somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আনত যীশুর শহরে ১

১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২১ ভোর ৪:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


১.

তাড়াহুড়ো করে বাস ধরতে বেরিয়েছি। সকাল সকাল পৌঁছালে অফিসের কাজ গোছাতে সুবিধা হয়। বাস আর ধরা হয় নি। তার বদলে ধরা হয়েছে একটা নরম তুলতুলে হাত। সেটাকে মুঠোয় পুরে উদ্রভান্তের মত দাঁড়িয়ে আছি। মেয়েটা হারিয়ে গেছে। বয়স বছর পাঁচেক। নাম জিজ্ঞেস করলে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। এক দু’বার সে চেষ্টা করে আশা ছেড়ে দিয়েছি। এখন আমারো কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে।

‘বাহ্, তুমি এসে গেছো। একটা গতি করো তো দেখি’। কথাটা বলেই স্কুলব্যাগ পিঠে সাত-আট বছরের ছেলেটা বাঁইবাঁই করে সাইকেল চালিয়ে ইশকুলের পথ ধরলো। বাচ্চা মেয়েটাকে কাঁদতে দেখে সে-ই সাইকেল থামিয়ে থমকে দাঁড়িয়েছিল। এখন বড় কাউকে পেয়ে তার জিম্মায় সঁপে দিয়ে তার তড়িৎ প্রস্থান। মাঝখান থেকে আমি বেচারা ফেঁসে গেলাম মনে হচ্ছে।

ইতিউতি তাকিয়ে কি করি উপায় মিলছে না। একেবারে পুলিশে ফোন লাগাবো? নাকি আশেপাশে খুঁজে দেখবো। কিন্তু হারিয়ে যাওয়া বাচ্চা নিয়ে ঘুরে বেড়ালে মুশকিল। দেখা গেল শেষকালে নিজেই ‘শিশু পাচার’ আইনে মামলা খেয়ে গেছি। বাসে করে অফিস যাবার বদলে পুলিশভ্যানে চেপে হাজত বরাবর রওনা দিয়েছি। এই ছত্রিশ ঘা পিঠে পড়লো বলে।

নাহ্, মিউমিউ ফ্যাঁচকান্নায় মাথা ধরে যাচ্ছে। আর না পেরে বললাম, ‘কে ছিল সাথে? মা নাকি বাবা?’। জবাবে সে পশ্চিমে তাক করে জানালো, ‘ওদিকে বাবা গেছে’। আর পূবের দিকে হাত উঁচিয়ে বললো, ‘আর এদিকে মা’। দেখেশুনে মেয়েটাকে উত্তরে রেখে দক্ষিনে হাঁটা দিতে মন চাইলো আমার। কিন্তু মন চাইলেও পা সরলো না।

পাশেই সুপারমার্কেট। ঢুঁ মেরে দেখবো কি না ভাবছি। মেয়েটাকে দাঁড় করিয়ে রেখে ওর মা আবার সেখানে গেল না তো?‘আচ্ছা চলো দেখি দোকানের ভেতর। মা বোধহয় কিছু কিনতে গেছে‘। বলা মাত্র কড়ে আঙুলটা খামচে ধরলো মেয়েটা। হালকা ঝাড়া দিয়ে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করলাম। লাভ হলো না। বরং একে একে তর্জনী, মধ্যমা, অনামিকা আর বুড়ো আঙ্গুলটাও সে তালুবন্দী করে নিল। কারো হাতে তাকে গছিয়ে দিয়ে সটকে পড়ার যে হালকা ফন্দিটা উঁকি দিচ্ছিলো মাথায়, সেটা ফুৎ করে নিভে গেল।

‘এ্যাই যে গনি মিয়া, মেয়েটাকে চেনো নাকি?। ওর মা হঠাৎ হাপিশ হয়ে গেছে। কি করি বলো তো?‘। বাড়ির পাশের একমাত্র দোকান বলে ক্যাশিয়ার, কর্মচারী-সবার সাথে ভাল রকমের ভাব আছে। গনি মিয়া ঘানার লোক। মোটাসোটা, অমায়িক মানুষ। সে তার বিরাট ভুরি আর চকচকে টাক নিয়ে উদ্বিগ্ন ছুটে এল। ‘আরে, এ তো সেলেকা। মা’র সাথে প্রায়ই আসে‘। হাঁপ ছাড়লাম। যাক, বাপু, কেউ তো অন্তত চিনতে পেরেছে মেয়েটাকে। গনি মিয়া এক নিমেষে সব সারিগুলো দেখে নিয়ে বললো,’ কিন্তু ওর মা তো নেই এখানে’। কপালের ভাঁজগুলো সোজা হয়েও আবার ভাঁজ খেয়ে গেল। ঠিক যেন ইসিজি গ্রাফ।

‘তুমি এক কাজ করো না। পুলিশে ফোন লাগাও’। বলেই সে ডিউটির অজুহাতে কেটে পড়লো। খেটে খাওয়া মানুষ। দোষ দিয়ে কি কাজ। তার চেয়ে মেয়েটা সমেত বেরিয়ে এসে মুঠোফোন হাতে নিলাম। এক-এক-দুই চেপে কানে লাগাতেই ওপাশ থেকে ভেসে এল জরুরী কন্ঠ, ‘কোথায় আগুন লেগেছে শীগগির বলুন। রাস্তার নাম আর বাড়ির নম্বর, কুইক!’। বুঝলাম, ভুল নম্বর চাপা হয়েছে। ফায়ার সার্ভিসে ফোন দিয়ে দিয়েছি। কোনোমতে মাফ চেয়ে আবার নতুন করে বোতাম চাপতে লাগলাম।

