১.
আজকে লেডিস ডে আউট। তবে সাথে ফেউ জুটে গেছে। ছাও পাও ঘরে রেখে আসা যায় নি। তারা যথারীতি ট্রেন কাঁপিয়ে ফেলেছে। তাও ভাল, কামরার এদিকটায় লোকজন কম। দুই সিট পেছনে শুধু দুই তরুন বসে আছে। তারাও জোর ভল্যুমে গান ছেড়ে চুক্ চুক্ করে বিয়ার টানছে। হল্লাহাটির অভাব নেই। এর মাঝেই আমরা ক’জন বঙ্গ ললনা আধবোজা চোখে আধ-গরম সমুচা চিবোচ্ছি।
গরমের এই সময়টায় কিন্ডারগার্টেন-স্কুল ছুটি থাকে। তার সাথে মিলিয়ে দিন কতক ছুটি নিতে হয়েছে। সময়টা শুয়ে বসে কাটিয়ে দেবো-এই ছিল আলসে ফন্দির ফানুস পিন দিয়ে ফুটিয়ে আমাকে টেনে বের করা হয়েছে ভুলিয়ে ভালিয়ে। এমন ঝটিকা সফরের আয়োজন খুব পাকা হাতের কাজ। মুখোমুখি সিটে গা এলিয়ে বসে মৌরি আপুর মুখে বিজয়ীর হাসি। ‘কি, কেমন লাগছে?’। ঠান্ডা কমলার জুসে চুমুক দিতে দিতে একান ওকান হেসে উত্তরটা দেয়া হয়ে গেল। পথে যেতে যেতে সমুচা-সিঙ্গারা, অদেখা শহরতলির অলিগলিতে এলোমেলো হেঁটে বেড়ানো, লেকের পাড়ে পিকনিক, ব্যাস-আর কিছু বলতে হয় নি। হাতের কাছে জামা-জুতো যা পেয়েছি, হাতে-পায়ে গলিয়ে এক ছুটে এই বব গাড়ি ধরেছি।
বব গাড়িই তো। ট্রেনের গায়ে বড় বড় করে লেখা আছে, BOB। বায়েরিশা ওবারল্যান্ডবান বা Bayerische Oberlandbahn-এর সংক্ষেপ। জার্মান ঢং আর এমন কি, শুনেছি সুইস রঙ নাকি আরেক কাঠি সরেস। তাদের কোন এক ট্রেন সার্ভিসের নাম, ফ্লার্ট। খটমটে বারো হাত নাম ‘Fast Light Inter-city & Regional Train’ ছোট্ট হয়ে গিয়ে দারুন দুষ্ট FLIRT হয়ে গেছে। অমন ট্রেনে চেপে কাজ নেই। তার চেয়ে বব ভাইয়াই ভাল।
শহরের বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে ট্রেন ছুটে চলছে সারি সারি ভুট্টা ক্ষেতের মাঝ দিয়ে। এমন ঘন ক্ষেতের আড়ালে অনায়াসে এক আধটা ইউএফও লুকিয়ে থাকতে পারে। হঠাৎ কচু পাতা রঙের কোনো হ্যান্ডসাম এলিয়েনের দেখা পেলে মন্দ হত না। আজকে লেডিস ডে বলে কথা। ঝাড়া হাত-পা। হা করে জানালার বাইরে তাকিয়ে আছি দেখে তুনা প্রশ্ন ছুড়লো, ‘আপু বোধহয় খুব একটা বেড়াতে বের হন না?’ এলিয়েন খোঁজা বাদ দিয়ে অল্পবয়সী বাচ্চা মেয়েটার দিকে তাকালাম।
হালকা পাতলা ছিপছিপে তুনাকে দেখে বুয়েট পাশ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার মনেই হয় না। তার সাথে ইদানীং যোগ হয়েছে একটা জার্মান এম.এস.। আমার জবাবের অপেক্ষা না করেই পিএইচডি পাশ ফ্রাউ ডক্টর মৌরি আপু যোগ করলো, ‘ওর আসলে ‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া’ অবস্থা। যে দেশে বাস, সেটাই দেখা হয় নি।’ ব্যাপারটা সলজ্জে মাথা নেড়ে স্বীকার করতেই হল। কড়ে গুনলে প্রায় বছর আষ্টেক আছি এই প্রবাসে। কিন্তু জার্মানি বলতে ঐ মিউনিখই বুঝি। কুয়ার ব্যাঙ যাকে বলে। তবে ব্যাঙটা আজকে এই বিদ্যাবতী বিদুষীদের সাথে ঘুরে ঘুরে মানুষ হবার একটা ট্রাই মেরে দেখবে।
২.
