্পৃষ্ট’ কবিতায়।
সবচে আলাদাভাবে সনাক্ত করা যায় ‘প্রবল উত্তাপ’ কবিতাটি। একটি ওঙ্কার নিয়ে তিনি চলে যেতে চান। আর ফেরার বাসনাও রাখেন না। মৃত্যুকে যখন কবি জীবনের আর দশটি কাজের অনুষঙ্গ ভেবে নিতে অব্যস্ত হয়ে যান ঠিক তখনই এ ধরণের উচ্চারণ মাটি ফেটে বেরিয়ে আসে। তিনি বলেন -
'কিছুই রবে না জানি ভেসে যাবে সব
ক্ষিপ্র ওঙ্কার শুধু বেজে ওঠে শার্লের বনে
কী এক অহংবোধ বারবার ছুড়ে দেয় ...
শানিত ক্ষুরের ঘা
তীব্র তীব্রভাবে ছুটে যায়।
চলে যাই পিছনে রেখে চটক এক
নুজ্য-সমাজ
বুড়োদের ধ্যানের চেয়ে ঢের ভালো সূর্য-খরা
কী ছিল মুঠোর ভেতর-স্বপ্ন-তরু
একরত্তি উত্তাপ ছাড়া কিছুই পাইনি খুঁজে
হাতের তালোয়।
শিল্পের পাহাড় যত উঁচু হয়
কেবলই বিভ্রম দেয়-ঘুমের আফিম।'
শিল্প দিয়ে শিল্পকে কাটাক্ষ করা, সেইতো শিল্পের কাছেই ফিরে আসা। ময়েজ কি সেটা বুঝেছেন? ‘শিল্পের পাহাড় যত উঁচু হয়/ কেবলই বিভ্রম দেয় - ঘুমের আফিম’। কবির পছন্দের জায়গাটাই এখানে দাঁড়িয়ে যায় শক্তিভাবে। তিনি শিল্পের কাছে পরাজয় মানতে রাজী নন আবার - আবর শিল্পেরই বিরুদ্ধে এক নন্দনপ্রবাহ দিয়ে ঔদ্ধ্যত হয়ে উঠেন।
কবি ’নগর‘ কবিতায় এই প্রবাস জীবনের নাগিরক যাতনায় অতিষ্ট হয়েও ‘সন্তানের জন্মভূমি’ লন্ডন নগরিকে ভালো-না-বেসে পারেন না। এবং অন্য এক বেদনায় উচ্চারণ করেন - ’আমার কোনো কাল নেই, দেশ নেই’। তারপর বলেন ‘প্রিয়তমার মুখই আমার দেশ’।
চেনাপথের বাইরে যাবার তাগিদ সততভাবে লালন করেন বলেই কবি আহমদ ময়েজের কবিতাকে স্বাতন্ত্রভাবে দেখতে হয়, দেখতে বাধ্য করে।
আহমদ ময়েজ-এর তিনটি কবিতা
ধ্বনি
তোমার চোখের ভাষায় বিদগ্ধ-পূরক ঐ
- প্রতিদিন ভাবিত করে, আর
স্রোতবাহী নদ এক ক্রমশঃ নাই হয় ঢেউয়ের তলায়
কুল খেয়েছি কবে -
সেই থেকে অসুর উঠে আসে দাবড়িয়ে শহর
সুর ও সাহস পালায় গঞ্জে গঞ্জে।
পুঞ্জিভূত হও
ঘনিভূত হও
মিলিত পদের ধ্বনি মিলিয়ে গেলে
তখনও আমাকে পাবে তূর্য হাতে দাঁড়িয়ে একা
পাথর শৃঙ্গে ...
প্রবল উত্তাপ
কিছুই রবে না জানি ভেসে যাবে সব
ক্ষিপ্র ওঙ্কার শুধু বেজে ওঠে শার্লের বনে
কী এক অহংবোধ বারবার ছুড়ে দেয় ...
শানিত ক্ষুরের ঘা
তীব্র তীব্রভাবে ছুটে যায়।
চলে যাই পিছনে রেখে চটক এক
নুজ্য-সমাজ
বুড়োদের ধ্যানের চেয়ে ঢের ভালো সূর্য-খরা
কী ছিল মুঠোর ভেতর-স্বপ্ন-তরু
একরত্তি উত্তাপ ছাড়া কিছুই পাইনি খুঁজে
হাতের তালোয়।
শিল্পের পাহাড় যত উঁচু হয়
কেবলই বিভ্রম দেয়-ঘুমের আফিম।
কালো মৃত্তিকা কেটে তুলে আনি সোনার দানা
জমাতে চাইনি কোনো ছটাকপ্রমাণ;
যদি বা উপোষ রয় স্বজন আমার-
এটুকু পুরাণ ছাড়া আর কিছু ভাবায়নি আজও।
গোপন রবে না কিছু-
সূর্যতাপে হেঁটে যাবো, রাত্রিকে বলেছি সেদিন;
এই দিন অপাংতে রয়ে যাবে আরো কিছু কাল
তারপর প্রবল বিম্ব হয়ে ফিরে যাবো নতুনের কাছে।
স্বপ্নস্পৃষ্ট
এই পথ নিয়ে যাবে বহুদূর, সঙ্গে যাবে তুমি - উষালগ্ন-পরিন্দা
ডানায় ধরেছে শত পবনরে হাড়, ঝোলাভর্তি রাত, গ্রিবার উপরে দেখো চন্দ্র-হাসি
পিঠ ভর্তি কলঙ্করে দাগ।
আমি প্রায় ছুঁয়ে ফেলি মেঘের গম্বুজ, তুমি খুব ভালোবাসো
র্ঝণায় ডুবে থাকা পাথররে মুখ।
স্বপ্নস্পৃষ্ট হও দ্রবণে-দ্রোহে
পথ আরো র্দীঘ হোক - গ্যালাক্সরি পাড় ধরে রুয়ে যাবো কয়কে ফোটা
শুভ্র-বনোজ।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই মার্চ, ২০১০ সকাল ৯:৫৩

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




