আনত যীশুর শহরে ৩
আনত যীশুর শহরে ২
আনত যীশুর শহরে ১
৪.
টিনের বাক্সে চাকা লাগিয়ে ছেড়ে দিলে যেমন গড়িয়ে চলে, তেমনি ঝনঝনিয়ে গ্যোথেপ্লাৎজ স্টেশনে এসে থামলো রদ্দি মার্কা ট্রেনটা। জার্মানদের এই এক গুন। কিংবা বে-গুন। ভাঙ্গাচোরা মাল ভেঙ্গে সাত টুকরো না হওয়া পর্যন্ত নাট-বল্টু টাইট দিয়ে দিব্যি চালিয়ে দেয়। বিকট ঘটাং শব্দে ধাতব হাতল ঘুরিয়ে নেমে আসলাম। বাবা গো, হাতটা গেছে।
হাই-ফাই অটোমেটিক ট্রেনও আছে। কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছানো বলে কথা। প্লাটফর্মে যেটা আগে আসে, সেটাতেই বাদুড় ঝোলা হয়ে ঝুলে পড়ি। বেশির ভাগ দিনই ঘটাং ট্রেন জোটে কপালে। তবে সময় মতো পৌঁছে দেয় বাড়ি। তাই তার সাত খুন মাফ।
ছেলেটাকে ইশকুল থেকে তুলতে হবে। সময়ের আগে চলে এসেছি। এখনো পাক্কা মিনিট পনেরো হাতে। মোড়ের ক্যাফেতে এক প্রস্থ কফি হয়ে যাবে নাকি ভাবছি। এমন ছোট ছোট অবসরগুলো দুর্লভ বোনাসের মত। বোনাস উদযাপন করা উচিত। লম্বা লম্বা পা ফেললাম।
অমনি কোত্থেকে এক উটকো আধ মাতাল দড়াম্ ধাক্কা মেরে গেল। কি আশ্চর্য, ধাক্কা খেয়ে উল্টো নিজেই মুখ ফসকে স্যরি বলে ফেলেছি। নিজের গাধামিতে গা জ্বলে গেল। সেটা পুষিযে নিতে মনে মনে কড়া কয়েকখানা গালি দেবার তোড় করছি। সুযোগটা অবশ্য দিল না সে। হুড়মুড়িয়ে গিয়ে প্লাটফর্মের এক থাম্বার নিচে ঝুপ্ করে বসে পড়লো। চুরচুর হদ্দ মাতাল যাকে বলে। কয় পেগ টেনেছে খোদা মালুম। এখন একদিকে গড়িয়ে রেললাইনের ওপর গিয়ে পড়লে না হয়। স্টেশনে ভিড় নেই, শুনশান। পড়ে গেলে খেয়াল করবার লোক নেই।
ধ্যাৎ, পড়ুক গে যে চুলায় পড়ার। এক কাপ ধূমায়িত কফির উষ্ণ চিন্তাটা থেকে একচুল নড়লাম না। বেরিয়ে এলাম স্টেশন ছেড়ে।
এগিয়েও গিয়েছি কয়েক কদম। কি ভেবে থামলাম। বছরখানেক আগে কে যেন এই গ্যোথেপ্লাৎজে সুইসাইড খেয়েছিল। সে তো মরেই ছিল। বাকিদেরও ভুগিয়েছিল চরম। পুরো স্টেশন শাট ডাউন ছিল সেদিন। ট্রেনের অভাবে তিন-চারটা বাস-ট্রাম ঠেঙ্গিয়ে অফিস গিয়েছিলাম বহু কষ্টে। এই মাতাল যদি সত্যি সত্যি গড়িয়ে রেলে কাটা পড়ে, তাহলে কাল আর ট্রেন ধরতে হবে না।
ইতস্তত করে এক-এক-দুই চাপলাম। পুলিশের নম্বর।
-‘লোকটা কি আরব চেহারার?’।
-‘এ্যা, ইয়ে, দেখতে তো পাক্কা জার্মান। বড় জোর ইস্ট ইউরোপীয় হতে পারে’।
‘দাড়ি-মোঁচ আছে? বয়স কত, উচ্চতা কেমন, মাতাল নাকি নেশাখোর টাইপ...?’।
রীতিমত পুলিশি জেরার মুখে চিঁ চিঁ জবাবে জানালাম, ‘চাপ দাড়ি আছে, চল্লিশ-টল্লিশ হবে, আর মাতালই তো ঠেকলো..’।
‘এক্ষুনি টিম পাঠাচ্ছি। আপনি স্টেশনে ফিরে যান প্লিজ, লোকটাকে খুঁজে পেতে সহজ হবে’।
