ঢাকা, ১৯ মে (শীর্ষ নিউজ ডটকম): হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক ব্রাড এডামস বলেছেন, বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে ১৯৭১ সালের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিশ্বাসযোগ্য বিচার করার একটা সুবর্ণ সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এ বিচারের মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকার বিশ্বদরবারে একটা নজির স্থাপন করতে সক্ষম হবে। তবে চলমান আইনে সংশোধনী আনয়ন ছাড়া কোনো অবস্থাতেই বিচার প্রক্রিয়া আন্তর্জাতিক মানের হবে না। আর বিচার প্রক্রিয়ায় ত্রুটি থাকলে বাংলাদেশের ভেতরে এবং বাইরে তথা আন্তর্জাতিকভাবে এ বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে আস্থাহীনতা দেখা দেবে। যার পুরো সুবিধা নেবে ৭১'র মানবতাবিরোধী অপরাধীরা। যদি সরকারের সদিচ্ছা থাকে তাহলে সরকার এবং ট্রাইব্যুনাল খুব সহজেই সেদিকটাতে নজর দিতে পারে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ মনে করে, নিরপেক্ষ বিচার করার জন্য আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন, আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন এবং বাংলাদেশ সংবিধান অনুযায়ী ন্যায়বিচার করতে হলে কিছু আইন ও বিধানের সংশোধন করা প্রয়োজন।
আজ বৃহস্পতিবার ব্রাড এডামস প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিকট পাঠানো এক চিঠিতে ট্রাইব্যুনালকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার জন্য ৭টা সুপারিশ করে বলেছেন, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বরাবর মৃত্যুদণ্ডের বিপক্ষে। তিনি যুদ্ধাপরাধী মামলায় কাউকে মৃত্যুদ- না দেয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তাদের মতে,যেকোন বিচারে এ ধরনের শাস্তি মৌলিক মানবাধিকার পরিপন্থী।
চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িতদের বিচার করতে বাংলাদেশ সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছে সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে ভিকটিমদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এটাকে সময়োত্তীর্ণ প্রক্রিয়া বলেই মনে করে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেয়া পত্রে সংস্থাটি বলেছে যে, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ বিচার প্রক্রিয়ায় তাদের জোর সমর্থন রয়েছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের অধীনে এ পর্যন্ত ৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। যদিও তাদের বিররুদ্ধে এখনো পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ পেশ করা হয়নি। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ৫ জন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষস্থানীয় নেতা। আর বাকি দুইজন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) নেতা। গ্রেফতারকৃতদের প্রত্যেকেই জামিনের জন্য আবেদন করেছেন। কিন্তু আদালত শুধু ৮২ বছর বয়সী আবদুল আলীম ব্যতীত অন্য সবারই জামিন আবেদন প্রত্যাখ্যান করেন। দেশ ছেড়ে পালাবেন না এ শর্তে সরকারের নিকট পাসপোর্ট জমা দেয়ার পর আবদুল আলীমকে তার ছেলের তত্ত্বাবধানে জামিন দেয়া হয়।
১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচনে আওয়ামী জয়লাভ করলেও তৎকালীন সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিতে অস্বীকার করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতেই সূত্রপাত ঘটে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের। ২৬ মার্চ ইয়াহিয়া তার সেনাবাহিনীকে পূর্ব পাকিস্তানে পাঠান এবং আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতার করতে শুরু করেন অপারেশন সার্চলাইট। শুরু হয় ব্যাপক দমন-নিপীড়ন। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও এর সহযোগী অন্যান্য বাহিনী মিলে ব্যাপক ধর্ষণ ও গণহত্যাসহ সহিংসতার মহাযজ্ঞ শুরু করে। এতে নিহত হয় প্রায় ৩ লাখ থেকে ৩০ লাখ লোক। প্রায় ১ কোটি লোক বাস্তুহারা হয়ে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে পালিয়ে যায়। পরবর্তীতে ভারতীয় সেনাবাহিনী ইয়াহিয়া বাহিনীর এ দমন-নিপীড়নে হস্তক্ষেপ করে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলে। মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় বাহিনীর সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অবশেষে পশ্চিম পাকিস্তানের পরাজয় ঘটে। ১৬ ডিসেম্বর জন্ম হয় স্বাধীন বাংলাদেশ নামের একটি নতুন দেশের।
পরে যুদ্ধাকালীন হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষিতে এতে যারা সহযোগিতা করেছিল তাদের বিচারের অধীনে নিয়ে আসতে নতুন সরকার ১৯৭২ সালে গঠন করে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল। ১৯৭৩ সালে স্বাধীন দেশের পার্লামেন্ট পাস করে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন। তবে রাজনৈতিক বিবেচনায় তখন আর এ বিচার করা সম্ভব হয়নি।
