somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রাইন নদীর এলোকেশী ৩

১৪ ই মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৪১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
পর্ব ১ এখানে পড়ুন
পর্ব ২ এখানে পড়ুন


রাইনের ছোট্ট শহর সেন্ট গোয়ার্সহাউজেন। আরেক নাম লোরেলাইষ্টাড বা লোরেলাই-নগর। শহরটাকে নিচে রেখে আমরা ওপরে উঠছি গাড়ি সমেত। পাহাড়ি সরু পথ যেন জিলাপীর প্যাঁচ। পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে উঠতে গিয়ে কাল ঘাম ছুটে গেল আমাদের চালক মৌরি আপু আর রুমির। এলোকেশী লোরালাইর সন্ধান পাওয়া দেখছি চাট্টিখানি কথা নয়। এখন লোরালাই যদি দেখতে অপরূপা উর্বশী না হয়ে কুঁজো-পিঠ, মূলা-দাঁত, ঝোলা-নাক, বদখত এক ডাইনি হয়, তাহলে এদের হতাশা রাখার আর জায়গা থাকবে না।

জায়গাটা যত্ন করে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা। পাহাড়ের কোলে লুকানো বিরাট এক বাগান। চারপাশে লাল-সাদা গোলাপের কেয়ারি। ঝোঁপঝাড়ে বাহারি ছাঁট। এখানে সেখানে জলের ফোয়ারা। নন্দনকানন একেবারে। অথচ কোথাও কোনো নিশানা দেয়া নেই যে লোরালাই কোথায় আছে। তবুও নুয়ে পড়া ফুলেরা কিভাবে যেন পথ চিনিয়ে নিয়ে গেল গন্তব্যে।

রাইন এলাকার আঞ্চলিক ভাষায় ‘Lureln‘ মানে ‘মর্মরধ্বনি’ আর প্রাচীন কেল্টিক শব্দ ‘Ley‘, বা ‘পাথর’- এই দুই মিলে লোকমুখে ঘুরে ফিরে Lorelei বা লোরালাই-তে আদল নিয়েছে। আমরা যে পাথুরে চাঁইয়ের ওপর দাঁড়িয়ে আছি, তার নামই লোরেলাই। দৈর্ঘ্যে প্রায় দেড়শ মিটার আর চওড়াও তেমনি হবে। নদীর অতল ফুঁড়ে অট্টালিকার মত অটল দাঁড়িয়ে এই লোরালাই। যে কারনে নদী এখানে আচমকাই সরু। শান্ত রাইন এই সরু পথে বাঁধা পেয়ে অশান্ত ঢেউ তোলে প্রবল। একটু বেহালে হাল ধরলেই জাহাজ টালমাটাল। বহু নৌকাডুবির অঘটন ঘটেছে এখানে শত শত বছর ধরে।

তবে লোকগাঁথায় নৌকাডুবির ঘটনা আরেকটু সরেস। এক ছিল লোরেলাই নামের এক অনিন্দ্যসুন্দরী। পাহাড়ের কিনারায় সে বসে থাকতো এক পিঠ সোনালি চুল মেলে। তার নীল চোখ, টিকালো নাক, পাতলা ঠোঁটে রূপ আর ধরে না। স্ফটিক ত্বকে যেন গোলাপি মুক্তার আভা। ফিনফিনে সফেদ পোশাকের ওপাশে পেলব অবয়ব বলে দেয়, সে এই পৃথিবীর কোনো মানবী নয়। যেন কল্পলোকের কল্পনারী। উদাস লোরেলাই পাথুরে চাঁইয়ে বসে দীঘল চুলে অলস বিনুনি কাটে আর আনমনে গান গায়। সেই সুর ঢেউ তোলে রাইনের ইথারে ইথারে। সুরের ঘোরে জাহাজী যুবকের মন হয় উন্মাতাল, উচাটন। মুখ তুলে পাহাড়পানে চাইতেই লোরেলাইর নীল চোখে চোখ পড়ে তরুন নাবিকের। আর অমনি হাত থেকে নৌকার হাল খসে পড়ে, পাল যায় হেলে। ওঁত পেতে থাকা রাইনের চোরা ঘূর্নিপাক তখন পাগলা খিদেয় গিলে নেয় জাহাজ-মাস্তুল-নাবিক-সব।

তবে লোরেলাইকে ভিলেন ভাবতে ভাল লাগছে না। বরং দুঃখী এক অভিশপ্ত মৎস্যকুমারী ভাবতে ইচ্ছে করছে। তার রূপে-সুরে ভুলে কেউ যদি জলে ডোবে, সে দায় তো লোরেলাইর না।

