এমন একজনের জন্য মন খারাপ হলো যাকে কিনা আমি তেমন ভাল করে চিনিওনা। জীবনে দেখেছি একবার। ভদ্রলোকের বাড়িতে গিয়েছিলাম আম্মার সাথে। তিনি তখন পা ভেংগে পড়ে আছেন বিছানায়। আমাদের দূর সম্পর্কের কেমন যেন আত্নীয় হন। আমি সাধারনত আত্নীয়-স্বজনের বাড়ি যেতে পছন্দ করিনা। ফরমাল সব প্রশ্নত্তোরের পর আমি আর কথা খুঁজে পাইনা। ছোটকাল থেকে বইয়ের জগতে থাকায় বাস্তবের মানুষের সাথে কেমন যেন খেই হারিয়ে ফেলি কথা বলতে গেলে। কিন্তু সে বাসায় গিয়ে বেশ আনন্দ হল। ভদ্রলোকের রুমে তিন দেয়ালে লাগানো সিলিং পর্যন্ত লাইব্রেরী। ঠিক যেভাবে আমি আমার ভবিষ্যত বাসা কল্পনা করি! আমার অবস্থা হলো অনেকটা সমরেশের সেই লাইনের মত, যে এক ফোঁটা ভালবাসার জন্য বুকভরা পিপাসা নিয়ে আছে, তার সামনে হঠাৎ যদি এক সমুদ্র ভালবাসা এনে দেয়া হয়, তার অবস্থা কেমন হবে? তার অবস্থা কেমন হবে জানিনা, আমার অবস্থা হল শেষ পর্যন্ত বাসার মহিলাদের সাথে আম্মার গাল-গপ্প যখন ফুড়ালো, আমাকে আর কিছুতেই টেনে আনতে পারেন না। আমি বার বার বলি, আরেকটু, দাদু'র সাথে আরেকটু কথা বলি।
ছোটকালে আমার জীবনের লক্ষ্য খুব ঘন ঘন বদলাতো। আজকে দেশের প্রথম মেয়ে পাইলট হতে চাইতাম তো কালকে আবার ভাবতান, নাহ ডাক্তার হব। কিন্তু পরশু মেডিকেলের পড়া খুব কঠিন তাই ভাবতাম অন্যকিছু হব। এই দাদুকে দেখে মনে হচ্ছিল, নাহ, আমি বরং আব্বা আর আম্মা কে পটিয়ে অনেক টাকা পয়সা নিয়ে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের জন্য ডে-কেয়ার সেন্টার বানাবো। তখন সারাদিন বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের জীবনের অভিজ্ঞতা শুনতে পারব।
লাইবেরীটা মোটেও শো-অফের জন্য না, ভদ্রলোক আসলেই এত্ত জানতেন! আমি সেদিন উনার সাথে কথা বলে বার বার খেই হারাচ্ছিলাম। এমনকি আম্মার সাথে আমার মানসিক দুরত্বকেও কীভাবে যেন আন্দাজ করে ফেললেন। শোনালেন উনার টীনেজ সময়ের কত কথা, তখন বাবা-মার সাথে সন্তানের রিলেশান ছিল অন্যরকম। অনেক ভাইবোন থাকত। পাড়াপ্রতিবেশী। তাই একেকটা সম্পর্কে যে গ্যাপ থাকে সে গ্যাপ অন্য কেউ ভরে দিত। যার কারনে উনারা বড় হয়েছেন মানসিক পরিপূর্ণতা নিয়ে, আমাদের মত দৈন্যতা নিয়ে না। আমি তখন ভাবছিলাম বিয়ের পর আমি এক গন্ডা বাচ্চাকাচ্চা নিব, যেন আমার সাথে যদি আমার সন্তানের কোন গ্যাপ থাকে, তাহলে ওরা ভাইবোনরা তা ভরে নেবে। কিন্তু ভদ্রলোক আমার চিন্তায় হেসে বললেন, 'তখন মা বাবা দের জন্য এতগুলো বাচ্চা নেয়া সহজ ছিল কেনো জানো? কারন তখন আমাদের জীবন ছিল হরাইজন্টাল। এখনকার মত ভার্টিকাল না। তখন বাড়ির উপরে বাড়ি ছিলনা। বাড়ির পাশে বাড়ি ছিল। যার কারনে অনেকগুলো বাড়ি মিলে একটা বাড়ির মত মনে হত। নিজের মা ভাত খাওয়াতে ভুলে গেলে পাশের বাড়ির কাকী চাচী ভাত খাইয়ে দিত। কিন্তু এখনতো তোমাদের জীবন যত ভার্টিকাল হয়েছে তত ক্লাস-সেন্স বেড়েছে। তোমাদের বয়সী ছেলে-মেয়েরা এখনই ক্যারিয়ারের কত চিন্তা ভাবনা। প্রতিবেশীর ছেলে-মেয়েদের সাথে পাল্লা দেয়া। আমাদের সময় অত ভাবনা ছিলনা। ক্ষেত খামার-ই মেইন ভরসা ছিল। আর সচ্ছল হলেই চলে যেত।'
উনার কথাগুলো এখনো আমার কানে বাঁজে। খবর পেলাম গত সপ্তাহে তিনি মারা গিয়েছেন। মন তাই ভাল নেই। পৃথিবী থেকে এইসব অভিজ্ঞতায় ভরা মানুষগুলো চলে যাচ্ছেন। থেকে যাচ্ছি আমরা। কিন্তু আমরা কি আমাদের পরের জেনারেশনকে এভাবে জীবনের কথা শুনিয়ে যেতে পারবো? মনে হয় পারবনা। কারন আমরা যে কমার্শিয়ালের যুগে পড়ে গিয়েছি। কাঁদামাটিতে গড়াগড়ি দেয়া, রোদ-বৃষ্টিতে ভেজা, পুকুরে দাপাদাপি করা জীবনের মানুষগুলোতে সব চলেই যাচ্ছেন একে একে।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



