সবসময় শেলফের ঐ তাঁকে ঔষধের শিশিটা রাখেন মা। হাতের কাছে এবং সহজেই নজরে পড়ে এমন একটি জায়গা, তাই ওখানে ঔষধের শিশিটা রাখেন তিনি। ঔষধটা অবশ্য তার নিজের জন্য নয়। এতদিন কোলে পিঠে করে তীল তীল করে বড় করে তোলা ফুটফুটে ছোট্ট ছেলেটির জন্য। ডাক্তারের পরামর্শক্রমেই ঔষধটা নিয়মিত খাওয়াতে হচ্ছে।
স্বামী বিদেশে থাকেন। একমাত্র ছেলেটিকে পরিপুর্ন মানুষ করে গড়ে তুলতে তার চিন্তার অন্ত নেই। সচেতন পিতামাতা হিসেবে সন্তানকে শুধু সুশিক্ষিতই নয় স্বশিক্ষিত করে গড়ে তুলতে রাজধানীর একটি ক্যাডেট মাদ্রাসায় ভর্তি করে দিলেন। সুন্দর ফুটফুটে চমৎকার ও আকর্ষনীয় চেহারার কারনে মাদ্রাসার বার্ষিক ক্যালেন্ডারের প্রচ্ছদে মুনাজাত রত অবস্থায় ওর ছবিটাও স্থান করে নিল। এমন ছেলেকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে কোন বাবা-মা পিছ পা হন?
সেদিন ক্ষেতে কীটনাষক ছিটিয়ে কৃষক যখন কীটনাশকের শিশিটা ফিরিয়ে দিয়ে গেল তখন মা ছিলেন খুব ব্যাস্ত। কাজ ছেড়ে দম ছাড়ার সময়টুকুও পাচ্ছিলেন না। তাই কৃষক থেকে কীটনাশকের শিশিটা নিয়ে তাড়াহুড়ো করে হাতের কাছেই ঐ শেলফের তাঁকে রেখে আবার কাজে চলে গেলেন। এমন সময় একমাত্র আদরের সন্তানটি খেলেদুলে ফিরে এল। মা তাকে ভাত বেড়ে দিয়ে আবার কাজে চলে গেলেন। যাবার সময় বলে গেলেন মনে করে যেন ঔষধ খেয়ে নেয়। ছেলেও মায়ের কথায় মাথাটা এক দিকে কাত করে সায় দিল। মা নিশ্চিন্তে আবার কাজে মন দিলেন।
কাজ করতে করতে মা মুহুর্তেই কাজের মাঝে হারিয়ে গেলেন। নিশ্চিন্তে কাজ করেই চলেছেন। দুনিয়ার কোন কিছুতেই তার কোন খেয়াল নেই। এমন সময় ছেলের বুক ফাটা চিৎকার শুনে চমকে উঠলেন। বুকের কোথাও যেন ধক করে উঠলো। মনে হতে লাগলো এখানকার বাতাসে হঠাৎই অক্সিজেনের ভাটা পড়েছে। স্বাস প্রস্বাসে কোন কাজ হচ্ছে না। সকল কাজ দুপায়ে ঠেলে দিয়ে দৌড়ে গেলেন ছেলের কাছে। চারিপাশের সকল কিছুই যেন কেমন ঘোলাটে হয়ে গেল তার কাছে। কারন ছেলের এই চিৎকারের সাথে তিনি মোটেই পরিচিত নন।
দৌড়ে ছেলের কাছে পৌছে দেখলেন দুধে আলতা মাখা প্রান প্রিয় ছেলের গোটা শরিরটা কেমন যেন নীল হয়ে গেছে। কিছু বুঝে উঠতে না পেরে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে এক অজানা আসংকায় ও ভীত কন্ঠে জিজ্ঞেশ করলেন কি হয়েছে। অনেক কষ্টে ছেলেটি জানালো ঔষধ খাওয়ার পর থেকেই বুকটা জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে। মা মুহুর্তেই দিশাহারা হয়ে গেলেন। ঔষধের শিশিটার দিকে তাকিয়ে হতভম্ব হয়ে গেলেন। কিংকর্তব্যবিমুড় মা। মাথার সকল চিন্তা চেতনা বুদ্ধি বিবেক এক সাথে যেন লোপ পেল। কিছুই খেলছে না মাথায়। কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না। তবে যততুকু বুঝলেন তা হল কলিজার ধন যেই শিশিটা ঔষুধের শিশি ভেবেছিল সেটা ছিল কীটনাষকের ঐ শিশিটা।
মায়ের পায়ের নীচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে, অথৈ সাগরে প্রান-পন হাতড়ে কোন উপায় খুজে পাচ্ছেন না। এদিকে ছেলের অবস্থা তাকে ক্রমেই অজানা আশংকায় বিদ্ধ করছে। ছেলেকে তিনি বুকের মাঝে জাপটে ধরে আছেন। যত ঝড় তুফানই আসুক না কেন তাকে হারাতে চান না তিনি। সব শেষে আকাশ বাতাশ কাঁপিয়ে মা নিজেও চিৎকার করে উঠলেন “কে কোথায় আছ আমার সোনামনি কে বাচাও” চারদিক থেকে লোক জন ছুটে এল। ছেলেকে নিয়ে তৎক্ষনাত হাসপাতালে ছুটলেন সবাই মিলে। ডাক্তার সব পরিক্ষা করে জানালেন “সে আর নেই”
