somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হঠাৎ স্বর্ণকেশী!-২০

২৯ শে জানুয়ারি, ২০১৯ রাত ২:২৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


এভাবে আর কতক্ষণ ডাল আঁকড়ে গাছে বসে থাকব, ভাবছি। সকালে ভ্লাদিমিরের প্যাঁচা মুখ দেখে বেরোনোর ফল। নইলে কী আর এই দশা হয়। সসেজ আকারের ছয় ইঞ্চি খয়েরি একটা কুকুর তার মনিবের পিছু পিছু হাঁটছিল। আমিও মনের সুখে এগোচ্ছিলাম কফিশপটার দিকে। হাতে সময় নিয়ে বেরিয়েছি। আস্তে ধীরে হাঁটলেই হবে। হেডফোনে চমৎকার গান বাজছে। পাশ দিয়ে যাচ্ছি আর বজ্জাতটা হঠাৎ ঘেউমেউ করে ক্ষেপে গিয়ে পা বরাবর কামড়ে দিতে চাইল। লাফিয়ে সরে আসলাম বটে, কিন্তু তার সঙ্গে লতাদের ডার্মষ্টাডের বাড়িতে বসে ম্যাক্স যা যা কুকুর বৃত্তান্ত বলেছিল, সব মনে পড়ে গেল। কুকুরে কামড়ালে চৌদ্দটা ইনজেকশন!

বিরক্তি ভরে লোকটাকে বলতে গেলাম, ‘আশ্চর্য! কী রকম কুকুর পোষা হয়, হ্যাঁ? কামড়াতে আসছে যে।’ মুখ থেকে কথা সরার আগেই লোকটার হাত থেকে রশি ছুটিয়ে চারপেয়ে সসেজটা আমার দিকে ছুটে এল। মাথার ভেতর থেকে কে যেন বলে উঠল, বাজান রে, দৌড় দে। নইলে কিন্তু চৌদ্দটা...। ঘাবড়ে গিয়ে আমিও ছুট লাগালাম। প্রায় এক কিলোমিটার পথ সেই রকম দৌড়ানি খাওয়ার পর কপাল জোরে এই গাছটা দেখতে পেলাম। আর সেটাতেই উঠে মিনিট পনেরো যাবৎ ফেরারি আসামির মতো পালিয়ে আছি। একটু আগে কুকুরের মালিককে শিস দিয়ে ডাকতে ডাকতে খুঁজতে দেখলাম, ‘উর্স্টি সোনা, কই তুমি, টুইট, টুইট...।’ বাহ্, বলিহারি নাম বটে। উর্স্ট মানে সসেজ। সেই উর্স্ট থেকে উর্স্টি। কিন্তু সসেজটাকে আর দেখছি না অনেকক্ষণ। নামব নাকি?

ইশ্‌, সেরেছে! লতাকে দেখা যাচ্ছে। গাছের ডালে বাঁদরের মতো বসে আছি দেখলে না জানি কী ভাববে। কিন্তু ফাজিল কুকুরটা আসলেই চলে গেছে না গাছের আড়ালে ঘাপটি মেরে আছে, এটাও বোঝা দরকার। সুতরাং, কী আর করা। লতার সামনে আত্মপ্রকাশ করতেই হলো। ‘পিসস্, পিসস্, লতা, এই, ওপরে তাকাও।’ কিন্তু, কী আশ্চর্য! সামান্য স্বরও বেরোল না গলা দিয়ে। তার বদলে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে দিলাম এক হাঁচি। হ্যাঁচ্চোওও...সর্বনাশ! গাছটা ফুলে ফুলে ভরা। ফুলের রেণুতে আমার মারাত্মক অ্যালার্জি। কিন্তু হাঁচিটাই বাঁচিয়ে দিল। লতা মুখ তুলে তাজ্জব বনে গেল। ‘অনীক, তুমি ওখানে? কী ব্যাপার? আবার বলো না যে ফুল পাড়তে উঠেছিলে।’ সঙ্গে গা জ্বালানো হাসি। মেয়েরা এত কাণ্ডজ্ঞানহীন হয় কী করে? এই বিপদের ভেতর লতার আচরণে রাগ হলো খুব।

নিউটনের আপেলের মতো টুপ করে গাছ থেকে পড়লাম। ইচ্ছা ছিল ঘাড় বরাবর সিন্দাবাদের ভূত হয়ে নেমে ঘাড়টা মটকে দিই। কিন্তু আজকে ঠিক করে এসেছি কোনোরকম চোটপাট করব না। ভীষণ ভদ্রলোক হয়ে থাকব। কিন্তু লতাকে সসেজ কুকুরের কাহিনি বলতেই সে আরেক দফা হেসে গায়ের ওপর লুটিয়ে পরে আর কী। সবকিছুতেই এদের চটুল হিহি হাহা। উফ্, অসহ্য। চোয়াল শক্ত করে কোনোমতে সহ্য করে গেলাম।

