somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হঠাৎ স্বর্ণকেশী! পর্ব-৭

২৪ শে অক্টোবর, ২০১৮ রাত ১০:৩১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আগের পর্ব (৬)

এই নীল টুপি ক্রাচকন্যা নির্জলা গুল মারছে কি না কে জানে। আমি যেরকম গবেট ধরনের, তাতে যে কেউ ঢালাওভাবে গুল মেরে পার পেয়ে যেতে পারে। কিন্তু গুল হোক আর নাই হোক, খুব জানতে ইচ্ছা করছে, লতা টুকটাক কোন বাংলা শিখে এসেছে কি না। চোখের তারায় কৌতুহলের ঝিলিক দেখে লতা ভুল-ভাল উচ্চারনে সে যে বাক্যটা বলল তাতে আমার পিলে চমকে গেল। পিলে কেন, পিলেদের বাপ-দাদারা থাকলে তাঁরাও চমকাতেন। কই আমি ভাবছি সে “এ্যাই মামা, জিগাতলা যাবা?” ধরনের কিছু একটা বলবে, তা না বলে লতা খুব সহজভঙ্গীতে বলল, “হাফ কেজি করাল্লাহ্ ডাও। টীটাহ্ ডেখে।“ এর চেয়ে যদি বলত, “নোয়াখালি বিভাগ চাই” তাহলেও এত ভড়কে যেতাম না। লতার টীটাহ্ করাল্লাহ্ আমাকে নিমেষে ঘায়েল করে ফেলল। হো হো করে হেসে গড়িয়ে পড়ার দশা। লতা সামান্য আহত হয়ে তাকালো। তাতে হাসি চওড়া হয়ে একান-ওকান হয়ে গেল। কোক পড়ে তখনো আধভেজা শার্টের বুকপকেট চেপে হাসতে থাকলাম।

খুব এক দফা হেসে যখন ভালো করে চোখ মেললাম, দেখি লতা মন্ত্রমুগ্ধের মত কি যেন দেখছে। তার চাহনির হদিস করতে গিয়ে দেখলাম, দৃষ্টিটা আমার দিকেই। অস্বস্তিতে পড়লাম। এই মেয়ে তো বাঙালি মেয়ের মত চোখে চোখ পড়তেই পলক সরিয়ে ফেলছে না। বরং তাকিয়েই আছে। ভালো জ্বালা তো! একে কি ফ্রাউ ক্যাথরিনের রোগে ধরল নাকি? খুক্ করে কেশে লতার ধ্যান ভাঙ্গানো চেষ্টায় বললাম “এত কিছু রেখে করল্লার পিছে লাগলে কেন?” বলেই বুঝলাম ভুল করে ফেলেছি। আপনি থেকে অনুমতিবিহীন তুমিতে চলে গিয়েছি। কিন্তু মনে হল, ধ্যাত, গুল্লি মারি এই আপনি-তুমির ফাও শিষ্টাচারে। বলেছি, বেশ করেছি।

লতার উত্তরে করল্লার বিহাইন্ড দ্যা সিন জানা গেল। তাদের ডাক্তারি দলটা ভোর সাতটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আন্ডা-বাচ্চা, ছাও-পাওদের টিকা দেয়ার কাজ করেছে। আর ফেরার পথে প্রায় প্রতিদিন সে ক্যাম্প লাগোয়া কাঁচাবাজারে গিয়েছে। তারপর রেস্ট হাউসে ফিরে সেখানের কিচেনে সবজি-টবজি সেদ্ধ কি হালকা তেলে ভেজে খেয়েছে। এই জার্মানগুলি পারেও বটে। পৃথিবীর যে প্রান্তেই যাক, কারো আশায় বসে না থেকে এরা নিজেদের মত সব গুছিয়ে নিতে জানে। আরো জানা গেল, করল্লা ছাড়াও এই পাগল মেয়ে প্রচুর পরিমানে পটল, ঢেঁড়স, কাঁকড়োল ইত্যাদি সাবড়ে দিয়ে এসেছে। যা যা সে এই খটোমটো জার্মান দেশে কোনদিন দেখে নি, তার সবটার স্বাদই সে আমাদের বঙ্গদেশে গিয়ে নিয়ে এসেছে।