এটা গল্প নয়, সত্যি। আমার জানা অন্যতম হৃদয়বিদারক ঘটনা। ঢাকার আততাহযীব ক্যাডেট মাদ্রাসার ছাত্র ছিল ছেলেটি।
ভুলটা নিতান্তই ছোট এবং আকারে তীল পরিমান, আর সেটা হল যথাকার বস্তু তথায় না রাখা। কিন্তু তার মাশুলটা অনেক বড় ও সর্বোচ্চ। ঐ মা বোধ করি আজও বেঁচে আছেন। কিন্তু যখনি তার সৃতিতে ঐ দিনের কথা ভেষে উঠে তখন নিশ্চই নিজেকে ক্ষমা করতে পারেন না কিছুতেই।
আমাদের অনেকেই সমাজের ও দেশের তথা গোটা বিশ্বে চলমান চরম অসঙ্গতি ও দুরাচার দেখে আশ্চর্যে ভ্রুকুঞ্চিত করে প্রশ্ন করেন “কেন এমন হয়” বা “সমস্যাটা কোথায়?” অনেকে অনেক দিকে ইঙ্গিত করেন। কিন্তু সন্তোষজনক কারন অনেকেই খুজে পান না। সম্ভবত প্রায় কেউই খুজে পান না।
আসলে ভুলটা খুব বড় কিছু নয়। একটি অতি ছোট ভুল যা সকল ক্ষেত্রেই আমরা করছি বা করতে বাধ্য হচ্ছি। আমাদের ভালোবাসা, প্রেম, সাহস, আবেগ, অনুভুতি, আনন্দ-উচ্ছাস, উৎসব-উল্লাস, অহংকার, রাগ, অভিমান, ঘৃনা, দেশ প্রেম ইত্যাদি সকল কিছু যথাকার বস্তু তথাকায় ব্যবহার করা হচ্ছে না। এই সব কিছু আমরা আমাদের মত করে ব্যবহার করতে পারছি না। আমাদের এইসব কিছু কোন না কোন গোষ্ঠি বা দলের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। আকারে ইঙ্গিতে, সরাসরি বা একটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে, আমাদের এই সকল আচরন গুলোকে প্রভাবিত করা হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য। আর যার কারনে অন্যের করা পাপের দায়ে আমরাও দন্ডিত হই। অন্যের ভুলের মাশুল আমাদের গোটা জাতিকে একসাথে দিতে হচ্ছে।
উদাহরন স্বরুপ বলা যেতে পারে যে, আমাদের প্রেম-ভালোবাসা যেটা সৃষ্টি কর্তা আমাদেরকে দিয়েছেন প্রথমত তাঁকে ভালোবাসতে, তার পর তাঁর প্রেরিত রাসুল (স) কে ভালোবাসতে এবং তার পর জন্মদাতা পিতামাতাকে ভালোবাসতে। কিন্তু আমাদের এই প্রেম-ভালোবাসা ব্যবহৃত হচ্ছে কোন এক ছেলে বা মেয়ের পেছনে। যার কারনে আমরা আল্লাহ ও তার রাসুলের সাথে এবং নিজের বাবা-মায়ের সাথে পর্যন্ত বেইমানী করছি।
এভাবে আর সকল বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তা করলে দেখা যাবে সবগুলোই যেথায় থাকার কথা বা যেভাবে মুল্যায়িত হবার কথা ঠিক তার উল্টোটা হচ্ছে। আর একারনেই সামষ্টিক ভাবে আমাদেরকে বিরাট মাশুল গুনতে হচ্ছে। আমাদের দেশ-প্রেম কোন নির্দিষ্ট মানব রচিত আদর্শের খোরাকে পরিনত হয়েছে। তারা যেভাবে চাচ্ছে সেভাবেই এটাকে প্রভাবিত করছে। ওরা ধার্মিকদের দেশ প্রেম নিয়ে খেলে “দেশ প্রেম ঈমানের অংগ বলে প্রচার করে” নাস্তিকের দেশ প্রেম নিয়ে খেলে “দেশমাতার প্রতি অসিম ঋনের কথা বলে” এভাবে আরও অনেক পথে অনেক ধাচে ওরা আমাদের অনুভুতি নিয়ে খেলে আর জুয়ার খেলায় জিতে সহাস্য বদনে ঘরে ফিরে যায়। মোট কথা উপরতলার এলিট সোসাইটি আমাদের আবেগ-আনুভুতি, প্রেম-ভালোবাসা, সহ সকল আচরন গুলোকে নিয়ে খেলছে। তারা যেভাবে চাইছে সেভাবে এগুলকে প্রভাবিত করছে আর আমরা অন্ধের মত তর্ক-বিতর্কে বা রাজ পথে, ঘৃনায় বা হানাহানিতে লিপ্ত হচ্ছি আর আমাদেরই হাতে রক্তাক্ত হচ্ছে আমরই ভাই।
লেখাটি আমার বর্নমালা ব্লগে পড়েছিলাম

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