পরবর্তীতে ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে প্রচার অভিযানের মোক্ষম সুযোগ হিসেবে কাজে লাগায়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে ব্যাপক সাড়াও পায়। ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে এবং বিচারের তালিকা থেকে পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা ও সাধারণ সৈন্যদের বাদ দেয়া হয়।
সমপ্রতি বাংলাদেশ সফরকালে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর যিয়াদ আল মালুমের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। তখন উভয়েই বলেছিলেন যে, ট্রাইব্যুনাল যাতে আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখে সে ব্যাপারে তারা অঙ্গীকারাবদ্ধ। এ সময় আইনমন্ত্রী বিচার প্রক্রিয়া আরো উন্নত করার লক্ষ্যে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও অন্যান্য সংস্থার পরামর্শকে স্বাগত জানায়। ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর জানান যে, তার অফিস ইতিমধ্যে তথ্য প্রমাণ সংগ্রহ ও সাক্ষীদের সাক্ষাৎকার শুরু করে দিয়েছে।
ব্রাড অ্যাডামস জানান, স্বাধীনতাযুদ্ধকালে বাংলাদেশে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধ ও এর ভিকটিমদের সংখ্যা বিগত চার দশকে পুরো বিশ্বই পর্যবেক্ষণ করেছে। তবে আনন্দের বিষয় হলো ট্রাইবুনাল সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বিচার প্রক্রিয়ার অগ্রগতিতে যে কোনো পরামর্শ গ্রহণের জন্য প্রস্তুত এবং আন্তরিকতার সাথে তদন্তও শুরু করেছে। তিনি বলেন, সরকার ও ট্রাইব্যুনাল যদি ট্রাইব্যুনালের কিছু অসঙ্গতি দূর করে তাহলে তাদের এ উদ্যোগ আন্তর্জাতিক মহলের পূর্ণ সমর্থন পাবে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানায় সরকার ইতিমধ্যে ১৯৭৩ এর আইনে কিছু সংশোধনী এনেছে। এর মধ্যে রয়েছে ট্রাইব্যুনালে সামরিক জজের পরিবর্তে বেসামরিক জজ নিয়োগ করা এবং ট্রাইব্যুনালের বিচারকার্য পরিচালনায় স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। ২০১০ সালে গৃহীত কার্যবিধি ট্রাইব্যুনালকে আন্তরিকতার সাথে কাজ করার সমর্থন দিয়েছে।
তবে ১৯৭৩ এর আইনে সরকারের সংশোধনীর ব্যাপারে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, ট্রাইব্যুনালের বিচারকার্য যে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বাধ্যবাধকতা, আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন এবং বাংলাদেশের সংবিধান অনুসারে পরিচালিত হচ্ছে সেটা নিশ্চিত করার জন্য ট্রাইব্যুনালে আরো কিছু সংশোধনী আনা দরকার। যদিও ১৯৭৩ এর আইন অনেকাংশেই তৎকালীন আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী করা হয়ছে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন ও এর প্রয়োগের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য বিকাশ ঘটেছে। সাবেক যুগোশ্লাভিয়া ও রুয়ান্ডার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল, সিয়েরালিওনের বিশেষ আদালত এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতসহ বেশকিছু আন্তর্জাতিক আদালতে পরিচালিত বিচার প্রক্রিয়ায় জটিল কেস মোকাবেলায় কিছু মানবিক বিচার প্রক্রিয়া সৃষ্টি ও মূল্যবান অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষ হিসেবে বাংলাদেশকে সেসব বিচার প্রক্রিয়া ও অভিজ্ঞতা বিবেচনায় আনতে হবে। তাহলেই ট্রাইবুনাল ও এর বিচার প্রক্রিয়া আন্তর্জাতিক মানের হবে বলেও জানায় হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেয়া পত্রে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ কিছু সমস্যার প্রতি সরকারের মনোযোগ কামনা করেছে সেগুলো হলো_
প্রথমত, যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যা সংশ্লিষ্ট সংজ্ঞাগুলো আরো স্পষ্ট করার জন্য অপরাধের সংজ্ঞা দেশীয় অথবা আন্তর্জাতিক আইনে ঘটনা ঘটার সময় যেভাবে ছিল ঠিক সেভাবে সংশোধন করা।
দ্বিতীয়ত, ট্রাইবুনাল গঠন ও এর সদস্য নিয়োগে যে কোনো চ্যালেঞ্জ গ্রহণের জন্য আইন সংশোধন করা।
তৃতীয়ত, অভিযুক্তদের সঠিক প্রক্রিয়া অবলম্বনের অধিকার বাংলাদেশের আইনগত বাধ্যবাধকতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কি না তা নিশ্চিত করতে আইন ও বিধি সংশোধন করা।
চতুর্থত, অভিযুক্তদের সাংবিধানিক অধিকারের পূর্ণ সুরক্ষা বিশেষ করে ৪৪ ধারার অধীনে তাদের মৌলিক মানবাধিকার রক্ষায় বাংলাদেশ সংবিধানের ৪৭(ক) ধারা প্রত্যাহার করা।
পঞ্চমত, ভিকটিম এবং সাক্ষীদের জন্য কার্যকর ও সুচিন্তিত সুরক্ষা পরিকল্পনা প্রণয়ন করা। বিশেষ করে বিচারকার্যের আগে, চলাকালে ও বিচার শেষে তাদের সুরক্ষা ও সহায়তার প্রতি নজর দেয়া।
ষষ্ঠত, সমতার ভিত্তিতে বাদী ও বিবাদী পক্ষ উভয়ের অধিকার নিশ্চিত করা।
সপ্তমত, আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে ট্রাইব্যুনালের এখতিয়ারের অধীনে বিচারকার্য পরিচালনায় প্রসিকিউটর ও জজদের সংশ্লিষ্ট কারিগরি সহায়তা প্রদান করা।