ওদিকে লতা হাত নাচিয়ে মহানন্দে বলেই চলছে, ফিরে আসার আগের দুই দিন সে ঢাকায় এক ডাক্তার বন্ধুর হোণ্ডার পেছনে বসে খুব ঘোরা ঘুরেছে। পুরান ঢাকার আহসান মঞ্জিল, লালবাগ কেল্লা সব তার মুখস্থ। আমি আর বিস্ময় লুকিয়ে রাখার জায়গা পেলাম না যখন লতা জ্বলজ্বলে চোখে বলল, তার বাংলাদেশ ভ্রমনের সবচেয়ে বড় আবিষ্কার ঠাটারীবাজারে স্টারের কাচ্চি বিরানী। সেটা এক চামচ করে খেয়েছে আর কেঁদেছে। তারপর ঠান্ডা পানি গিলে পরের চামচটা মুখে নিয়েছে। যদিও ঝালের জ্বালায় সে পাঁচ-ছয় চামচের বেশি এগোতে পারে নি, কিন্তু তার কাছে নাকি মনে হয়েছে কাচ্চি একটা বেহেশতি খাবার। আমি লতার তারিফ শুনে বলেই ফেললাম, “অবশ্যই বেহেশতি খাবার। প্লেটের পর প্লেট কাচ্চি নামিয়ে কোলেস্টেরলের পারদ উচিয়ে পটল তুলে ফেললে তো আসলেই বেশ শর্টকার্টে বেহেশতে পগাড় পার হওয়া যায়। তখন আঙ্গুল হেলালেই সুন্দরী হুরপরি কিংবা সুদর্শন গেলেমান থালা কে থালা মৌ মৌ কাচ্চি নিয়ে হাজির হবে। তখন মজার উপর মজা।“ অবশ্য, এইখানে লতাকে হুরপরি আর গেলেমান সম্পর্কে একটা আবছা ধারণা দিতে হল। শুনে টুনে লতা রীতিমত ক্যাফে কাঁপিয়ে হাসলো। সত্যি বলতে, এর আগে এই বিদেশ বিভুঁইয়ে কারো সাথে এমন সহজভাবে কথা বলে আরাম পাই নি।

কফি ধোঁয়ায় বেশ কাটছিল সময়টা। অদ্ভূত লতা আর তার যত অদ্ভূতুড়ে গল্প। ওয়েটার ব্যাটার বিল নেবার তাড়ায় আমরা নড়ে চড়ে বসলাম। যে যার বিল মিটিয়ে দিলাম কোন রকম দ্বিরুক্তি ছাড়াই। কারণ, জানি বাধা দিয়ে লাভ নেই। জার্মান এই কুলটুর (কালচার আর কি) আমার ভালোই লাগে। হিজ হিজ হুজ হুজ। যার যার তার তার। নিজেরটা দিয়ে থুয়ে কিছু মিছু থাকে। পকেট একেবারে গড়ের মাঠ হয়ে যায় না।

বাইরে আগস্টের তুমুল দুপুর। বাড়িঘর-দোকানপাটের জানালায় ছোট ছোট টেবিল ফ্যান ঘুরছে। সূর্য নেমে এসেছে ঘাড়ের ওপর। বেগতিক দেখে লতার নীল টুপি হাতব্যাগে গা ঢাকা দিয়েছে। সুযোগ পেয়ে শাসন ছেড়ে নেমে আসা সোনালি চুলে অন্যমনষ্ক লতাকে মনে হচ্ছে যেন বহুদূরের কোন ভিনগ্রহের অচিন মানবী। চাইলেও যাকে চেনা দায়। এক মুহূর্তের জন্যে মুখ থেকে কথা হারিয়ে গেল আমার।