বাধ্য ছাত্রের মত সায় দিয়ে উল্টো ফিরে লেফট্-রাইট ঠুকলাম। গাট্টাগোট্টা জার্মান পুলিশের সাথে মোলাকাৎ বোধহয় আর ঠেকানো গেল না। কি দরকার ছিল গায়ে পড়ে নম্বর ঘোরানো। একটা-দু’টো মাতাল কি পাগল তো সব স্টেশনের কোনাকাঞ্চিতেই গড়াতে থাকে। এরা জাতে মাতাল, তালে ঠিক। রেলে কাটা পড়ার মত নবীশ এরা না। খামোখাই খাল কেটে পুলিশ-কুমির আনছি। এখন আমাকে হাঁ করে গিলে নিয়ে হাজতে উগড়ে না দিলেই হয়।
ভীরু পায়ে দ্রুত নেমে এলাম পাতাল স্টেশনে। সব ক’টা খাম্বা-থাম্বার চারপাশে চোখ বোলালাম। নেই। লোকটা ভ্যানিশ! হঠাৎ শেষ মাথার পিলারের কাছে এক মাঝবয়সী মহিলাকে উবু হয়ে বসে থাকতে দেখলাম। যেন কারো সাথে কথা বলছে। প্রায় ছুটে গেলাম। আরে, এই তো সেই মাতাল। মাথাটা বুকের সাথে ঠেকানো। কাঠের পুতুলের মত লাগছে।
মহিলা হাতের ইশারায় কিছু একটা বললেন। বুঝলাম, জোর কাউন্সেলিং চলছে। তবে লোকটার প্রতিবাদী বিড়িবিড়ানি শুনে মনে হচ্ছে ভাল কথায় চিড়ে ভিজছে না। খুব সাবধানে গোল হয়ে চক্কর কাটছি। সরোজমিনে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষন আর কি। টুকরা কথাগুলো কানে আসছে ভাঙ্গা ভাঙ্গা।
‘জীবনে কত কি করার আছে। লাফ তো কোনো সমাধান না। সব রেখে এক লাফে পগাড়পার হলে লাভটা কি হলো, বলো?’।
এ তো দেখছি রবিবারের গির্জায় পাদ্রীর আওড়ানো বুলির মত একঘেয়ে বাৎচিত!
সামান্য মাথা ঝাঁকিয়ে কথাগুলো ঝেড়ে ফেলে দিলো মাতাল লোকটা। মাতালভাব কমে গিয়ে তাকে এখন উদ্ভ্রান্ত লাগছে। চোখ দু’টো ভাটার মত জ্বলছে। যেন একটা সুযোগ খুঁজছে। আড়চোখে বারবার রেললাইনের দিকে তাকানোটা মোটেও ভাল ঠেকছে না। লোকটা তাহলে সত্যি সত্যি সুইসাইড খেতে এসেছিল। এই অচেনা, আগুন্তক মহিলা যেচে পড়ে একে না থামালে এতক্ষনে মামলা খতম হয়ে যেত।
চোখের সামনে মরতে চাওয়া একটা আস্ত জ্যান্ত মানুষকে নির্বিকার বসে থাকতে দেখে বিস্ময় আর কাটছে না। কি তার কাহিনী, কি তার ব্যর্থতা কিংবা বেদনা, কিছুই জানার উপায় নেই। একটা অদ্ভূত ভোঁতা অনুভূতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। পুলিশ এসেই বা কি করবে। এতো ‘ধরো তক্তা, মারো পেরেক’ টাইপ চোর-পুলিশ কেস নয়।
এদিকে দুই মেরু থেকে দুই ট্রেন প্লাটফর্মে ঢুকছে। লাফ দেবার মোক্ষম সময়। আর যদি ঝাঁপিয়ে পড়েই, তাহলে তাকে ঝাঁপানোর আগেই ল্যাং মেরে ফেলে দেবো নাকি জ্যাকেট ধরে হ্যাঁচকা টানে প্লাটফর্মে তুলে আনবো- এই সব হাস্যকর চিন্তা করছি। না করে উপায় নেই। কারন ভদ্রমহিলাও ঝুঁকি আঁচ করতে পেরে লোকটার কাঁধে আলতো হাত রেখেছেন। যেকোনো মুহুর্তে জাপ্টে ধরে পথ আটকে দেয়াই উদ্দেশ্য। চারপাশে আমজনতা যে যার মত ঘাড় গুঁজে আসছে যাচ্ছে। দৃশ্যটা হয়তো চোখেও পড়ছে না। প্রতিটা মানুষ যেন সংযোগবিহীন বিচ্ছিন্ন দ্বীপ।
আচমকাই ট্রেন দুটো গতি কমিয়ে খুব সাবধানে দাঁড়িয়ে পড়লো। কোথাও থেকে নির্দেশ এসেছে নির্ঘাৎ। ভাবতে না ভাবতেই পুলিশের ছোট দলটাকে দেখে হাত নাড়লাম দূর থেকে।
‘কই সে লোক, বলো। সিসি ক্যামেরায় পিলারের আড়ালগুলো ভাল করে দেখা যায় না‘।
