গাড়ি থেকে নামতেই আস্তাবলের ওপাশ থেকে ঘোড়াগুলো চিঁহি ডেকে আমাদের স্বাগত জানালো। তাদের হাঁকডাকে দৌড়ে এল তিন-চারটা গোল্ডেন রিট্রিভার। শান্ত, সুনিবিড় খামারবাড়িটা শরগরম হয়ে উঠল পলকেই। পাহাড় ঘেরা আধবুনো এই খামারবাড়িতে সামনের ক’টা দিন জিরোবো বলে আসা। জায়গাটার নাম বোপার্ড। রাইন নদীর পাড়ে ছড়ানো সবুজ একটুকরো শহরতলী। কিন্তু জিরোতে এসে মনে হচ্ছে উল্টো হট্টগোলে পড়ে গেলাম। কোনার ছাউনি থেকে কতগুলো মুরগি কুক্কুরুক্কু চেঁচিয়ে হট্টগোলটা আরো জমিয়ে তুললো যেন।
যাহোক, আপাতত গাড়ির ব্যাকডালা তুলে স্যুটকেস আর ব্যাকপ্যাকগুলো নামিয়ে রওনা দিলাম সদর দরজা ঠেলে। মালিক গোছের কারো দেখা মিলল না। লাল টালির পাশাপাশি দুই বাড়ির একটায় চাবি ঝোলার কথা। আসার আগে ইমেইলে মালিকের সাথে তেমনি কথা হয়েছে। নম্বর মিলিয়ে প্রথম বাড়ির দিকেই পা চালালাম। চমৎকার এক ফালি আঙ্গিনার এক কোনে লোহার সিড়ি উঠে গেছে দোতলায়। বোঁচকাগুলো টেনে তুলতেই চাবির গোছা চোখে পড়লো।
কাঠের ঝুল বারান্দা ধরে এগোতেই দেখি চাবি আগলে পাপোষের ওপর চেগে-বেগে পেট ভাসিয়ে শুয়ে আছে এক থলথলে বিড়াল। তাকে সরায় সাধ্য কার। তাছাড়া, রাগী চাহনিটাও ভাল ঠেকছে না। সাথে থাকা ছেলে তাফসু মিয়া বিড়াল-প্রেমী লোক। কিন্তু তার বাবা রুমি সাহেব পুরোই এ্যান্টি-ম্যাও। এই হোৎকা বিড়াল নিয়ে এই দু’জন কুরুক্ষেত্র বাঁধিয়ে তুলবে নির্ঘাৎ। কিন্তু না, ‘পঁও’ করে গাড়ির হর্ন কানে আসতেই আয়েশী বিড়ালটা আড়মোড়া ভেঙ্গে উৎসুক ছুট দিল। তার পিছু পিছু আমরাও নেমে এলাম সিড়ি ভেঙ্গে।
আরেক গাড়ি বাঙালি বন্ধু-পরিবার এসেছে স্টুটগার্ট শহর থেকে। মৌরি আপু-হাদি ভাই আর তাদের পুত্রধন নূর। আর তাদের সাথে এসেছে এক হাড়ি গরুর মাংস ভুনা। জার্মান কায়দায় চোয়াল শক্ত করে সেদ্ধ আলু আর মাখন খাওয়ার চাইতে কব্জি ডুবিয়ে ভুনা মাংস আর গরম খিচুড়িযোগে পেটপূজার আবেদন অনেক উর্ধে। সুতরাং, অতি আবেগের সাথে মৌরি আপুদের বরন করে নেওয়া হল। এখন শুধু সঙ্গে করে আনা চাল-ডাল চাপিয়ে দিলেই কেল্লা ফতে। আমাদের ফ্ল্যাটে রান্নার ব্যবস্থা আছে থালা-পেয়ালা-খুন্তি-চামচসহ।
খানিক পরের ছবি। দলের শিশুরা হল্লা করে আঙ্গিনায় খেলছে। কতগুলো টাট্টু ঘোড়া এসে ঘোট পাকিয়েছে তাদের সাথে। আরো জুটেছে অতিকায় এক কালো-গোলাপি শুকর। বাড়ির মালিক এই ফাঁকে উদয় হয়ে আশ্বস্ত করলেন, ‘এরা সব খামারবাড়ির লোকজন। এদের থেকে ভয় নেই। শুধু শুকরটাকে উল্টাপাল্টা গুঁতো না দিলেই হল। বেচারার বয়স প্রায় তেরো বছর। ফোঁ ফোঁ করে ঘুমাতে পারলেই বাঁচে’। বাচ্চারা কথাগুলো খুব মনোযোগে শুনে নিয়ে কোত্থেকে এক কঞ্চি কুড়িয়ে এনে বুড়ো শুকরের কান চুলকে দিতে ছুটলো।