শূন্যে হাতড়ে কোনমতে গোটা কয়েক কথা খুঁজে পেলাম। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললাম, “এবার যে বাড়ির পথ ধরতে হবে। ভালো লাগল কথা বলে। সাবধানে চললে ভালো হয়। এদিকে তো বাস-ট্রাম কিছু নেই। যেতে অসুবিধা হবে না তো?“ কথাগুলি অনেক চেষ্টা করে আপনি-তুমি এড়িয়ে বললাম। লতা হাত দিয়ে সামনের দিকে ইশারা করে জানাল, তার বাসা খুব কাছেই। মিনিট পাঁচেকের হাঁটা পথ। আমার কাছেপিঠে কোথাও থাকা হয় কিনা। খেয়াল করলাম, তার কথাতেও আপনি-তুমি উহ্য।

রাস্তার ওপাশের পির্জাটার পাশের বাড়ির তিন তালায় আমার রাজত্ব। সাথে এক চীনা আর রাশিয়ান শরিকও আছে। শুনে লতা প্রস্তাব দিলো, এত কাছেই যখন থাকা হয়, তখন সপ্তাহ দুই পরের শনিবার বিকালে যাবো নাকি তার সাথে নদীর পাড়ে হাঁটতে। ততদিনে নাকি তার প্লাস্টার, মেডিকেল বুট ইত্যাদি থাকবে না। কিন্তু রুটিনমাফিক মিনিট চল্লিশেক হাঁটাহাঁটির অভ্যাস করতে হবে। ভাবলাম, সামনের মাসের চাকরিটা শুরু হবার আগে এমাসের বিকালগুলো এমনিতেও অলস বসে কাটত। তাছাড়া, হুল্লোড়প্রিয় চাইনিজ আর রাশিয়ান রুমমেটদের সাথে আমার মুখচোরা স্বভাবের কারণে “কি খবর, কেমন আছো’-এর” বাইরে তেমন একটা উঠ-বস নেই। অন্য বন্ধু-বান্ধব হয় পড়াশোনা, নয় চাকরির ধান্দায় ব্যস্ত। খালি আমিই আপাতত অবসর। তাছাড়া পুরো মিউনিখের ভেতর এই ইজার নদীর পাড়টা আমার প্রিয় একটা জায়গা।

ঠিক হল এই শনি বারের পরের শনিবার বিকাল পাঁচটায় নদীর দক্ষিণ পাড়ের সেতুটার কাছে দাঁড়িয়ে থাকবো। লতা ঠিক ঘড়ি ধরে পৌঁছে যাবে। মুঠোফোন নাম্বার চালাচালির এই অস্থির যুগে মুখের কথার এই বন্দোবস্তটা আমার মনে ধরল। এর ভেতর একটা অনিশ্চয়তা আছে। আর জগতটাই তো হাইজেনবার্গ সাহেবের অনিশ্চয়তার সূত্র দিয়ে ঘেরা। বেগ ঠিক থাকে তো অবস্থান ঠিক থাকে না। কিংবা উল্টোটা। দেখে যাক, শনিবারে নদীর পাড়ে লতার অবস্থান কেমন থাকে। হাত নেড়ে হেসে বিদায় নিয়ে পা বাড়ালাম বাড়ির পথে।

(চলবে)
১৬.১০.১৮
--ডঃ রিম সাবরিনা জাহান সরকারঃ মিউনিখ, জার্মানি
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে অক্টোবর, ২০১৮ রাত ১০:৩৪
৫টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সৎ মানুষ দেশে নেই,ব্লগে আছে তো?

লিখেছেন শূন্য সারমর্ম, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:৪৮








আশেপাশে সৎ মানুষ কেমন দেখা যায়? উনারা তো নাকি একা থাকে, সময় সুযোগে সৃষ্টিকর্তা নিজের কাছে তুলে নেয় যা আমাদের ডেফিনিশনে তাড়াতাড়ি চলে যাওয়া বলে। আপনি জীবনে যতগুলো বসন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×