somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ইভিনিং ইন প্যারিস

০৩ রা আগস্ট, ২০১৪ রাত ৮:৫৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

- এটা বোধ হয় অয়েল পেইন্টিং, তাইনা?
- হতে পারে, কিন্তু সাইডগুলা দেখেন, অয়েল হলে আরেকটু মসৃণ হতো।
- তাহলে কি ওয়াটার-কালার বলছেন?
- কি জানি, তবে অ্যাক্রেলিক হতে পারে। ইশ, হাত দিয়ে যদি দেখা যেত।
- তবে যাই বলেন ভাই, আর্টিস্ট কিন্তু তার সেরা কাজটাই করেছে। এই যে, এইখানে কালো দাগগুলা দেখছেন না? এটা কিন্তু একটা কিশোরী মেয়ের কালো চুলকে রিপ্রেজেন্ট করছে। হতাশা আর নারীত্বের একটা ফিউশন।
- আর ঐ নীল রঙের গোলমত ওটা কি বলেন তো।
- ইটস আ সান অফ টিয়ার্স অ্যান্ড ডিজাপয়েন্টমেন্ট... রাইট?
- এক্সাক্টলি।

বেদনার নীল সূর্যের ভেতরে দুখী নারীকে দেখতে সরে আসলাম একটু কাছে। তবে এরমধ্যেই আরেকজন নতুন একটা কনসেপ্ট নিয়ে হাজির হলো।

- ভুল বললেন দাদা। আমার তো মনে হয় এই কালো অংশটা ভবিষ্যতের ধ্বংস হয়ে যাওয়া পৃথিবীর একটা রূপ। ভালো করে দেখেন, হালকা একটা সবুজ শেড আছে, এবার বুঝতে পারছেন? গ্রিন ইজ বিকামিং অ্যাশেজ ফর পলিউশন।
- অ্যান্ড পপুলেশন।
- ঠিক ধরেছেন। হাহা...!!

খুব উঁচুমানের একটা সূক্ষ্ম রসিকতা মনে হলো, ধরতে পারলাম না। তবে আমি আরেকটু এগিয়ে গেলাম এবার সবুজ বিপ্লবের পতন দেখতে। কিন্তু জ্ঞান-চক্ষু প্রাণপণে বিকশিত করেও সরলরেখা আর বৃত্ত ছাড়া আর কিছু দেখতে পারলাম না। গোল্লাগুলা আমার দিকে ভার্চুয়াল স্মাইলির মত ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে তো আছেই।

মনে পড়ে, স্কুলজীবনে ড্রয়িং পরীক্ষায় এর থেকে অনেকগুণ সুন্দর একটা ছবি আঁকার পরও ম্যাডাম দশে তিন দিয়েছিলো। এটা দেখলে কত দিতো কে জানে। তবে আলোচনা ইতিমধ্যে হিমাঙ্কের কয়েক ডিগ্রী নিচে নেমে তুমুলভাবে জমে উঠেছে। বলাই বাহুল্য, এর পেছনে আর্টিস্ট ভদ্রলোকের থেকেও খর্বাকৃতির গ্লাসে রঙ্গিলা বংশীবাদক ব্যাগপাইপার্সদের মুন্সিয়ানাই বেশি।
বছরখানেক ব্যারেলে আটকে থেকে প্যারোলে মুক্ত হয়ে কি জাদুটাই না দেখাচ্ছে এরা।।

উত্তরা ১১ নাম্বার সেক্টর।
বিশাল বড় ডুপ্লেক্স বাড়ি। বাড়ির মালিক সোবহান সাহেব।

আমার মত ভ্যাগাবন্ড টাইপের ছেলে খুব বেশি এখানে নেই। দাওয়াতে যারা আছে প্রায় সবাই মোটামুটি বিশিষ্ট শিল্পপতি, ব্যবসায়ী নাহয় গোটা তিনেক গার্মেন্টের মালিক আর... অবশ্যই উপবৃত্তাকার এক সুডৌল ভুড়ির অধিকারী।
কিছু মেয়েকেও দেখা যাচ্ছে। বেশিরভাগই কাপড়ে সূতার ব্যবহারে অত্যন্ত মিতব্যয়ী। আবার কয়েকজন লো-কাট আন্টির লকেটের অবস্থান তো রীতিমতো বিএসএফের বর্ডারে, কাঁটাতারবিহীন উন্মুক্ত বর্ডার অবশ্যই।
রবীন্দ্রযুগে মানবীদের অর্ধেকটাই কল্পনা করার ছিলো। এযুগের ললনারা অনেকটাই লিবারেল, আমাদের কল্পনার ঝামেলায় ফেলতে চায়না তারা।

