রিমন মাহফুজ
প্রাচীনতম ঐতিহাসিক অঞ্চল কাপাসিয়ায় প্রথম রোপন করা হয় খ্যাতিমান আপেল বড়ই। ১৯৪৫ সালে ভারতের দার্জিলিং থেকে কাপাসিয়া অঞ্চলের তরগাঁও ইউনিয়নের চিনাডুলী গ্রামের জনৈক মোসলেহ উদ্দিন ভূইয়া একটি আপেল বড়ই চাড়া নিজ বাড়ীতে প্রথম রোপন করেন বলে বয়স্ড়্গ লোকজনের কাছ হতে জানা গেছে। এখান থেকে ধীরে ধীরে দেশব্যাপী আপেল বড়ই বংশ বিস্তার লাভ করে।
এদেশের প্রখ্যাত দার্শনিক দেওয়ান মুহাম্মদ আজরফের তথ্য মতে ১৯৯৪ সালে কাপাসিয়া অঞ্চলের একমাত্র সাপ্তাহিক শীতল্যা পত্রিকায় ‘‘প্রাচীনতম ঐতিহাসিক অঞ্চল কাপাসিয়া’’ শীর্ষক প্রবন্ধে প্রবীন সাংবাদিক শেখ তমিজ উদ্দিন আহম্মদ খোকা’র লেখা থেকে জানা যায় পাক ভারত উপ মহাদেশের অন্যান্য ঐতিহাসিক অঞ্চলের চেয়ে কাপাসিয়া অঞ্চলের সভ্যতা গড়ে উঠে খৃষ্ঠ পূর্ব থেকে।
বিশ্বখ্যাত মসলিন কাপড় উৎপাদনের অঞ্চল ছিল আজকের কাপাসিয়া। কার্পাস তুলা থেকে উৎপাদিত হতো এক ধরনের মিহি সুতা। সেই সুতা দিয়েই তৈরি হতো বিশ্ব বিখ্যাত মসলিন কাপড়। সেই কার্পাস তুলার নামানুসারে কাপাসিয়া নামের উৎপত্তি।
এক সময় গাজীপুর জেলার জয়দেবপুর, শ্রীপুর, কালীগঞ্জ, নরসিংদী জেলার বেলাব, মনোহরদী ও পলাশ থানা ছিল কাপাসিয়া থানার অন্তর্গত। সেই থেকে কাপাসিয়া থানা সদর ছিল একটি শহর। সেই সময় হতে কাপাসিয়া শহরের আশপাশে চাহিদানুযায়ী কার্পাস তুলার পাশাপাশী উৎপাদিত হতো ধান, পাট, ইক্ষু, কলা, আম, তেতুল, আনারস, কাঁঠাল, তামাক ইত্যাদি ফসল ও ফল।
ভাগ্যক্রমে খ্যাতিমান সুস্বাদু আপেল বড়ই উৎপাদন শুরু হয় এই কাপাসিয়া অঞ্চল থেকে। ভারতের দার্জিলিং থেকে সখ করে আপেল বড়ই চাড়া এনে নিজ বাড়ীতে রোপন করেন চিনাডুলী গ্রামের মোসলেহ উদ্দিন। বড়ই ধরার পর এলাকার মানুষ সখ করে এর নাম রাখে করমচা বড়ই। কেউ কেউ একে বলতো টুইল্লার বড়ই। স্থানীয় উপজেলা কৃষি সম্প্রসারন অফিস কর্তৃক এই বড়ইটির গুনাগুন রং সাইজ বিবেচনা করে এর নাম রাখেন আপেল বড়ই।
আপেল বড়ই’র গুনাগুনঃ ১) আপেল সাদৃশ্য, দৃষ্টি নন্দন সৌন্দর্য, মিষ্টি ও সু-স্বাদু। ২) শাস কচকচে কষহীন। ৩) বেশী সময় সংরন মতা। ৪) প্রতি বছর প্রচুর ফল দেয় এবং সাধারণ বাতাসে ঝড়ে পড়েনা। ৫) খরা, বন্যা, জলাবদ্ধতা ও লবনাক্ত মাটিতে সহনশীল। ৬) বানিজ্যিকভাবে চাষ করা সহজ এবং বাজার মূল্য বেশী। ৭) বীজ ছোট ও শাস বেশী। ৮) রোগ বালাই প্রতিরোধ মতা বেশী। ৯) কলম রোপনের ৬ মাসেই প্রচুর ফল পাওয়া যায়। ১০) পাকা ফল ঝড়ে পড়েনা। ১১) অন্যান্য বড়ই থেকে এর পুষ্টিগুন বেশী। ১২) দেশব্যাপী চাহিদা প্রচুর। রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক অর্থ আয় করা সম্্ভব। ১৩) প্রতিটি বড়ই গড় ওজন ৩০-৫০ গ্রাম।
রোপন পদ্ধতিঃ বীজ থেকে উৎপাদিত চাড়া রোপন করলে আশানুরূপ ফল পাওয়া যায় না। আসল আপেল বড়ই পেতে হলে কলম সংগ্রহ করতে হবে। কাপাসিয়া উপজেলা উপ সহকারী কৃষি কর্মকর্তা দীর্ঘদিন গবেষণা করে কলম তথা বার্ডিং পদ্ধতি আবিস্ড়্গার করেছেন। আসল আপেল বড়ই গাছের ডালা হতে সায়ন সংগ্রহ করে যে কোন জংলী বড়ই গাছে বার্ডিং বা কলম দিয়ে বংশ বিস্তার করা হয়। বর্তমানে নার্সারী ব্যবসায়ীরা জংলী বড়ই বীজ হতে চাড়া তৈরি করে তাতে আপেল বড়ই গাছের সায়ন