মালিক ভদ্রলোক পঞ্চাশের কোটায় হবেন। রুপালি চুলে ঢেউ খেলিয়ে দারুন সুপুরুষ হেসে জানতে চাইলেন, ‘কি, ঘরদোর পছন্দ হয়েছে তো? ও হ্যাঁ, সকালে নাস্তার ইচ্ছে থাকলে এই ঝুড়িটা বারান্দায় টেবিলের ওপর রাখলেই হবে। এক থলে রুটি দিয়ে যাবখন’। আমরা ইতস্তত করছি দেখে বিরাট রকমের রুটিখোর হাদি ভাই ছোঁ মেরে ঝুড়িটা নিয়ে নাস্তার অর্ডার পোক্ত করে ফেললেন। খিচুড়ি-খেকো মৌরি আপু আর আমার ওপর তার ভরসা নেই। ওদিকে, তার বুয়েটের ছোট ভাই রুমি একজন তেলাপোকা বিশেষ। আজকের লেফট-ওভার সে কালকে সাপ্টে দেবে বিনা বাক্যব্যয়ে।
তবে একটপরেই বাসমতি চাল আর মসুর ডালের ঝাঁঝালো আহবানে সাড়া না দিয়ে উপায় থাকলো না কারো। কলকল রাইন নদী আর শ্যামল পাহাড় যথাক্রমে ডানে আর বাঁয়ে ফেলে আমরা কতগুলো পাঁড়বাঙ্গাল থালা সাজিয়ে বসে পড়লাম আহারব্যঞ্জনে। লেবুর হলদে ফালিগুলো বাসনা ছড়িয়ে পড়ন্ত বিকেলে খিদের আগুন বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুন।
আগস্টের সূর্যটা পড়ি পড়ি করেও পড়ছে না। পাহাড়ের আড়ালে আধেকটা মুখ লুকিয়েছে মাত্র। এই আলোতেই খামাবাড়িটা ঘুরে দেখছি। পদ্মপুকুরের আদলে গড়া পুকুরে নাম না জানা ফুল ভাসছে। তার ভেতরেই ভুস্ করে ভেসে উঠলো কে যেন। এখানকারই আর কোনো অতিথি হবেনও বা। হালকা হাত নাড়িয়েই অতলে ডুব দিলেন আরেক দফা। পদ্মপুকুর ছাড়িয়ে খরগোশের ডেরার সামনে থামলাম। সাথে কতগুলো ছোপানো রঙের গিনিপিগ আর হ্যামস্টার ঘুরে বেড়াচ্ছে অবাধে। খরগোশগুলো তাতে বোধহয় কিছুটা ক্ষ্যাপা। ভাবেসাবে ব্রাহ্মণ খরগোশগুলো গিনিপিগের দল থেকে ক্ষত্রিয়-শূদ্রের দূরত্বে ঘাস চিবিয়ে জপ-তপে ব্যস্ত। তাদের আর না ঘাটিয়ে ঘোড়ার আস্তাবলের দিকে এগোলাম। আস্তাবলের চারপাশে বিরাট খোলা মাঠ। কেশর দুলিয়ে একেকটা ঘোড়া রাজকীয় ভঙ্গিমায় হাঁটছে। মোদ্দা কথা, আমাদের শহুরে চোখ যা দেখছে, তা-ই ভাল লাগছে।
পায়ে পায়ে নদীর ওধারে চলে আসা। গাছের ছায়ে কাঠের আরাম কেদারা দেখে গা এলিয়ে দিলাম। পাহাড় এখানে ঢালু হয়ে নেমে গেছে বহু দূর। হাত বাড়িয়ে মিতালি পাতিয়েছে অবিরাম বয়ে চলা রাইন নদীর সাথে। এই জার্মান মুলুকের দীর্ঘতম জলতরঙ্গ। রাইনের প্রশ্রয়ে কালে কালে দুই ধারে কত লোকলয় গড়েছে লোকে। তার ছাপ রয়ে গেছে ছড়ানো-ছেটানো ছোট-বড় কেল্লা আর দূর্গের প্রাচীরে। সব মিলিয়ে নাকি গোটা চল্লিশেক দূর্গই আছে এদিকটায়। গোটা চারেক দেখলেই চলবে আমাদের। দূর্গের ইতিহাস নিয়ে তো আর থিসিস লিখতে আসি নি। আসার উদ্দেশ্য তো আসলে বায়ু-বদল। নদীর কূলে গড়ান দিয়ে ভরপেট আলসেমি।