তবে এদিকে কারও পকেটে যে টাকা রাখার জায়গা নাই এটা বুঝতে পারছি। পকেটে থেকে উপচিয়ে টাকা না পড়লেও গ্লাসের উপচে পড়া লালচে তরল সেকথা জানান দিচ্ছে বারবার।
আমার মত অভাগার জন্য এই বাড়ির একশ গজের মধ্যে আসার কোনও কারণ নেই, যদি না সোবহান সাহেবের ছোট মেয়ে আমার কাছে প্রাইভেট পড়তো। তবে প্রধান কারণ এটাও নয়; প্রধান কারণ আমার বাবা।

আমাদের পল্লবীর আগের বাসায় তিনতলায় থাকতেন সোবহান সাহেব। অসম্ভব বিনয়ী ভদ্রলোক। তবে বাবা পছন্দ করতো না উনাকে তেমন। আমার যদিও বেশ লাগতো। তাই চুপচাপ চলে যেতাম উনাদের বাসায় প্রায়ই। স্কুলে তখন মাত্র ভর্তি হয়েছি, অহংকারে মাটিতে পা পড়ে না।
আর উনাদের বাসায় একগাদা আন্ডা বাচ্চা। আন্টিকে যে ঐ সময় কখনও খালি পেটে থাকতে হয় নি আরেকটু বয়স হওয়ার পর বুঝতে পারি।

যাইহোক, একদিন বাসার ড্রয়িং রুমে গিয়ে দেখি সোবহান সাহেব বাবার হাত ধরে অদ্ভুত ভঙ্গিতে বসা আর বাবা মাথা নিচু করে আছেন। আমাদের বাসায় তখন জগলু নামের একটা ছেলে কাজ করতো, আমার থেকে কয়েক বছরের বড় হবে। কয়দিন আগেই ও শিখিয়েছিলো যে, একটা ছেলে আরেকটা মেয়ে হাত ধরলে সেটাকে প্রেম বলে। কিন্তু দুইজন ছেলে ধরলে? তাও আবার ‘বড়-ছেলে’??

বোনকে জিজ্ঞেস করবো না মা’কে জিজ্ঞেস করবো অনেকক্ষণ এই চিন্তা করে পরে জগলুকেই জিজ্ঞেস করলাম। সে তার হলুদ দাঁত বের করে রহস্যময় হাসি দিলো। কিচ্ছু বুঝলাম না।
ঘটনা কি? এই টেনশনে তখন এর বেশি কিছু জানা হয়নি আর। তারও অনেক বছর পর বড়বোনের কাছ থেকে জানতে পারি বাকিটা।

সোবহান সাহেবের অনেক ব্যবসা ছিলো। কাস্টমসের চোখ-কান ফাঁকি দিয়ে ডলার আর ডায়মন্ডের রমরমা ব্যবসাও ছিলো। টাইমিং আর ঘুষে গণ্ডগোল হওয়ায় একবার চেকিং এ ধরা পড়ে গেলেন সুপারভাইজারের কাছে। হাই লেভেলে গিয়ে প্রমাণিত হলে জেলহাজত তো নিশ্চিত ছিলোই। আর এই ধরণের অপরাধে তখন ইনফর্মেশন বের করার জন্য নাকি সাপোজিটার স্টাইলে ডিম-থেরাপিও চলতো।
আমার বাবা ছিলেন কাস্টমসের সিনিয়র অফিসার। বেতনের টাকা বাদে আর কিছু ধরেন নি কখনও। ওদিকে সোবহান সাহেবকে বাঁচাতে হলে অফিসে নিজের সম্মান তো হারাবেনই, উলটো ট্যাক্সের ওলট-পালট কেউ ধরতে পারলে চাকরিশুদ্ধ হারাবেন।

