somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পর্তুগালের অলিগলি: পর্ব ৪

১১ ই জানুয়ারি, ২০২১ রাত ২:৩৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


পর্ব ৩ এখানে
৯.
খুবসে এক দফা পেটপুর্তি ডিনার সেরে মেজাজ বেশ ফুরফুরে। এদের উর্দিপরা ওয়েটার ছুটোছুটি করে যে খাওয়ানো খাইয়েছে। তবে, একটা ব্যাপার। খাবার হালকা মশলার ঝাঁজ। মিষ্টি ডেসার্ট ঠিক যেন খেজুরে গুড়ের পায়েস। তাতে এলাচীর সরব আনাগোনা। ভাবলাম, যারা এককালে উত্তমাশা পেরিয়ে ওপাড় থেকে বোঁচকা বেঁধে মশলাপাতি লুটে এনেছে, তার কিছু কিছু হদিস এতকাল বাদেও যে তাদের খাবার দাবারে রয়ে যাবে-এ তো খুব স্বাভাবিক।

ঘড়িতে সবে রাত নয়টা। নাইট ইজ স্টিল ইয়াং-এই আপ্তবাক্য আওড়ালো দলের কেউ একজন। আপ্তবাক্য মেনে নিয়ে হোটেলে না ফিরে এক পাক ঘুরে বেড়াতে রাজি হয়ে গেলাম আমরা। একমাত্র ব্যক্তিগত বাঁধা, পেন্সিল জুতোজোড়াকে আঙ্গুলে ঝুলিয়ে খালি পায়েই চললাম। পদব্রজে ভয় কি পথিকের। তাছাড়া, ঝকঝকে রাজপথ আর তকতকে ফুটপাথে খালি পায়ে হাঁটার মজাই আলাদা।

ডিনারে নানান রঙের পর্তুগীজ তরল ছিল। তার খানিকটা যাদের পেটে গিয়েছে, তার অল্পতেই হেসে এর ওর কাঁধে লুটিয়ে পড়ছে। তাদেরই একজন জড়ানো গলায় বললো, ‘ঐ দেখো ক্যাসিনো রয়্যাল। জেমস্ বন্ড, জেমস্ বন্ড। বুঝলে কিছু?’ চাপা বিস্ময়ে ঘুরে তাকালাম আমরা। দূরের রঙ্গিন ফোয়ারার পেছনে দাঁড়ানো সুবিশাল দালানের গায়ে লাল আলোতে জ্বলছে নিভছে, ‘ক্যাসিনো এস্তোরিল’। যেন এক টুকরো লাস ভেগাস উড়িয়ে এনে বসিয়ে দেয়া হয়েছে। ডানে বামের কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই মরিশিও পাক্কা ট্রাভেল গাইডের মত বলে উঠলো, ‘ইয়ান ফ্লেমিংকে চেনো তো। বিখ্যাত ব্রিটিশ লেখক। জেমস্ বন্ডের বাপ। বন্ড সিরিজের প্রথম উপন্যাস, ‘ক্যাসিনো রয়্যাল’ এই ক্যাসিনো এস্তোরিলকে ঘিরেই লেখা হয়েছিল। হুঁ হুঁ, বুঝে দেখো কোথায় এসে পড়েছো।‘

এতক্ষনে বুঝলাম কাহিনী। ‘ড্যানিয়েল ক্রেগ তাহলে জেমস্ বন্ড সেজে এখানেই লাফিয়ে ঝাপিয়ে শ্যুটিং করে গিয়েছিল, তাই না?’ জিজ্ঞাসু প্রশ্নটা ছুড়তেই মরিশিও এক প্রস্থ অকারণ হেসে নিলো। তার পেটেও বেশ খানিকটা তরল গিয়েছে। ‘আরে দূর, শ্যুটিং তো হয়েছিল চেক রিপাবলিকের প্রাগ শহরের কোন সস্তা জায়গায়। এস্তোরিলে লাফাতে ঝাঁপাতে প্রচুর পয়সা লাগে। ফিল্মের লোকেরা অত বোকা না।‘ একটু দম নিয়ে সে আবার যোগ করলো, ‘তা যাবে নাকি কেউ, একটা ঢুঁ মেরে আসি গে? এক দান খেলেও ফেলতে পারি, কি বলো?‘

ক্যাসিনোতে গিয়ে গাঁটের পয়সা ফেলে আসতে খুব বেশি কেউ সায় দিলো না। গবেষনা লাইনের লোকদের পকেট চিরকালই বেহাল। তবুও মরিশিও কিভাবে যেন কয়েকজনকে ভজিয়ে ফেললো। ইস্কাপন-হরতন-রুইতন-চিরতন পেটাতে তাসের ঘর ক্যাসিনো এস্তোরিলের দিকে রওনা দিয়ে দিল তারা। বাকিরা আমরা আরেক পাক এদিক সেদিক ঘুরে ডেরায় ফিরে গেলাম।

