somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পর্তুগালের অলিগলিঃ পর্ব ৩

০৭ ই জানুয়ারি, ২০২১ সন্ধ্যা ৭:১২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


আগের পর্ব এখানে
৭.
দ্বিতীয় দিন। গ্যাঁট হয়ে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা লেকচার শুনে প্রায় ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। পাশের কারো ধাক্কায় ধড়ফড় করে উঠলাম। পোস্টার সেশনে ছুট দিতে হল। সেখানে গোল আলুর মত কেৎরে থাকার জো নেই। বরং ভুট্টার খই হয়ে ফুটতে হবে। সুতরাং, যত প্রকারে হাত-পা নেড়ে, ঘাড়-মাথা ঝাঁকিয়ে, কথার তুবড়ি ছুটিয়ে মুখে ফেনা তুলে ফেললাম। অতি আগ্রহের বনামে বুড়ো বুড়ো বিজ্ঞ প্রফেসররা মুচকি হাসলো। এতটুকু দমে না গিয়ে শূন্য কলসির মত বাজতেই থাকলাম। অল্প বিদ্যার এমনই তেজ।

একটা ভয় কাজ করছে আসলে। পর্তুগাল আসার আগে বাজখাঁই তুর্কি সুপারভাইজার ডক্টর ইলদ্রিম হাসতে হাসতে গলায় পোঁচ দেয়ার ভঙ্গী করে ছেড়ে দিয়েছে। রিসার্চের কাজ তুখোড়ভাবে মেলে ধরতে না পারলে এক কোপে কল্লা কেটে নেবে। নিজে না এলেও কনফারেন্সের আসরে তার অনেক ‘কান’ আছে। ভাল-মন্দ সব সে শুনতে পায়। ভজঘট পাকিয়ে মিউনিখ ফিরে গেলে গর্দান সে নিতেও পারে। আতঙ্ক আর ত্রাসের অপর নাম ডক্টর আলী ইলদ্রিমের অসাধ্য কিছুই নেই।

যাহোক, সব ভালোয় ভালোয় সেরে হোটেলে ফিরে গেলাম বিকাল নাগাদ। তৈরি হয়ে নেবার তাড়া আছে। রাতে গালা ডিনার। জাঁকজমক পার্টি হবে। সেখানে ছাত্র-প্রফেসর সবার সেজেগুজে আসার রেওয়াজ। গতবার ডক্টর মেলানি ক্যোনিগসহফ তাক লাগিয়ে দিয়েছিল ঘেরওয়ালা গাউন পরে। গম্ভীর, রাশভারী প্রফেসর আইকেলবার্গও নাকি চরম স্যুটেড-বুটেড হয়ে নারীমহলের কলিজা কাঁপিয়ে দিয়েছিল। ডিস্কো বাতি জ্বেলে ম্যারম্যারে কনফারেন্স হল বদলে গিয়েছিল ঝলমলে বল রুমে। সে এক দেখার মত দৃশ্য।

গল্পগুলো মিউনিখে বসে ভারতীয় বান্ধবী বার্খার কাছ থেকে শুনেছিলাম। বার্খা পোস্টডক্টরাল ফেলো। গতবারের কনফারেন্সে সে এসেছিল। সেবার কেন যে স্যুটকেসে ঢুকিয়ে একখানা শাড়ি নিয়ে যায় নি-এই আফসোসের তার শেষ নেই। বার্খার জবরদস্তিতে ব্যাকপ্যাকে একখানা নীল শাড়ি পুরে এনেছি। সেটা এখন হোটেলের সফেদ বিছানায় এলোমেলো পরে আছে। এই তেরোহাতি কাপড় নিয়ে বিরাট দ্বিধায় পড়ে গেছি।

কখন যে ফ্রান্সি এসে পাশে দাঁড়িয়েছে, টের পাই নি। নীল জমিনে রুপালি সুতোর মিহি কারুকাজ দেখে তার মুখে কথা সরে না। ‘আরেব্ববাহ, শাড়ি দেখছি। তুমি পরতে জানো?’। ফ্রান্সির গলায় বেজায় কৌতূহল। কোন ফাঁকে সে চট্ জলদি তৈরি হয়ে নিয়েছে। তার বেশভূষাও বেশ ইন্টারেস্টিং। কালো স্ট্রাইপ ট্রাইজার, ফর্মাল সাদা শার্ট আর ব্যাক ব্রাশ চুলে ফ্রান্সিকে পুরো টমবয় লাগছে। ‘দেখো, বেশি সময় নিয়ো না, আমরা নিচে অপেক্ষা করছি। তাড়াতাড়ি নেমে এসো।‘ তাগাদা দিয়ে বাদামী ড্রেস স্যু মচমচিয়ে ফ্রান্সি চলে গেল।

মিনিট পনেরো পর। শাড়ি পেঁচিয়ে জড়ভরত সেজে সিড়ির হাতল ধরে ধরে খুব সাবধানে নেমে এলাম। পেন্সিল হিলটা এই বুঝি একদিকে টশ্কে গেল। টালটামাল দৃশ্য দেখে সাথের মেয়েগুলো আমোদ পাচ্ছে। তাদের পরনে ফর্মাল মিডি স্কার্ট আর হালকা রঙের টপ। গলায় বড়জোর রঙ্গীন শাল। ছিমছাম সাজ। টাল সামলে রওনা দিলাম ওদের সাথে। কিন্তু শাড়ির কুঁচি পায়ের তলে পড়ে ঠিকই টশ্কে গেলাম।