কফিশপে ঢুকে লতা মেন্যু কার্ডে ডুবে গেল। সে নাকি আজকে সব খেয়ে ফেলবে। অনেক দিন পর আজকে বাইরে খাওয়া। আতঙ্কে পকেট চেপে ধরার বদলে কান চেপে ধরে ঢোক গিলছি। গাছে বসেছিলাম যখন, কোন ফাঁকে যে মৌমাছি চামে চিকনে বাম কানটায় হুল ফুটিয়ে দিয়েছে। পিন ফোঁটার মতো সামান্য লেগেছিল তখন। এখন যতই সময় গড়াচ্ছে, কান ফুলে ধান ভানার কুলার মতো আকার নিচ্ছে। ভয়ে আছি, যেকোনো মুহূর্তে লতার চোখে কানের বেচাইন অবস্থা ধরা পড়ে যাবে। আর সে আরেকবার আমাকে ভেড়া বানিয়ে হাসাহাসি জুড়ে দেবে। লাগবে না আমার লতাপাতা। কোনোমতে আস্ত কান নিয়ে ঘরে ফিরে যেতে পারলে বাঁচি।

এই রে, আরেকটা হাঁচি আসছে নাকি? নাক তো দেখি সুর সুর করছে। লতা মেন্যু থেকে মুখ তুলে বলছে, ‘অনীক, ডোনার কাবাব নেবে নাকি একটা? একবারে লাঞ্চ হয়ে গেল তাহলে?’ ওদিকে তখন হাঁচিটা গিলে ফেলার ব্যর্থ চেষ্টায় করছি, ‘হ্যাঁ...হ্যাঁহ...।’ লতা উত্তর পেয়ে খুশি মনে উঠে গেল অর্ডার দিতে। আর আমি সমস্ত ইহ জাগতিক ভদ্রলোকামির নিকুচি করে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড কাঁপিয়ে দিলাম এক হাঁচি, হ্যাঁচ্চোওওহ...। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে অল্পবয়সী ওয়েটার ছেলেটার হাত থেকে কাটা-চামচের ঝুড়িটা উল্টে ঝনঝনিয়ে মেঝেতে পড়ে গেল। কার্নিশে বসা কবুতরগুলো বাকুমবাকুম শব্দে ঝাঁক বেঁধে উড়ে পালাল। আর কালপ্রিট আমি, লতার দিকে ভীষণ একটা অসহায় চাহনি ছুড়ে দিয়ে আবার কান ঢেকে বসে থাকলাম। লতার মুখটায় ক্ষণিকের জন্য বিচিত্র মায়া খেলে গেল যেন। নাকি চোখের ভুল? টেবিলে ফিরে এসে লতা তার ব্যাগ থেকে হালকা গোলাপি একটা রুমাল বের করে আস্তে করে ঠেলে দিল। বিনা বাক্যব্যয়ে গোলাপি রুমালটা নিয়ে সোনার চেইন, সনি টিভি, মোটরসাইকেল যৌতুক নেওয়া বরের মতো নাকে চেপে ধরলাম। হাঁচি থেকে বাঁচা বলে কথা।

খাবার দিয়ে গেছে ওয়েটার। আবার হাঁচির ভয়ে তিন কামড়ে নামিয়ে দিয়েছি কখন। গালে হাত দেওয়ার ভঙ্গিতে ফুলে ঢোল হয়ে ওঠা কানটা ঢেকে রেখেছি। আর কফির কাপে অলস চুমুকের ফাঁকে লতার স্লো মোশনে খাওয়া দেখে যাচ্ছি। সে ডুবে আছে কাবাব-সালাদের দুনিয়ায়। আর আমি ডুবে আছি লতায়পাতায় ঘেরা এক মায়ার ভুবনে। কিন্তু পাঁচ মিনিট তাকিয়ে থাকার পর মায়া পুরোপুরি উবে গেল। উল্টো বিরক্তি লাগা শুরু হলো। এই মেয়ের প্লেট শেষ হওয়ার অপেক্ষায় তো রবিনসন ক্রুশোর মতো আমার চুল দাঁড়ি পেকে যাবে! তার ওপর খাওয়ার মাঝে লতা কোনো কথাই বলছে না।

