somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

তেপান্তরের মেয়ে ২

১৩ ই জুন, ২০২১ রাত ১২:৩৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


তেপান্তরের মেয়ে ১

দেখতে দেখতে বন্ধু হবার বদলে ভক্ত বনে গেলাম। ক্যাফেটারিয়ার বড় স্ক্রিনে ক্যাম্পাসের খবর ফলাও করে ঘুরপাক খায়। তাতে জিসেলের ছবি ভাসে নিত্যদিন। কখনো কনফারেন্সে প্রাইজ নিচ্ছে, কখনো বা স্টুডেন্ট ইলেকশনে জিতে হাত নাড়ছে। ক্যাম্পাসের তুমুল হ্যাপেনিং লেডি। এক নামে সবাই চেনে। এমন মেয়ের ভক্ত না হয়ে উপায় নেই।

তবে মাঝে মাঝে স্ক্রিন ফুড়ে বেরিয়ে আসে জিসেল। মাঝ শরতের শেষ বিকেল। ক্যাম্পাসে বারবিকিউ পার্টি । পুরোটা গ্রীষ্ম গেল, কোনো খবর নেই। অথচ এই আসি আসি শীতে কি না বারবিকিউ। তাও আবার হলিউডি সিনেমায় বিদেশী ছেলেমেয়েদের যেমন হইহুল্লোড় দেখা যায়, অমনটা নয়। কাগজের প্লেটে গ্রিল করা সসেজ আর প্লাস্টিক কাপে বিয়ার নিয়ে যে যার মত ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে নিচু স্বরে গল্প করছে। আমিও একটা পোড়ানো ভুট্টার উপর মাখন ছেড়ে দিয়ে এ্যায়সা কামড় বসিয়েছি। মুখে পুরে মনটাই বিগলিত হয়ে যাচ্ছে। এমন সময়ে হালুম করে কে যেন ঘাড়ে এসে পড়লো। ‘হেই! কোনায় দাঁড়িয়ে কি খাচ্ছো ওটা? হাপুস হুপুস খেয়ে গেলেই হবে? বাৎচিত করতে হবে না?’। মুখ তুলে দেখি জিসেল। লম্বা ঝুলের কমলা ফ্রকে তাকে পড়ন্ত রোদের আলোর মতই স্নিগ্ধ লাগছে। প্রানখোলা হাসিতে হ্যাঁচকা টানে আমাকে উঠিয়ে ছাড়লো ঘাসের আসন থেকে।

‘সামনের নভেম্বরে সাইন্স স্ল্যাম হবে। নাম দিয়েছি। আসবে কিন্তু।‘ কথা আদায়ের ভঙ্গিতে তাকালো জিসেল। সাইন্স স্ল্যামটা কি বস্তু, সেটা না বুঝেই একটা হ্যাঁ বলে দিলাম। ‘জিসেল, এক সাথে এত কিছু করো কি করে, বলো তো? আমার তো সকাল-সন্ধ্যা এক ল্যাবের কাজ করেই জান বেরিয়ে যায়, ফিউউউহহ্!’।

এক হাতে তুড়ি মেরে আমার কথাটা উড়িয়ে দিয়ে জবাব দিল মেয়েটা, ‘তোমার কি মনে হয়ে দেশ ছেড়ে গড়িয়ে গড়িয়ে এদ্দূর এসেছি কেবল পড়াশোনা আর ডিগ্রি-ফিগ্রি করতে? ছোহ্! আমি এসেছি সব জিতে নিতে। যত কম্পিটিশন-কনফারেন্স আছে, সবটায় নাম লেখাবো। হারি-জিতি ব্যাপার না। কিন্তু লড়তে দারুন লাগে‘। শুনে আমারো দারুন লাগলো। জিসেলের কথাগুলোতে যে পরিমান স্পিরিট আছে, টেবিলের ওপর রাখা বিয়ারের জগেও অত স্পিরিট নেই।