মরাল গ্রীবা বাঁকিয়ে ভিনদেশী তরঙ্গিনী বয়ে চলেছে আপন মনে। গোধূলি লগ্নের আলো-আঁধারিতে রাইন নদীকে এক রহস্য মানবীর মতই দুর্বোধ্য লাগছে। যেন কত না অজানা লুকিয়ে আছে তার জলের অতলে। তবে একটা রহস্য নাকি সত্যিই রাইনের তীরে ঘুরপাক খায়। এক অপরূপা এলোকেশী, নাম তার লোরেলাই। এখানকার লোকাল মিথ। বহু ঘটন-অঘটনের সাথে নাম জড়িয়ে আছে লোরেলাইর বেনীর গাঁথুনিতে।
লোরেলাইয়ের পুরো গল্পটা বলার জন্যে মৌরি আপুকে চাপাচাপি করেও লাভ হল না। ‘যেদিন যাবো, সেদিন তো দেখবেই। থাক না গল্পটা তোলা সে পর্যন্ত’। সাথে হালকা তিরস্কার, ‘এই বেড়ানোর বুকিং-টুকিং সমেত সব আয়োজন করলাম আমি। এখন আবার গল্পও বলে শোনাতে হবে আমাকে? তুমি আলসের ডিপো, ধাড়ি মেয়ে তাহলে করবেটা কি?’। বকুনিতে দমে যাবার পাত্রী নই। বরং রাইনের রোমান্টিক সন্ধ্যায় ‘ধাড়ি মেয়ে’ তকমাটা মাথায় নিয়ে নীরবে বেশরম হাসলাম এক চোট। এই ট্যুরের অঘোষিত গাইড মৌরি আপু। কাল না হয় পরশু রাইন নদীর এলোকেশীর কাহিনী দাড়ি-কমা-রেফারেন্সসহ শুনতে পাবো, এ আমি লিখে দিতে পারি।
জোনাক চাদরে রাত নেমেছে পাহাড়ে। মিটিমিটি আলো জোনাকির মতই লাগছে দূর থেকে। আমরা কাঠের বেঞ্চি ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। খামারবাড়ির মালিক মুরগিগুলো খোয়াড়ে তুলছে। আমরাও নূর আর তাফসু মিয়াকে ঘরে তুলে ফেললাম। হাদি ভাই আর রুমি গিয়েছে আশেপাশের দোকানে, এই কয়দিনের তেল-চিনি-নুনের সদাই কিনতে। দিনের বেলা বাইরে যেনতেন কিছু একটা খেয়ে চালিয়ে দিলেও রাতে ফিরে এক থালা দেশি ডাল-ভাতের আহার না হলে আহারে আহারে কাতরাতে হবে। বাঙ্গালির ভ্রমন-গাড়ির ইঞ্জিন যে তার পেটের ভেতর। (চলবে)
জোনাক চাদরে রাত নেমেছে
খামারবাড়ির টাট্টু ঘোড়া
রাইন, জার্মানির দীর্ঘতম নদী
গাছের ছায়ে কাঠের আসন
খামারবাড়ির আরো টাট্টু ঘোড়া
আঙ্গিনায় খেলায় মগ্ন দলের শিশুদ্বয়
এলোকেশী লোরেলাই, রাইনের রহস্যমানবী
দু'টি শিশু ও একটি বিড়াল
খামারবাড়ির একাংশ
গোধূলি লগ্নের আলো-আঁধারিতে রাইন নদী
খামারবাড়ির কালো-গোলাপি শুকর, ঘুমাতে পারলেই বাঁচে
নাক উঁচু খরগোশের দল
টাট্টুর ঘোড়ার সাথে দলের কনিষ্ঠ সদস্য, নূর