যাহোক, এদিক-ওদিক এলোমেলো কয় পা এগোতেই লোরেলাইর কুখ্যাত সেই শ্লেট-পাথরের চাঁই চোখে পড়লো। একালের হাতে বানানো হাতুড়ি-বাটালি সমেত। পর্যটক টানার কায়দা আর কি। সাথে শেকল দিয়ে জুড়ে দেয়া আছে ধাতব চিরুনি। তাতে লোরেলাইর নাম খোঁদাই করা। ছুড়ি-বুড়ি সব বয়সী মেয়ে-মহিলারা চাঁইয়ে বসে চিরুনি হাতে লোরেলাই সেজে সেলফি তুলতে মশগুল। হাদি ভাই আর রুমির চাপাচাপিতে মৌরি আপু আর আমাকেও লোহার চিরুনি উঁচিয়ে দাঁত কেলিয়ে পোজ দিতে হল। মুঠোফোনের পর্দায় সেই ছবি দেখে ছবিওয়ালার ঠিক সন্তষ্ট মনে হল না। ভাবখানা যেন, 'হুম্, কোথায় টিকালো নাক, পাতলা ঠোঁট আর কোথায় মূলা-দাঁত আর ঝোলা-নাক' (ফোঁওওশ দীর্ঘশ্বাস!)।

এই দুই বাঙালি ভাইকে যারপরনাই হতাশ করে মৌরি আপু আর আমি লোরেলাইর পাঁচ কেজি ওজনের বিচ্ছিরি চিরুনিটা ফেলে মূলা-দাঁত আর ঝোলা-নাক সমেত পাথুরে আসন থেকে লাফিয়ে নামলাম। লোরেলাইকে বিউটি স্ট্যান্ডার্ড মানতে নারাজ আমরা। আমাদের এক হাতে খুন্তি, তো আরেক হাতে কলম। চিরুনি কোলে লোরেলাইর মত কবিতা সেজে বসে থাকবার ফুসরৎ কই। ভাবনার লাটাইয়ের সুতো কেটে কোত্থেকে ছোট্ট নূর আর দুষ্ট তাফসু মিয়া দৌড়ে এসে জাঁপটে ধরলো। শিশুদের খিলখিল হাসি শতেক মুক্তা হয়ে ছড়িয়ে পড়লো নরম সবুজ ঘাসের কার্পেটে।

কিন্তু লোরেলাইর মন্ত্রে দেখছি মুগ্ধ শুধু রুমি আর হাদি ভাই-ই না, এই দলে কড়া ধাঁচের জার্মান কবি হাইনরিখ হাইনেও আছে। সে নাকি বিরাট বিরহে পড়ে 'লোরেলাই' নামে সুদীর্ঘ এক কবিতা লিখেছিল। তারই দুই ছত্র ব্রোঞ্জের পাতে খোঁদাই করে রাখা আছে এখানে। মনে মনে সাহস করে একটা চট্জলদি তর্জমা দাঁড় করালাম। সংবিধিবদ্ধ তর্কীকরণ হিসেবে বলে রাখি, হেনরিখ হাইনের অনুবাদ করতে যদি ডিম ভাজার চাইতেও কম সময় লাগে, তাহলে খুব বেশি আশা না করাই ভাল।

'Ich weiß nicht, was soll es bedeuten,
Daß ich so traurig bin,
Ein Märchen ans alten Zeiten,
Das kommt mir nicht aus dem Sinn.'

'কে জানে কি তার মানে,
কিসের ভারে মন গেছে নুয়ে,
প্রাচীন রূপকথার অলক ইশারা ছুঁয়ে,
অনন্ত ঘোর এক অস্তিত্বের সবখানে।'

কাকের ঠ্যাং-বকের ঠ্যাং অনুবাদটা কাউকে শোনানোর সাহস পেলাম না ঠিক। তাছাড়া কবিতা শোনানোর লোকেরা হঠাৎ ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছে। লোরেলাইয়ের প্রমান সাইজের এক তাম্র মূর্তির দেখা মিলেছে অদূরে। মুশকিল হল, ফিনফিনে সফেদ কাপড় তামার বুনোটে বোনা কঠিন কাজ। তাই লোরেলাইয়ের গায়ে একটা সূতোও নেই। তাতে অবশ্য রুমি আর হাদি ভাইয়ের উৎসাহে ভাটা পড়ল না। ঈশান-বায়ু-অগ্নি-নৈঋত, সব এ্যাঙ্গেল থেকেই ফটো খেঁচা চলল বেশুমার।

লোরেলাইর ভাস্কর্য ছাড়িযে দুই পা হাঁটতেই নজরে এল আজব এক দৃশ্য। পথের ধারে কাঠের নৌকা পড়ে আছে। আর তাতে উপচে পড়ছে রঙ বেরঙের অজস্র ফুল। বোধহয় লোরেলাইকে পূজার অর্ঘ্য দিয়ে গেছে মরে ভূত হওয়া রাইনের কোনো বোকা নাবিক। এদিকে, মাঝ দুপুরের কড়া রোদটা বলে দিচ্ছে আমাদেরও পূজার সময় হয়ে এসেছে। তবে এই পূজা, পেটপূজা। অগত্যা, কাছের রেঁস্তোরা বরাবর রওনা দিলাম আমরা সবাই।