সারাদিন পোস্টার নিয়ে তঠস্থ থাকতে হয়েছে। তার উপর ঠায়ে বসে গান শোনা আর গলা অবধি খানাপিনা। ঘুম নেমে এল প্রায় ভেঙ্গে চুরে। সমস্যা একটাই। রুমের আরেক প্রান্তে ফ্রান্সি মেয়েটা তার বেড-সাইড বাতিগুলো জ্বেলে ফোন হাতে আধশোয়া। কারো সাথে রাতভর কুটুর কুটুর আলাপের প্রস্তুতি। উশখুসটা আঁচ করতে পেরে সে মিষ্টি করে হেসে বললো, ‘অসুবিধা হলে বাতি নিভিয়ে দেই? একটু গার্লফ্রেন্ডের সাথে কথা বলতাম।‘

‘মানে?‘ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে চোখ গোল গোল তাকালাম। ‘আরে, বয়ফ্রেন্ডও একটা ছিল। যেই বাবা-মার সাথে দেখা করিয়ে দিলাম, অমনি ফুটুস, ভেগে গেল। ছেলেদের সাথে নতুন করে ভাব করার ধৈর্য নেই আর।‘

বিস্ময়ে অস্ফুট একটা ‘ওহ্!’ করে চোখ বুজলাম। এত সহজে পুরুষ জাতি থেকে নাক ঘুরিয়ে ফেলাটা কি ঠিক হল, ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেলাম।

১০.
শেষ দিনটা সুদে আসলে উসুল হবে মনে হচ্ছে। একট বড় আকর্ষন আছে। আধা বেলাতেই সম্মেলন শেষ। তারপর, ট্যুরিস্ট বাসে করে আমাদের নিয়ে যাবে লিসবন। সেখানে রীতিমত গাইডেড ট্যুর। ইচ্ছামত ঘুরে টুরে যে যার ফ্লাইট ধরে বিদায় নেবে। ব্যবস্থা নেহাৎ মন্দ না। ব্যাগপ্যাক গুছিয়ে একবারে বেরিয়ে পড়লাম চেক আউট সেরে।

গতরাতেই অনেকে বিদায় নিয়েছে। তাই হল ঘর অর্ধেকটা ফাঁকা। শেষ দিনে লোকজনকে জ্ঞান গেলানো মুশকিল। বাকি লেকচারগুলো শেষ হলে মোটামুটি দায়সারা তাড়াহুড়োয় আয়োজনের সমাপ্তি টানা হল। মুক্তির আনন্দে লাফিয়ে বেরিয়ে এলাম। বিশালবপু কালো রঙের বাসটা আমাদের জন্যেই দাঁড়িয়ে আছে।

বাসের জানালায় নাক লাগিয়ে বসার ভেতর বিচিত্র সুখ। মনের শিশুটা বেরিয়ে আসে খলবলিয়ে হেসে। যা দেখে, তাতেই সে মুগ্ধ। স্বচ্ছ কাঁচে পাঁচ-পাঁচ দশ আঙ্গুলের ছাপ ফেলে বিমোহিতের মত দেখছি এস্তোরিল-টু-লিসবনের পথঘাট। যে পথে এসেছিলাম, ফেরত যাচ্ছি নতুন আরেক পথ ধরে। দৃশ্যপটও তাই আনকোরা নতুন।

পর্তুগালের নীল আকাশ যেন নীলের চাইতেও নীল। তাতে পেঁজা তুলোর তুলিতে কত কি যে ক্ষনে ক্ষনে আঁকা হচ্ছে। কখনো সেখানে ফড়িং তাড়া করছে লম্বা কানের খরগোশ, কখনো বা ডানা ঝাঁপটে নামছে পঙ্খিরাজ ঘোড়া। ঘোড়া মিলিয়ে গেলে খেলতে এল ছোট্ট হাতির ছানা। শূড়ের ডগায় বলটা বুঝি তার এই পড়ে যায় যায়। এই যাহ্, বল যে পড়েই গেল। কিন্তু কি কান্ড! কোত্থেকে ভুশ্ করে বল মাথায় ভেসে উঠল একটা ডলফিন! আরেক কোনে দেখি ইয়া বড় এক ড্রাগন ওঁত পেতে দাঁড়িয়ে। পূব থেকে উড়ে আসা একটা উড়োজাহাজকে সে হাঁ করে গিলে নিল কপাৎ। প্লেনটাও কম চালাক না। সুড়ুৎ করে ড্রাগনের কানের ফুটো দিয়ে পালিয়ে ফুড়ুৎ। আকাশের পর্দায় মেঘেদের ছায়াছবি চলতেই থাকলো। আর আমাদের বাসের জানালাটা যেন বায়োস্কোপ। কি চমৎকার দেখা গেল!

