somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হঠাৎ স্বর্ণকেশী!-১৭

১১ ই জানুয়ারি, ২০১৯ সন্ধ্যা ৬:২১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


জীবনে যতগুলো গল্প-উপন্যাস পড়েছি, তার কোনোটায় পড়িনি যে, নায়িকা নায়ককে ধরে টিটেনাসের টিকা দিয়ে দিচ্ছে। সব দোষ লতাদের ভাম আকৃতির বিড়ালটার। আর বাইরের ঝড়টাও দায়ী। নইলে এতক্ষণে ফ্রাউ কেলনারকে নিয়ে লতাদের বিদায় জানিয়ে রওনা দিয়ে দেওয়া যেত। ঠিক যাই যাই করছি, আর অমনি আকাশ ভেঙে ঝড় শুরু হয়ে গেল। লতারা ভাইবোন আর মা মিলে কিছুতেই আমাদের যেতে দিল না। আর এর ভেতরে ড্রাইভিং করাটাও বেশ কঠিন। অগত্যা অপেক্ষা ছাড়া আর গতি নেই আপাতত।

ড্রয়িংরুমে সবাই ঝিম মেরে বসে আছি। কেউ কোনো কথা বলছি না। কেবলই মনে হচ্ছে চলে গেলেই পারতাম। এই পরিবারটাকে শোক করার জন্য একটু একলা সময় দেওয়া উচিত ছিল। এর মাঝে আবার লতাদের বিড়ালটা এসে বারবার পায়ের কাছে লেজ ঘষছে। কাতুকুতুর মতো লাগছে। কিন্তু এমন পরিবেশে কী হাসা মানায়? কষ্ট করে গাল কামড়ে হাসি চেপে বিড়ালের অত্যাচার সহ্য করে যাচ্ছি। ইচ্ছে করছে, এটাকে ধরে একটা একটা করে মোছ টান দিয়ে তুলে ফেলি। কালকে রাতে দস্যুটা ঘাড়ে আঁচড়ে দিয়েছে। এখনো জ্বলছে। যদিও পাত্তা দিইনি। কিন্তু এখন মনে পড়তেই জ্বলুনি টের পেলাম। হাত চলে গেল ঘাড়ে। কলার সরিয়ে দেখলাম, পাঁচটা নখের ধারালো দাগ দগদগে হয়ে ফুটে উঠেছে।

ব্যাপারটা সোফায় লম্বা হয়ে শুয়ে থাকা লতার চোখে ধরা পড়ে গেল। লতা ম্যাক্সকে ইশারা করাতে ভালুক ম্যাক্স না দাঁড়িয়ে প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে এল। এক রকম জোর করে দাগটা পরখ করে নাটকীয় ভঙ্গিতে ঘোষণা দিয়ে দিল, ‘অনীকের টিটেনাসের টিকা লাগবে। কাঠমুন্ডু তো খামচে কম্ম কাবাড় করে দিয়েছে।’ থতমত খেয়ে গেলাম, বিড়ালের নাম কাঠমুন্ডু? ম্যাক্স হেসে উঠে বলল, ‘হ্যাঁ, বাবা মজা করে নাম দিয়েছিল কাঠমুন্ডু। cat-man-do থেকে কাঠমুন্ডু।’ বলেই ম্যাক্স জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। বাবার কথা মনে পরে গেল বোধ হয়।

কথা ঘোরানোর জন্য বললাম, আর মিনিট পনেরো অপেক্ষা করে আমরা আস্তে আস্তে উঠি। নইলে রাত হয়ে যাবে পৌঁছাতে। ম্যাক্স গ্রাহ্য করল বলে মন হলো না। বরং লতা শোয়া থেকে উঠে বসে ম্যাক্সকে আবার কী একটা ইশারা করতেই সে রান্নাঘরের ফ্রিজের দিকে হাঁটা দিল। ফিরে এল ছোট একটা অ্যাম্পুল আর ইনজেকশন নিয়ে। এদের ফ্রিজে মাছ-মাংসের সঙ্গে টিটেনাসের টিকাও থাকে নাকি? নড়েচড়ে বসলাম। সুচ মানেই হাত ফোটানো। হাত ফোটানো মানেই রক্ত অবধারিত। অনেকভাবে আপত্তি জানানোর চেষ্টা করলাম। লাভ হলো না। ম্যাক্স এমন ক্যাঁক করে ধরল! আর লতা ক্রাচে ভর দিয়ে উঠে এসে আমার হাতা গুটিয়ে স্বাস্থ্যবান মতো একটা রগ বের চাপ দিয়ে ধরে সুচটা ফোটাতে গেল। কিন্তু বিড়াল কাঠমুন্ডু ভিলেনের মতো দৌড়ে এসে কমান্ডো স্টাইলে ঝাঁপিয়ে পড়ে লতার হাতটা বিচ্ছিরিভাবে নাড়িয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে ফিনকি দিয়ে রক্ত।