এবার ঠিকঠাক এক-এক-শূন্য টিপেছি। বাজখাঁই গলার কেউ ধরলো। কথায় খাস বাইরিশ টান। বাভারিয়া রাজ্যের আঞ্চলিক ভাষা আর কি। চলিত জার্মানই ভালো পারি না, তায় আবার বাইরিশ ডায়ালেক্ট। লোকটা প্রটোকল মেনে কি সব জানতে চাইছে, ধুর ছাই কিচ্ছু বোঝার উপায় নেই। সুতরাং, কলকাতার লোক নোয়াখালীওয়ালার পাল্লায় পড়লে যা হয়, তেমন দশা হল। চাইছি জল, আর আনতে গেছে হানি। প্রায ঝগড়া বেঁধে যাবার জোগাড়।

তাকে আর প্রটোকল ফলানোর সুযোগ না দিয়ে শেষমেশ ভাঙ্গাচোরা জার্মানে গাঁকগাঁক করে বলে গেলাম, ‘বাচ্চা হারানো কেস। অমুক রাস্তা, তমুক মোড়। অতএব, কাম শার্প‘। পাশ থেকে সেলেকা একটা সময়োচিত ভ্যাককান্না জুড়ে দিল, ‘ভ্যাঁআআ...’। আমাদের টিমওয়ার্কটা জমে গেল বেশ। ওপাশ থেকে ব্যস্তসমস্ত কন্ঠে ‘এক্ষুনি আসছি’ জাতীয় কিছু শুনলাম মনে হল। যাক, বাঁচোয়া।
নিশ্চিন্তে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম। ‘এই হলুদ-নীল ডোরাকাটা গাড়িতে পুলিশ মামা এল বলে...’। ভুংচুং দিয়ে ছোট্ট কিন্তু বজ্রমুঠি থেকে আঙ্গুলগুলো ছাড়িয়ে নিচ্ছিলাম। হাত মোছা দরকার। নাকের পানি চোখের পানিতে পিচ্ছিলপ্রায়। সেলেকা ফোঁৎ করে নাক ঝাড়ার সময়েও আমার হাতটা হাতছাড়া করে নি। হই না যতই অচেনা আগুন্তক।

প্যাঁ পোঁ সাইরেন কানে আসছে। পুলিশি, দমকল না অ্যাম্বুলেন্স, সেটা ঠাহর করতে ঘাড় ঘোরানোর আগেই জামার ঝুল ধরে সেলেকা সামনের দিকে টানতে লাগলো সামনের পানে। কিন্তু এখন জায়গা বদল বোকামি হবে। পুলিশ খুঁজে পাবে না আমাদের।
‘সামনে চলো, হাঁটো, হাঁটো। আমার কিন্ডারগার্টেন ঐ যে’। এবার জিজ্ঞাসু গলায় বললাম, ‘কই যে?’। দু’পা এগোতেই নীল ফটক চোখে পড়লো। তাতে বড় হরফে লেখা, ‘সেন্ট আন্টন কিন্ডারগার্টেন’। এবার খঁচে গেলাম রীতিমত। এর হদিশ আগে জানলে তো আর পুলিশ ডাকতে হত না। থানার খাতায় নাম-ঠিকানা উঠে যাওয়া কি ভাল?

মিনিট দশেক বাদে কিন্ডারগার্টেনের টিচারের কাছে সেলেকাকে বুঝিয়ে দিয়ে ঝাড়া হাত-পা নিয়ে বেরোলাম। পুলিশও তাদের গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়েছে। এদিকে আর আসতে হচ্ছে না। তবে বিকাল অবধি সেলেকাকে কেউ নিতে না এলে কেস আবার থানা-পুলিশেই গড়াবে। জল সে অবধি না গড়ালেই হল।

যাহোক, অসময়ে গির্জার ঢং ঢং শব্দে সম্বিত ফিরে পেলাম। বাসটা ঠিক নাক বরাবর দাঁড়িয়ে। খেয়ালই হয় নি। এই ছেড়ে গেল বলে। পড়িমড়ি করে শেষ মুহূর্তে লাফিয়ে চড়লাম। ঝকমকে দালানের সারি আর তকতকে রাস্তার চকচকে গাড়ির ভিড় ঠেলে এগোতে লাগলো বাসটা। এমন গোছানো, অভিজাত শহরেও মানুষ আলপটকা হারিয়ে যায়। কি কান্ড!

‘হেই সেলেকা বেগম, মায়ের সাথে ঠিকঠাক বাড়ি ফিরো কিন্তু। আর যেন হারিয়ে যেও না কখনো‘। কথাগুলো মনে মনে বলে জানালার বাইরে দৃষ্টি ছুড়লাম নির্বিকার। (ক্রমশ)
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২১ ভোর ৪:৩৭
৬টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অহমিকা পাগলা

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১৪


এক আবেগ অনুভূতি আর
উপলব্ধির গন্ধ নিলো না
কি পাষাণ ধর্মলয় মানুষ;
আশপাশ কবর দেখে না
কি মাটির প্রণয় ভাবে না-
এই হলো বাস্তবতা আর
আবেগ, তাই না শুধু বাতাস
গায়ে লাগে না, মন জুড়ায় না;
বলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩




তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×