খানিকবাদে যেন তেন দু'টো চর্ব্য-চোষ্য খেয়ে নিয়ে । চর্ব্য-চোষ্য বলার কারন, সেখানে মিললো শুরু রুটি আর সেদ্ধ আলু-টালু, বড় জোর কড়কড়ে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই। এই খেয়ে ভেতো বাঙ্গালির পেট ভরে, কিন্তু মন ভরে না। আজকে রাতে খামারবাড়ি ফিরে জম্পেশ একটা দেশি ডিনার না হলে চলছেই না দেখছি। তবে আপাতত, আলু খেয়েই টালুমালু এগোলাম পরের গন্তব্যে।

একবার ঠিক হল ইঁদুর কেল্লা আর বিড়াল দূর্গ দেখা আসবো। খুব নাম শুনছি এখানে আসা অবধি। পরে অবশ্য মত পাল্টে চলে এলাম ষ্টেরেনবের্গ কেল্লার ইয়া বড় ফটকে। এই কেল্লার খুব কাছেই আরেক দূর্গ লিবেনষ্টাইন। দুই দূর্গ ঘুরে দেখে মনে হল, এক কালে জৌলুসের কোনো অভাব ছিল না এদের। অথচ আজ যেন দেয়ালে দেয়ালে বড় অযত্নের ছাপ। জানা গেল, এই দুই মুখোমুখি দূর্গের ইতিহাস অনেকটা ইঁদুর-বিড়াল খেলার মতই। দুই ভাইয়ের দুই কেল্লা ষ্টেরেনবের্গ আর লিবেনষ্টাইন। বাবার সম্পত্তিভাগ নিয়ে তাদের লেজে-লেজে শত্রুতা।

রেশারেশির ফল ভাল হল না। পনেরশো আটষট্টি সালে দুই দূর্গ ছেড়ে লোকজন চলে গেল আর কোথাও। মতের অমিলের সাক্ষী হয়ে কেল্লা দু'টো একলা দাঁড়িয়ে রইল শত শত বছর। তারপর এই তো মাত্র কিছুদিন হল নোনা ধরা দেয়ালে চুনকাম পড়েছে মাত্র। বেহিসেবী গজিয়ে ওঠা লতা-গুল্ম সরিয়ে কিছু অংশে ক্যাফে-রেঁস্তোরা-হোটেলের জায়গা করা হয়েছে। কৌতূহলে আলো ঝলমলে কাঠের সিড়ি বেয়ে নামতেই দেখা গেল, অতিকায় হলরুমে বড় আয়োজন চলছে। বর-কনে স্যুট আর গাউনের জমকালো সাজে স্মিত হাসছে। ক্রিস্টাল সাঁঝবাতির আভিজ্যাতে আর ওয়াইন-শ্যাম্পেইনের সুবাসে চারপাশ ম' ম' করছে। ভাইয়ে-ভাইয়ে কালাকালের প্য্যঁচামুখ ঝগড়া হঠিয়ে বিয়ে-শাদীর হই-হুল্লোড় ভালই লাগলো দেখে। অনাহূত অতিথি না সেজে বরং পা টিপে বেরিয়ে এলাম ওখান থেকে। (চলবে)

জল্পনার জলপরী লোরেলাইর ধাতব কল্পনা

হয়তো লোরালাইর সুরে মোহগ্রস্ত নাবিকের ফুলেল নিবেদনের প্রতীক

এলোকেশী লোরালাইর চিরুনি পরখ করে দেখা আর কি

জার্মান কবি হেনরিখ হাইনের বিখ্যাত করিতা 'দ্যা লোরেলাই'-এর পংক্তিমালা

ইঁদুর কেল্লা আর বিড়াল দূর্গের মিনিয়েচার মডেল

পাহাড়চূড়ায় ছোট-বড় দূর্গ

বোপার্ডের পথে দূর্গের দেখা মেলে খুব সহজেই

লিবেনষ্টাইন কেল্লা

ষ্টেরেনবের্গ কেল্লার প্রবেশদ্বার
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৪৪
৫টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্মৃতিপুড়া ঘরে

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৩০



বাড়ির সামনে লম্বা বাঁধ
তবু চোখের কান্না থামেনি
বালিশ ভেজা নীরব রাত;
ওরা বুঝতেই পারেনি-
মা গো তোমার কথা, মনে পরেছে
এই কাঠফাটা বৈশাখে।

দাবদাহে পুড়ে যাচ্ছে
মা গো এই সময়ের ঘরে
তালপাতার পাখাটাও আজ ভিন্নসুর
খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×