ঘেমে নেয়ে ভয়ে আতঙ্কে চি চি করতে করতে মাথা ঝাঁকাতে লাগলাম। সজাগ থাকতে হবে। এরা যেন কিছুতেই না বোঝে যে আমার রক্ত ভীতি আছে। কিন্তু মাথা আর কী ঝাঁকাব, ম্যাক্স সর্বশক্তি দিয়ে ঘাড় ধরে যেভাবে ঝাঁকাতে আরম্ভ করল, তাতে শরীরের কল-কবজা সব ঝনঝনিয়ে উঠল মনে হলো। চোখে অন্ধকার দেখতে লাগলাম। ‘অনীক, অনীক, অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে নাকি? কী সর্বনাশ!’ চোখ বড় বড় করে তার দিকে তাকানোর চেষ্টা করতেই লতা দ্বিতীয়বারের চেষ্টায় ইনজেকশন পুশ করে দিয়েছে। বাবারে, যেমন মেয়ে, তেমন তার বিড়াল। দুজনের মাথা একসঙ্গে ঠুকে দিতে পারলে খুব শান্তি পেতাম। রাগ লাগছে। কিন্তু তার ভীম পালোয়ান ভাই ম্যাক্সের সামনে লতাকে কিছু বলা যাবে না। আরেকটা ঝাঁকুনি দিলে ঘাড় মটকে যেতে পারে।

এদিকে রক্ত ছিটকে কাপড়ের অবস্থা দফা-রফা। এ অবস্থায় বাইরে গেলে লোকে ভাববে কাউকে খুনটুন করে পালাচ্ছি। লতার মা আমার দিকে তাকিয়ে একমুহূর্ত কী যেন ভাবলেন। তারপর কাঠের সিঁড়ি মচমচিয়ে দোতলায় অদৃশ্য হয়ে গেলেন। নেমে এলেন গোটা পাঁচেক ইস্ত্রি করা ধোপদুরস্ত শার্ট নিয়ে। তারই একটা জোর করে হাতে গুঁজে দিয়ে বললেন, ‘তোমারটা বদলে এটা পরে নাও তো।’ সঙ্গে দিলেন কাঠের একটা ছোট বাক্সে ভীষণ স্টাইলিশ কয়েক জোড়া কাফলিং। লতার বাবা মনে হলো দারুণ শৌখিন লোক ছিলেন। আপত্তি তুলতেই দেখি লতার চোখে নীরব অনুরোধ।

বাধ্য ছেলের মতো জামাটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াতেই ফ্রাউ কেলনার একটা ফিচেল হাসি দিয়ে বললেন, ‘যাচ্ছ কই, এখানেই পর না?’ বাকিরাও তাতে যোগ দিয়ে হাহা করে হেসে উঠল। কালকে রাতে অমন তাড়াহুড়োয় শার্ট না পরেই দৌড়ে নেমে আসার কথা মনে পড়ে গেল। ইস! মান-সম্মানের যেটুকু বাকি আছে সেটা নিয়ে কোনোমতে সরে পড়তে পারলে বাঁচি এখন। কিন্তু সবার হাসিতে গুমোট ভাবটা সামান্য হলেও কেটে গেছে। দেখে ভালো লাগছে।

সূক্ষ্ম স্ট্রাইপের কালচে নীল শার্টটা চাপিয়ে ফিরে এসে দেখি লতার মা অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে আছেন। কারও ছায়া খুঁজছেন যেন। আস্তে আস্তে বললেন, ‘চমৎকার লাগছে, অনীক। লতার বাবাও লম্বা-চওড়ায় তোমার মতো ছিল। বাকি কাপড়গুলোও যদি নাও খুব খুশি হতাম। রেখে আর কী হবে?’ বলে খুব ধীরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন যেন। মৃদু একটা ধন্যবাদ দিয়ে হাত বাড়িয়ে কাপড়গুলো নিয়ে মনে মনে প্রার্থনা করলাম, এই মানুষগুলো যেন বিপুল এই শোক কাটিয়ে ওঠার শক্তি পান।