হায়, সাথে না আছে ক্যামেরা, না একটা যুতসই ফোন। ‘কি, আফসোস হচ্ছে বুঝি খুব?’ পাশের সহযাত্রীকে এই প্রথম খেয়াল হল। সৌখিন নাইকন ক্যামেরা কোলের ওপর নামিয়ে রেখে বছর চল্লিশের ভারতীয় চেহারার ভদ্রমহিলা হাত বাড়িয়ে দিলেন, ‘আমি ভিভা, ভিভা লামা। মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসেছি। পালমোনারি মেডিসিনের প্রফেসর।‘

খুব দ্রুত চিন্তা করছি। ভদ্রমহিলা কি মাফিয়া প্রফেসর নাকি ফ্রেন্ডলি প্রফেসর?তার অল্প বয়স আর কথার সহজ ভঙ্গী দেখে তো মাফিয়া বলে মনে হচ্ছে না। সামান্য রিস্ক নিয়ে ফেললাম। ফিরতি হাত বাড়িয়ে জানতে চাইলাম, ‘তোমার নামের অর্থ কি ‘আলো’ বা ‘কিরণ’- এই জাতীয় কিছু?’ খুশি খুশি গলায় উত্তর এল, ‘আরে, জানলে কি করে? তুমি কি ইন্ডিয়ান?’ রহস্য করে বললাম, ‘না, বাংলাদেশী। তবে, আন্দাজ করে নিয়েছি ‘ভিভা’ নামের বাংলা উচ্চারন ‘বিভা’। আর বিভা মানে যে আলো, তা জানতে ক্লাস ফাইভের ব্যাকরণ বই-ই যথেষ্ট। ভেবো না, তোমাকে তোমার উচ্চারনেই ডাকবো, হাহা...।‘ ভিভাও হাসিতে যোগ দিল গালে হালকা টোল ফেলে। বাঁচলাম, সে ডন-মাফিয়া গোছের কিছু নয়।

কিন্তু এই হাসি কই যেন আগে দেখেছি। চট্ করে মনে পড়লো। সেদিন রাতে মরিশিওর মুঠোফোনে। পাঁজি ইঁদুরটা এই ভিভার থালা থেকেই পিজ্জা সরাচ্ছিল। সেই খবর কি ভিভাকে জানানো ঠিক হবে? নাহ্, ঘাবড়ে দিয়ে ফায়দা কি। (চলবে)

ছবি সৌজন্য, অন্তর্জাল এবং কপিরাইট মুক্ত।

সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জানুয়ারি, ২০২১ রাত ২:৪০
৬টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

গণতন্ত্র আর বাক-স্বাধীনতার আলাপসালাপ

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:২৩


একাত্তর সালে আওয়ামী লীগের লোকজন আর হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা ছিল পাকবাহিনীর প্রধান টার্গেট। যদিও সর্বস্তরের মানুষের ওপর নিপীড়ন অব্যাহত ছিল। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধা আর তাদের পরিবারের... ...বাকিটুকু পড়ুন

কাফের কুফফারদের দেশে বাস করা হারাম।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:১৩

ফেসবুকে বাঙালিদের মধ্যে ইদানিং নতুন এক ফতোয়া চালু হয়েছে, এবং তা হচ্ছে "দাওয়াতের নিয়্যত ছাড়া কাফের কুফফারদের দেশে বাস করা হারাম।"
সমস্যা হচ্ছে বাঙালি ফতোয়া শুনেই লাফাতে শুরু করে, এবং কোন... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের মুমিনী চেহারা ও পোশাক দেখে শান্তি পেলাম

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:৫৮



স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে স্টেজে উঠেছেন বত্রিশ মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের চব্বিশ জনের দাঁড়ি, টুপি ও পাজামা-পাঞ্জাবী ছিলো। এমন দৃশ্য দেখে আত্মায় খুব শান্তি পেলাম। মনে হলো আমাদের মুক্তিযোদ্ধা আমাদের মুমিনদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দুই টাকার জ্ঞানী বনাম তিনশো মিলিয়নের জ্ঞানী!

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ২:৫৯

বিশ্বের নামীদামী অমুসলিমদের মুসলিম হয়ে যাওয়াটা আমার কাছে তেমন কোন বিষয় মনে হত না বা বলা চলে এদের নিয়ে আমার কোন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু আজ অষ্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত ডিজাইনার মিঃ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×