উসখুস করে উঠেছি, লতা খাওয়া থামিয়ে কথার ফুলঝুড়ি মেলে বসল। পা পুরোপুরি সেরে উঠলে তার কত কী প্ল্যান—সেই নিয়ে। সে আবার কোন কোন পাহাড়ে চড়বে, কই কই ঘুরতে যাবে ইত্যাদি ইত্যাদি। শুনতে শুনতে একঘেয়েমিতে আমি হদ্দ হয়ে যাচ্ছি। মাথাটা ঘোলাটে হয়ে আসছে। লতার কথাবার্তা এখন মহিলা মশার ভন ভন অত্যাচার। হঠাৎ পরিচিত একটা শব্দে চমক ভাঙল। লতা বলে চলেছে, এই ডিসেম্বরে সে আবার এক ডাক্তারি দলের সঙ্গে হয় দক্ষিণ আফ্রিকার নাটালে যাবে, নয়তো বাংলাদেশে রাজশাহীতে যাবে। নড়েচড়ে বসলাম। ডিসেম্বর? আমার তো এই ডিসেম্বরে দেশে যাওয়া হবে না। নতুন চাকরি থেকে ছুটি মিলবে না। নাকি চেষ্টা করে দেখব? ওদিকে, লতা বলেই চলছে, ‘দক্ষিণ আফ্রিকা যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। বাংলাদেশে তো একবার গিয়েছি। নতুন অভিজ্ঞতা দরকার।’ বিরক্তিটা যেন বুমেরাং হয়ে ফিরে এল। নতুন অভিজ্ঞতার গুষ্ঠি কিলাই। দক্ষিণ আফ্রিকা মাই ফুট! যাক গে লতা যেই চুলায়। নাটালের জুলু-পিগমিদের গ্রামে গিয়ে হেপাটাইটিসের টিকা খাইয়ে আসুক কী ডিপ টিউবওয়েল বসিয়ে দিয়ে আসুক। আমার কী?

মেজাজটা খাপ্পা হয়ে আছে। হাত গুটিয়ে ভোম মেরে আছি। ঝামেলাটা লেগে গেল এখানেই। লতার চোখের অ্যান্টেনায় আমার কুলা কান আটকে গেল। ‘কানে কী হয়েছে, অ্যাঁ? বোলতা-টোলতা কামড়ে দিয়েছে নাকি?’ উত্তর না দিয়ে বিল মেটাতে উঠে গেলাম। আমার আর লতার কাবাব তো বটেই, তার ওপর লতার চকলেট কেক, আইসক্রিম আর বিশাল একটা কোল্ড কফি। মানিব্যাগ মরুভূমি! লতা পিছু পিছু উঠে এসেছে। রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে আসতে টিস্যুর ওপরে খশখশ করে কী সব নাম লিখে দিয়ে বলল, ‘অ্যালার্জিক রিঅ্যাকশন। এই ওষুধটা কিনে খেলে চলে যাবে আধবেলার মাঝে।’ হাতির কান হয়ে ওঠা বেঢপ বাম কানটা ঝাঁকিয়ে উদাসভাবে বললাম, ‘কিনব না, ওষুধে আমার অ্যালার্জি।’ (চলবে)

আগের পর্ব এখানে
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে জানুয়ারি, ২০১৯ রাত ২:৩১
২টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দেশে এমপি হওয়ার মতো ১ জন মানুষও নেই

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১০ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:৪৪



দলগুলোতে মানুষই নেই, আছে হনুমান।

আমেরিকায় যদি ট্রাম্প ক্ষমতায় না'আসতো, বাংলাদেশে হ্যাঁ/না ভোট দিয়ে ইউনুসকে দেশের প্রেসিডেন্ট করে, দেশ চালাতো প্রাক্তন মিলিটারী অফিসারেরা ও বর্তমান জামাতী অফিসারা মিলে। দুতাবাস... ...বাকিটুকু পড়ুন

মজনু নামাজ পড়ার পর মোনাজাত ধরল তো ধরলই, আর ছাড়তে চাইল না | পাক আর্মির বর্বরতা!!

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ১০ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:৫৭



১৯৭১ সালে পাকিস্তানী আর্মি পুরো বাঙালী জাতির উপর যে নৃশংস হত্যাংজ্ঞ, বর্বরতা চালিয়েছে যা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল। সত্যি বলতে ১৯৭১ সালে বাঙালী জাতির উপর পাকিস্তানী আর্মি কর্তৃক... ...বাকিটুকু পড়ুন

সব দোষ শেখ হাসিনার !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১০ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:৫৬


অনেকদিন পর zahid takes এর ডা. জাহেদুর রহমানের এনালাইসিস ভিডিও দেখলাম। জুলাই আন্দোলনের পূর্বে বিশেষত যখন র‍্যাব স্যাংশন খায় তখন থেকেই উনার ভিডিও দেখা আরম্ভ করি। শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগার মাঈনউদ্দিন মইনুলকে ১৩ বছর পুর্তি উপলক্ষে অভিনন্দন।

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১১ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:০৭



সামুর সুসময়ের আদর্শ ব্লগারদের মাঝে মাঈনউদ্দিন মইনুল হচ্ছেন একজন খুবই আধুনিক মনের ব্লগার; তিনি এখনো ব্লগে আছেন, পড়েন, কমেন্ট করেন, কম লেখেন। গত সপ্তাহে উনার ব্লগিং;এর ১৩ বছর পুর্ণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিয়তির খেলায়: ইউনুস ও এনসিপিনামা

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ১১ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:৫৪



২০১৪ সালে মুক্তি পাওয়া আমেরিকান চলচ্চিত্র 'আনব্রোকেন' একটি সত্যি ঘটনার ওপর নির্মিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে, আমেরিকান বোমারু বিমানের কিছু ক্রু একটি মিশন পরিচালনা করার সময় জাপানিজ যুদ্ধ বিমানের আঘাতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×