ঘড়ি ধরে ঠিক সাড়ে চারটায় হাজির হলাম। ক্যাম্পাসের সবচেয়ে বড় সেমিনার হল। আসনগুলো কলোসিয়ামের আদলে ধাপে ধাপে ওপরে উঠে গেছে। সাইন্স স্ল্যামের আসর শুরু হবে এখুনি। লাল-নীল ডিস্কো বাতি লাগানো হয়েছে। বেশ সাজ সাজ রব। প্রথম প্রতিযোগী এল। কাজটা কঠিন। দশ মিনিটের ভেতর যার যার গবেষনার খটোমটো জটিল বিষয় পানির মত সরল ভাষায় বলে যেতে হবে। শুধু সরল হলে হবে না, সরসও হতে হবে।

রসের অবশ্য অভাব হল না। তুখোড় সব উপস্থাপনায় তাক লেগে যাচ্ছে একের পর এক। অবশেষে তিন জনের পর জিসেল এল। টম ক্রুজের মিশন ইম্পসিবল ছবির থিম মিউজিকটা ব্যাকগ্রাউন্ডে ছেড়ে আপ ফ্রন্টে সে কি সব আউড়ে গেল, আর লোকেরা এর ওর গায়ে হুমড়ি খেয়ে হাসতে লাগলো। সুদূর হন্ডুরাসের মেয়ের মিশন ‘সাইন্স স্ল্যাম’ এক্কেবারে পসিবল হয়ে ছাড়লো। তুমুল হাততালির ভেতর সেরা তিনের ট্রফিটা হাতে উঁচিয়ে চওড়া হাসিতে মঞ্চ মাতিয়ে হাসছে জিসেল। সামনের সারিতে বসে আমিও পাড় ভক্তের মত হাত নাড়ছি। এই মেয়েটা আসলেই অন্য ধাতুতে গড়া।


সকাল সকাল কাজ শুরু করেছি আজ। ‘শুনেছো খবরটা?’। কারিনের কথায় হাতের খাতাটা টেবিলে নামিয়ে জিজ্ঞাসু তাকালাম। কারিন আর আমি একই ল্যাবের। ‘জিসেল নামের মেয়েটাকে চেনো তো?’। মনে মনে বলি, ‘তা আর বলতে!‘। মুখে বললাম, ‘সে আবার নতুন কোনো প্রাইজ জিতেছে, তাই তো?’। কারিন সামান্য ইতস্তত করে ধীরে ধীরে বলে গেল, ‘না মানে জিসেল আর নেই। কালকে রাতের ঘটনা। লাং এম্বলিজম কেস। বাঁচানো যায় নি’।

স্তব্ধ, হতভম্ব হয়ে গেলাম। লাং এম্বলিজমের মানে কি তা জীব বিজ্ঞানের ছাত্র আমাকে বুঝিয়ে বলতে হয় না। রক্ত জমাট বেঁধে ফুসফুসের ধমনী আটকে নিঃশ্বাস বন্ধ করে দিয়েছে জিসেলের। খবরটা শুনে আমারো নিঃশ্বাস আটকে আসার যোগাড়। এমন উচ্ছল, প্রানবন্ত মেয়েটা অমন ঠুস্ করে মরে গেল? মানতেই পারছি না। আরো কিছু জানতে চাইবো বলে মুখ খুললাম। তার আগেই কারিন হাত নাড়ালো, ‘আর কিছু জানি না বাপু। কাজ আছে। যাই গে‘।

জীবিত লোক দিয়ে কাজ হয় গবেষনা চলে, সব হয়। কিন্তু মরে গেলে সে লোক বড়ই অপ্রয়োজনীয় জড়বস্তুতে পাল্টে যায়। তাকে নিয়ে কথা বলাও বাতুলতা। তাই বাজে বকা এড়াতে দায়সারা কাঁধ ঝাঁকিয়ে সরে পড়লো কারিন। শুধু দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। হাতের খাতাটা কখন যে ছিটকে পড়ে টেবিলের নিচে পালিয়েছে, খেয়ালও হলো না। বজ্রাহত হলেও বুঝি লোকে জমে এমন কাঠ হয়ে যায় না।