বার্ডিং করে টবে পলিথিনে চাড়া করে বাজারজাত করে অতি দ্রুত বংশ বিস্তার করছেন। এসব চাড়া বাগান তৈরিতে ১২ ফুট x ১২ ফুট দুরত্বে রোপন করতে হবে। ৩ ফুট x ৩ ফুট গর্তে ২৫ কেজি গোবর ২৫০ গ্রাম টিএসপি, ১০০ গ্রাম পটাশ, ৫০০ গ্রাম জিপসাম সার মাটির সাথে মিশিয়ে ১৫ দিন পর চাড়া রোপন করতে হবে। রোপনের পর খেয়াল রাখতে হবে যে স্থানে কলম দেয়া এর নীচের অংশে কোন কুশি গজিয়ে উঠলে তা কেটে ফেলতে হবে। প্রতি বছর মার্চ মাসে গাছ ছাটাই করতে হবে। তাহলে গাছের শক্তি-সৌন্দর্য বৃদ্ধি পাবে এবং ফলের গুনাগুন দিন দিন ভাল হবে। প্রতি বছর মে-জুন মাসে গাছের গোড়া থেকে সামান্য দুর দিয়ে ৪/৫ ইঞ্চি গর্ত করে পরিমিত খাদ্য বা সার দিয়ে সেচ দিতে হবে।
রোগ বালাইঃ আপেল বড়ই গাছে তুলনামুলক পোকার আক্রমন কম হয়ে থাকে। লিফ সুপার ও ফুট বোরারের আক্রমন দেখা দিলে অনুমোদিত মাত্রায় সাইফার মিথিয়ন গ্রুপের কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে। তাছাড়া এন্থাকনেস রোগের আক্রমন হলে অনুমোদিত মাত্রায় টিল্ট নামক ছত্রানাশক ঔষধটি ব্যবহার করা যেতে পারে।
আপেল বড়ই গাছ রোপনের ২য় বছর থেকেই বানিজ্যিকভাবে ফল আহরন করা যায়। ৪ বছরের একটি গাছ থেকে কমপক্ষে ২০ কেজি ফল পাওয়া যায়। প্রতি কেজি ৫০ টাকা হিসেবে ১ হাজার টাকা ১টি গাছ থেকে আয় হবে। বর্তমানে মৌসুমের প্রথম আপেল বড়ই’র বাজার মূল্য থাকে প্রতি কেজি ৮০-৯০ টাকা। শেষ মৌসুমে এর দাম বৃদ্ধি পেয়ে ১৫০-২০০ টাকা হয়।
কম সময়ে সহজ উপায়ে আপেল বড়ই একটি লাভজনক চাষ। আপেল বড়ই বাংলাদেশের কৃষি খাতে খুলে দিয়েছে অপার সম্ভাবনাময় স্বর্ণদুয়ার। আমদানিকৃত আপেল, আঙ্গুরের ভারে আপেল বড়ই হচ্ছে এদেশের সর্বস্তরের মানুষের উল্লেখযোগ্য শীতের পুষ্টিমান ফল। ১ একর জমিতে একটি আপেল বড়ই বাগান থেকে ৪ বছরের মধ্যে বছরে পাওয়া যাবে ৩ ল টাকা এবং ৭ বছরের মধ্যে বছরে ৬ ল টাকা আয় করা সম্্ভব। কাপাসিয়ার আপেল বড়ই এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিস্তার লাভ করেছে। দিন দিন এর বংশ বিস্তার লাভ করছে। ইতিমধ্যে কাপাসিয়া ও শ্রীপুর উপজেলার শত শত চাষী আপেল বড়ই চাষ করে অর্থনৈতিকভাবে আশাতীত লাভবান হয়েছেন। সরকারীভাবে এ সম্ভাবনাময় ফলটির উৎপাদন প্রযুক্তি সারাদেশে প্রসার ঘটাতে পারলে একদিকে মানুষের পুষ্টির ঘাটতি পূরন হবে এবং অপরদিকে দেশ অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হবে। তাছাড়া রপ্তানীযোগ্য এ ফলটি রপ্তানী করে প্রচুর বৈদেশিক মূদ্রা অর্জন করা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশে প্রথম কাপাসিয়ায় আপেল বড়ই চাষ শুরু হয়
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
৫টি মন্তব্য ২টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন্যায়ের বিচার হবে একদিন।

ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন
আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন
মিশন: কাঁসার থালা–বাটি
বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন
আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন
J K and Our liberation war১৯৭১


জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।