নেতা গোছের ফ্রান্সি এগিয়ে এল মুশকিল আসান হয়ে। ‘এ্যাই, সোজা হয়ে দাঁড়াও তো। পড়ে গিয়ে মাথা ফাটিয়ে ফেলবে আর তোমাকে কাঁধে নিয়ে ঘুরবো আমরা? ধ্যাত্ততেরি!’ গজগজ করতে করতেই জার্মান মেয়েটা পকেট থেকে সেফটিপিন বের করে ভীষন দ্রুততায় অবাধ্য শাড়ির ভাঁজগুলোকে দারুন শাসনে নিয়ে এল। এই মেয়ের জন্ম বাংলাদেশে হওয়া উচিত ছিল। শাড়ি-টিপে কি সুন্দর টিএসসি, কার্জন হল ঘুরে বেড়াতো। তা না, খামোখাই জার্মান দেশে জন্মে শার্ট-প্যান্ট চাপিয়ে শুষ্কং কাষ্ঠং টমবয় সেজে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

৮.
কোথায় গালা ডিনার? আমাদের ছোট্ট দলটা বাদে বাকি সবাই দিনের বেলার সেই একই কাপড় পরে চলে এসেছে। পোশাকের ভাঁজে সারাদিনের স্পষ্ট ক্লান্তি। তার মাঝে নিজেকে নিদারুন বেখাপ্পা লাগছে। বার্খার কথা শুনে এমন সঙ সেজে এখন হাসির পাত্র হতে যাচ্ছি মনে হচ্ছে।

শাড়ি নামক এই উপমহাদেশীয় বস্ত্রের জেল্লা একবার চাক্ষুষ দেখতে অনেকেই উৎসুক এগিয়ে আসছে। কোনোমতে সামনের সারির আসনে পালিয়ে বাঁচলাম। সম্মেলনগুলোতে প্রথম সারি চিরকাল ফাঁকা পড়ে থাকে। ঘুমিয়ে গেলে ধরা পড়ার ভয়ে।

ডিস্কো বাতি জ্বলে ওঠার বদলে হতাশ করে দিয়ে মোচওয়ালা এক প্রৌঢ় মঞ্চে উঠে এল। পোশাকের প্রতি লোকজনের উদাসীনতার কারন বোঝা গেল এতক্ষনে। কিসের নৃত্য সন্ধ্যা, আজকে হবে সঙ্গীত রজনী। পর্তুগালের ঐতিহ্যবাহী ফাদো সঙ্গীত। ভদ্রলোক ছোট্ট করে গলা খাঁকরি দিয়ে কথা শুরু করলেন। ‘ফাদো মানে ভাগ্য বা পরিনতি। বয়ে চলা সময়ের পরিনতিকে এই গানে বেঁধে ফেলা হয় এক মনোটোনিক সুরের বাঁধনে...’। ফাদো সঙ্গীতের বিশাল ইতিহাসের বনামে বোয়াল মাছের হাঁ মেলে আমিও বিশালতর এক হাই তুলে ফেললাম।

অপ্রয়োজনীয় ইতিহাস কপচানোর পর এবার শুরু হল গান। অপেরা সঙ্গীতের স্টাইলে উঁচু তানে সুরের নামে অসুর ধরলো শক্তিশালী মোটাসোটা মাঝবয়সী গায়ক। কি গান বাবা রে। দু’কানে ভয়ংকর অত্যাচার ঠেকছে। কি ভুল করেই যে প্রথম সারিতে বসেছি। কানের পর্দা ফেটে চৌচির হবার যোগাড়। ওদিকে, গায়কের সবুজ রগ গলা থেকে কপাল অবধি চড়ে গিয়েছে। নিরুপায়ের মত এদিক ওদিক তাকাতে লাগলাম।

পাঁচ মিনিটের মাথায় আমাদের সবাইকে বিধ্বস্ত করে দিয়ে রগ ফুলানো গায়ক বড় একটা বাউ করে বিদায় নিল। নিঃশব্দে হাঁপ ছাড়লাম, ‘ফিউউহ্!’। মঞ্চে এবার এল কালো গাউন পরা এক নারী। আধো আলোতে তার বয়স ঠাহর হয় না। গাঢ় মাশকারায় ঢাকা চোখ দু’টো আধবোজা। স্পানিশ গিটার আর তানপুরার আদলে গড়া পর্তুগীজ গিটার হাতে উঠে এল আরো দু’জন। ধীর লয়ে শুরু হল অপূর্ব সুরের রিনঝিন। না জ্যাজ, না, ব্লুজ, না ফোক। সঙ্গীতের জানাশোনা কোনো ধারাতে তাকে ফেলা গেল না। উশখুস করা এক হল লোক যেন আচমকাই শান্ত হয়ে বসলো।

কেউ যেন সুরেলা গলায় গল্প বলে চলেছে। এক বর্ণ পর্তুগীজ জানা নেই, অথচ মন বলছে এ যেন দেশ দেশান্তর ঘুরে আসা বোহেমিয়ানের গল্প, ঘাটে ঘাটে নোঙর ফেলা নাবিকের গল্প। কিন্তু কাহিনীগুলো যেন দুঃখ দিয়ে গাঁথা। সম্মোহনী ভঙ্গিতে গেয়েই চলছে গায়িকা। তার কাঁধে কেউ যেন সেই সব মানুষের দুঃখের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে। বেদনাকে ধারন করে এমন করে গাইতে কাউকে আর দেখি নি।

গান শেষ হল এক সময়ে। শিল্পী নিচু গলায় কি যেন বলছে। আশ্চর্য হয়ে শুনলাম, ফাদো গানের আদি শিল্পীরা কেউ ছিল পেশায় নাবিক, কেউ বা পর্যটক। গানের যে ভাষার দরকার নেই, আরেকবার স্বীকার করতেই হল। (চলবে)

ফাদো গান কেমন
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জানুয়ারি, ২০২১ রাত ২:৪০
৫টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×