ঝড় ধরে এল একটু পরেই। বৃষ্টিটা চলছে যদিও। লতার কাছ থেকে একটা ছাতা নিয়ে ফ্রাউ কেলনারকে গাড়িতে বসিয়ে দিয়ে কী মনে করে ছাতা ফেরত দিতে ফিরে এলাম। দরজার কাছে কাঠমুন্ডু অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আজকে যদি এই কাঠমুন্ডু বিড়ালের কাটা মুণ্ডুটা হাতে ঝুলিয়ে বাড়ি ফিরতে পারতাম, তাহলে আমার চেয়ে খুশি আর কেউ হতো না। ছাতাটা ম্যাক্সের হাতে ফেরত দিতেই সে অবাক করে দিয়ে জড়িয়ে ধরল। ‘লতার জন্য অনেক কষ্ট দিলাম। আবার এসো। খুব ঘুরব তখন দুজন মিলে।’ ম্যাক্সের বজ্র বেষ্টনীতে আমার হাড়গোড়গুলো এদিকে মড়াৎ মড়াৎ করছে।

লতা এগিয়ে এসে ম্যাক্সের ভাইতুতো ভালোবাসার বেড়িজাল থেকে আমাকে উদ্ধার করল। রহস্য করে বলল, ‘অনীক, মাথাটা কাছে আনো তো।’ চরম নির্লজ্জের মতো ধড়-মাথা সব সমেত লতার খুব কাছ ঘেঁষে দাঁড়ালাম। ক্রাচে ভর দেওয়া লতা হাত বাড়িয়ে চুলগুলো ইচ্ছেমতো এলোমেলো করে দিয়ে দক্ষ ম্যাজিশিয়ানের মতো কানের পাশ দিয়ে যে বস্তুটি বের করে আনল, সেটা হলো সকালে চুলে আটকে দেওয়া লতার তিন কোণা ক্লিপটা। হা হয়ে গেলাম। খেয়ালই ছিল না এটার কথা। চুলের কোন আড়ালে ঘাপটি মেরে ছিল। ক্লিপটা হাতে গুঁজে দিয়ে বলল, ‘রেখে দাও। আমি এসে ফেরত নেব। তদ্দিন আবার চুলে পরে ঘুরে বেরিয়ো না। লোকে ভুল বুঝবে।’ বলেই চোখ টিপি। পাল্টা চোখ টিপি একটা দিলাম বটে। কিন্তু আসলে ইচ্ছে করছে ম্যাক্সের মতো কাণ্ড করে লতার হাড়গোড় মড়মড়িয়ে দিই। মেয়েটা পাগল। পাগল মানুষ এত ভালো লাগে কেন?

খানিকবাদে গতিসীমাহীন অটোবানে উঠে উন্মাদ গতিতে গাড়ি ছুটিয়ে ঘোর লাগা পরাবাস্তব জগৎটা পেছনে ফেলে আবার ফিরে যেতে লাগলাম পুরোনো একঘেয়ে জীবনের সাদাকালো বাস্তবতায়। (চলবে)

ড. রিম সাবরিনা জাহান সরকার: মিউনিখ, জার্মানি।
আগের পর্ব এখানে
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জানুয়ারি, ২০১৯ সন্ধ্যা ৬:২১
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেহেদী নামের এই ছেলেটিকে কি আমরা সহযোগীতা করতে পারি?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১০:০৪


আজ সন্ধ্যায় ইফতার শেষ করে অফিসের কাজ নিয়ে বসেছি। হঠাৎ করেই গিন্নি আমার রুমে এসে একটি ভিডিও দেখালো। খুলনার একটি পরিবার, ভ্যান চালক বাবা তার সন্তানের চিকিৎসা করাতে গিয়ে হিমশিম... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্য অরিজিনস অফ পলিটিক্যাল জোকস

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১১:১৯


রাজনৈতিক আলোচনা - এমন কিছু যা অনেকেই আন্তরিকভাবে ঘৃণা করেন বা এবং কিছু মানুষ এই ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। ধর্ম, যৌন, পড়াশুনা, যুদ্ধ, রোগ বালাই, বাজার দর থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভালোবাসা নয় খাবার চাই ------

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৯ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:০৬


ভালোবাসা নয় স্নেহ নয় আদর নয় একটু খাবার চাই । এত ক্ষুধা পেটে যে কাঁদতেও কষ্ট হচ্ছে , ইফতারিতে যে খাবার ফেলে দেবে তাই ই দাও , ওতেই হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতীয় ইউনিভার্সিটি শেষ করার পর, ৮০ ভাগই চাকুরী পায় না।

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৯ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৭



জাতীয় ইউনিভার্সিটি থেকে পড়ালেখা শেষ করে, ২/৩ বছর গড়াগড়ি দিয়ে শতকরা ২০/৩০ ভাগ চাকুরী পেয়ে থাকেন; এরা পরিচিত লোকদের মাধ্যমে কিংবা ঘুষ দিয়ে চাকুরী পেয়ে থাকেন। এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×