কিন্তু না। জিসেল চলে গিয়ে গেল না। বাক্সবন্দী হয়ে হাসপাতালের মর্গে শুয়ে থাকলো দিব্যি হাত ভাঁজ করে। তার যাওয়া আটকে গিয়েছে। জার্মানি থেকে কফিন তার দেশ হন্ডুরাসে নিতে ম্যালা খরচ। প্রায় হাজার দশেক ইউরো। বাংলা টাকায় লাখ দশেক। পড়তে আসা বিদেশী ছাত্রে ব্যাংকে এত পয়সা থাকে না। শুনলাম জিসেলের পরিবারও তেমন স্বচ্ছ্বল না। মেয়েকে বাড়ি আনার সাধ থাকলেও সাধ্য নেই। বাকি রইল এই হেল্মহোল্টজ রিসার্চ সেন্টার। তাদের মৌনতা সম্মতির লক্ষন হয়ে ধরা দিল না।

দায়টা হাত ঘুরে শেষ মেষ জিসেলের ল্যাবের কলিগদের ঘাড়েই বর্তালো। তারা রোজ রোজ ক্যফেটেরিয়ার দরজায় টেবিল পেতে বসে থাকে। আমরা যে যা পারলাম দিয়ে দিলাম পকেট উজাড় করে। কারিনকেও দেখলাম অবলীলায় অনেকগুলো নোট ঢুকিয়ে দিল ওদের টিনের কৌটায়।

সপ্তাহ খানেক পর। সময়ের সাথে শোক শুকিয়ে যায় অনেকটাই। ব্যস্ত সমস্ত হয়ে ল্যাবে ঢুকেছি। কারিন থামালো হঠাৎ। ‘আজকে জিসেলের ফ্লাইট’। বলেই সে স্বভাবসুলভ কাঁধ ঝাঁকিয়ে বেরিয়ে গেল। সাথে সাথেই প্লেন উড়ে যাবার শব্দ কানে আসলো। এক দৌড়ে জানালার কাছে চলে এলাম। বিচিত্র অস্থিরতা কাজ করছে। নাহ্ব, তাজা বাতাস দরকার।

ক্যাম্পাসের বড় মাঠের এক ধারে বসেছি। তাজা হাওয়ার কানাকানি। তবু যেন বুক ভরে শ্বাস নেয়া যাচ্ছে না। আরো একটা দু’টো প্লেন উড়ে যাচ্ছে দূর আকাশে। কে জানে তার কোনটায় চেপে জিসেল দেশে ফিরছে। আহা, বাক্সে করে হলেও মেয়েটা বাড়ি ফিরুক।

আকাশের নীল থেকে চোখ নামিয়ে ঘাসের সবুজে দৃষ্টি ছুড়লাম। নিমিষেই যেন ঘাসগুলো ঢেকে গেল নরম তুষারে। অস্পষ্ট একটা ছবি ভেসে উঠলো। তুষার মাড়িয়ে লাল শাল উড়িয়ে ছুটে মিলিয়ে যাচ্ছে জিসেল। আর তার প্রানখোলা হাসিটা যেন তরঙ্গ তুলে আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়ছে তেপান্তরের আনাচে কানাচে। (সমাপ্ত)

সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জুন, ২০২১ রাত ১২:৩৯
১২টি মন্তব্য ১২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।

লিখেছেন সাইয়িদ রফিকুল হক, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৩:১৫



ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।
সাইয়িদ রফিকুল হক

বিএনপি ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে দেশে অনুষ্ঠিত “দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে”-এ অংশগ্রহণ করেনি। তারা এই নির্বাচনের বহু আগে থেকেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×