গল্পে আড্ডায় সময় কর্পূরের মত উধাও। মাঠ-ঘাট, পাহাড়ি পথ পেরিয়ে পাতার ফাঁকে নীল জল ঝিলিক দিয়ে উঁকি দিল। ট্রেন এসে থামলো টেগের্নসী স্টেশনে। নামের সাথে ‘সী’ থাকা মানেই এখানে একটা লেক আছে। ইংরেজিতে যাহাই লেক, জার্মানে তাহাই ‘সী’। সমতল থেকে প্রায় সাড়ে সাতশো মিটার উঁচুতে বাভারিয়ান আলপ্স ঘেরা টেগের্নসী নাকি জার্মানির টপ টেন লিস্টে থাকা লেক। আজকে তাহলে সৌন্দর্য পরীক্ষা হয়ে যাক। সত্য হলে ‘আরে ওয়াহ্, ওয়াহ্’ বলে খৈয়াম কিংবা গালীবের রোমান্টিক দু’একটা শের-শায়েরী ঝেড়ে দেবো। আর মিথ্যে হলে লেক পাড়ের কোনো গাছের ডাল ভেঙ্গে রেখে যাব। বহুত খতরনাক লোক আমরা।
বাচ্চাওয়ালা ভদ্রমহিলা বলতেই যে সাদাকালো ম্যাট্ম্যাটে ছবিটা ভেসে ওঠে, সেটাকে দু’আঙ্গুলে টশকে দিয়ে বাচ্চা আর ভদ্রমহিলা আমরা ট্রেনের উঁচু সিড়ি টপকে লাফিয়ে নেমে এসে মাঝ দুপুরের কড়া রোদকে বাঁকা হেসে কোমরে হাত রেখে দাঁড়ালাম। আমাদের চৌকস ল্যান্ডিং দেখে আরো দশ সেকেন্ড আগে নেমে পড়া টগবগে তরুনী তুনা কুমারী খাপখোলা সামুরাই সোর্ডের মত ঝনঝনিয়ে হাসছে।
লেক-টেকের আর তোয়াক্কা না করে ঘষামাজা সাইনবোর্ড ঝোলানো দুই নম্বরি চেহারার এক চাইনিজ রেস্তোরাঁ বরাবর পা চালালাম। ক্ষুধাই আসল। বেড়ানো নকল। সৌন্দর্য গিলে কবে কার পেট ভরেছে ঠিক মনে পড়ছে না। তবে স্টির ফ্রাই ভেজিটেবল উইথ স্টিমড রাইস খেলে পেট, মন দু’টোই যে সমান তালে ভরবে, তা কি আর বলে দিতে হয়। সয়া সস ছিটিয়ে সাদা ভাত কালো করে দিতে দিতে আলাপ এগোতে থাকলো। ঠিক হল, ছক বেঁধে কিছু করা যাবে না। যেদিকে দু’চোখ যায় সেদিকে হাঁটবো। ঘুর ঘুর লাটিম লাটিম একটা দিন। আর, পা বাড়ালে পথ নাকি আপনা থেকেই তৈরি হয়ে যায়।
বিল চুকিয়ে শুরু হল আমাদের দিগ্বিদিক হন্টন। এই খেয়ালখুশির এলোমেলো হাঁটাকে অবশ্য পাঁচ মিনিটে লাইনে নিয়ে আসলো মৌরি আপু। সে আজকের রাখাল। বার দুই দাবড়ানি খেয়ে ভেড়ার পাল আমরা রীতিমত রাস্তার নাম ধরে ধরে এগোচ্ছি। কোথায় গেলে কতক্ষনে যে একটু জাবর কাটার অবসর মিলবে, কে জানে। আয়েশী চিন্তাটার সাথে দুপুরের রোদটা মিশে গিয়ে আরামদায়ক আবেশে চোখ বুজিয়ে দিতে চাইছে। (চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই সেপ্টেম্বর, ২০২০ রাত ১:১৮