আলাদিনের চেরাগ-দৈত্য সাইজের প্রকান্ড যন্ডা মার্কা পুলিশ বাহিনী দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেলাম। এরা কাঁধে দড়ি আর মই, সাথে ফোল্ডেড স্ট্রেচার, সিপিআর দেবার মেশিন আর কি সব নিয়ে কমান্ডো স্টাইলে চলে এসেছে। যোগাড়যন্ত্র দেখে কলিজা শুকিয়ে খাক্! ঢোক গিলে আমাদের নায়ককে দেখিয়ে দিলাম। পুলিশের একাংশ সেদিকে ছুটলো।
রয়ে যাওয়া মোটাসোটা মহিলা পুলিশ কাছে এগিয়ে সুধালো, ‘সে তো দেখছি দিব্যি প্লাটফর্মে বসে আছে। তুমি না বললে রেল লাইনে শুয়ে আছে?’।
শুনে চোয়াল ঝুলে গেল।
-‘এমন তো বলি নি। শুধু বলেছি রেললাইনে ঝাঁপ-টাপ দিতে পারে’।
-‘বানষ্টাইগ মানে প্লাটফর্ম। গ্লাইস মানে রেললাইন। আমরা কিন্তু দুই বার করে জিজ্ঞেস করেছি, লোকটা কি গ্লাইস-এ নাকি। তুমি হ্যাঁ বলেছো। এখন তোমার আউসভাইস, মানে পরিচয়পত্রটা দেখাও দিকি নি’।
রেসিডেন্স পারমিটের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইডি কার্ডটা বার করতে করতে প্রমাদ গুনলাম। অ-আ-ক-খ লেভেলের জার্মান দিয়ে এদেশে বেশিদিন টেকা যাবে না। একদিন ঠিক কোথাও এভাবে ফেঁসে যাবো।
-‘বাহ্, ক্লিনিকের গবেষক। একেবারে খারাপ না দেখছি। ডক্টর সারকার, এই নিন, ধরুন ‘।
বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বিবাদী সিল-ছাপ্পড় এবেলা বোধহয় বাঁচিয়ে দিল। এপিঠ-ওপিঠ কার্ড ঘুরিয়ে মহিলা পুলিশের কপালের ভাঁজ কাটলো মনে হল। তাছাড়া, এক ধাপে পুলিশি ‘তুমি’ গিয়ে ‘আপনি’তে ঠেকেছে। কানে বড় মিষ্টি লাগলো সম্বোধনটা।
দেঁতো হেসে মাতাল লোকটাকে ওদের হাতে ফেলে চলেই যাচ্ছিলাম। আপদ বিদায়ের আনন্দ হচ্ছে মনের ভেতর।
নাহ্, হল না। দুই পা এগিয়ে তিন পা পিছিয়ে ভদ্রমহিলাকে ধরলাম।
‘লোকটা কিন্তু সুইসাইড করতেই এসেছে। ভাগ্য ভাল যে আপনারা তাকে গ্লাইস-এর ওপরে চার টুকরো পান নি। বরং প্লাটফর্মে আস্ত পেয়েছেন। তাই বলছি, জোর খাটিয়ে কথা না বলে ইমোশনাল সাপোর্টের ব্যবস্থা করুন’।
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমরা দেখছি। নো ওয়ারিজ’। আশ্বস্ত করার খুব একটা চেষ্টা না দেখিয়ে ভদ্রমহিলা দায়সারা ভঙ্গিতে সেদিকে চললেন।
আর নাক না গলিয়ে অবাধ্য পা ফেলে ফিরে চললাম। হাতে সময় নেই একদম। ছেলেটা স্কুল গেটে একা দাঁড়িয়ে থাকবে। হেঁটে গেলে হবে না। লম্বা দম নিয়ে দৌড়ানো শুরু করলাম। চারপাশের এই ঘোর ধরানো পরাবাস্তব জগত থেকে বেরিয়ে যেতে হবে দ্রুত।
সময় না দিয়েই কাছের গির্জার ঘন্টা ঢং ঢং শব্দে বেজে উঠলো। আনত যীশুর এই শহর বড্ড যান্ত্রিক। জীবন এখানে ঘড়ির দুই বাহুতে বন্দী। এতটুকু ভুলচুক বরদাস্ত হবার নয়। তবুও কারো বা কখনো ভুল হয়ে যায়। চলার পথে এই ভুলে ভরা চরিত্ররাই পথ আগলে দাঁড়ায়। আফসোস্, তাদের কঠিন সব হিসেব মিলিয়ে দেয়া যায় না। কারণ, গল্পগুলোই যে অজানা। (সমাপ্ত)