শেষ পর্যন্ত বাবা ওনার অনুরোধ ফেলতে পারেন নি। চাকরি হারাতে হয়নি অবশ্য এজন্য।
তবে সোবহান সাহেবের অবস্থা এরপর ক্রমেই আকাশে উঠলেও বাবার প্রতি কৃতজ্ঞতা বশত আমাদের পরিবারের সঙ্গ তিনি ছাড়েন নি একদিনের জন্যও।
তাও পছন্দ করতেন না বাবা, কিছু বলতেনও না। তবে খুব বেশিদিন দেখতে হয় নি; বছর তিনেক পর বাবা মারা যান। সেবার প্রচণ্ড শীত পড়েছিলো। কম্বলের নিচে কাঁপতে কাঁপতে ঘুমাই, ঘুম থেকে উঠেও কাঁপতে থাকি। এত কম্পনের মধ্যেও কি মনে করে যেন বাবার হার্ট কাঁপাকাঁপিতে ইস্তফা দিয়ে ফেললো।

থাক সে কথা, ফিরে আসি পার্টিতে।
আর্টের গুরুগম্ভীর আলোচনার পর এবার রাজনীতির আলোচনাও জমে উঠেছে। আওয়ামি লীগ কিভাবে অসম্ভবকে সম্ভব করেছে সেটা গবেষণা করতে একদল আলাদা হয়ে গেলো। ওদিকে বিএনপির ছুঁড়ে মারা ককটেলেই যে একটার পর একটা প্লেন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে এটা নিয়েও দেখি টানটান উত্তেজনা।
হুইস্কিতে দাঁড়ি পর্যন্ত ডুবানো এক ভদ্রলোক এর মধ্যেই আবার ধর্মযুদ্ধ ঘোষণা করে ফেললেন- সবই ঐ হিন্দুদের চক্রান্ত। দেশে মানুষ থাকার জায়গা নাই, অথচ এত্তগুলা মন্দির। কোনও মানে হয়?

প্রমাদ গুণলাম আমি। এবার আর উপায় নাই, আমার নোকিয়া এগারশ’তে সাপের গেইমটা বের করে বসে পড়লাম এক কোণায়। বেশ ভয়ে আছি যদিও, হাতে মোবাইল দেখে এখন কেউ কাছে এসে ওয়াই-ফাইয়ের পাসওয়ার্ডটা না জিজ্ঞেস করলেই হয়।
উফ, আসল খাওয়া দাওয়া আসে না কেন? আর কত দেরি পাঞ্জেরি?

“আপনি কি কি মৃদুলাকে পড়ান?”
তীব্র পারফিউমের গন্ধ পেলাম সাথে সাথে। হাইহিল পড়া এই মেয়েটাকে অনেকক্ষণ ধরে আরেকটা ছেলের সাথে হাত ধরে রং-ঢং করতে দেখছিলাম এক কোণায়। অল্পবয়সী মনে হচ্ছে, আপনি বলবো না তুমি বলবো?
- আমাকে বলছুন?

এটা বলেই আবারো মেজাজ খারাপ হলো, কি বললাম এটা!! ‘বলছো’ আর ‘বলছেন’ এর মাঝামাঝি জায়গায় এসে ‘বলছুন’ হয়ে গেল শব্দটা। যত্তসব।
এদিকে ত্যাঁদড় মেয়েও ধরে ফেলেছে ভুলটা। হাসছে মিটিমিটি।
হ্যাঁ, আপনাকেই বলছু।
একটু থেমে যোগ করলো
- একটা হেল্প করতে হবে।
- কি হেল্প?

এবার আর তুমি আপনির ঝামেলায় গেলাম না, কথা ভাববাচ্যে বলাই মনে হচ্ছে নিরাপদ। মেয়ে যথেষ্ট বেয়াদব।
তবে জনৈকা ললনা যে এমনতরো হেল্প চাবে আশা করি নি। পরের কথাগুলা শুনে আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেলো।

যে লোকটা এতক্ষণ তার দুই হাত নিজের সম্পত্তি বানিয়ে দলাই মলাই করছিলো, সে নাকি ওদের অফিসের বস। আর প্রাইভেট কিছু হাইফাই-উচ্চবিত্ত অফিসের অলিখিত নিয়মে এটা নাকি প্রথম দিকের করণীয়। এধরণের পার্টি হলে তো কথাই নেই। তা নাহলে চাকরি থাকেনা।

জানতাম না এই নিয়ম, তাহলে বেহুদা এই কাঠখোট্টা লাইনে পড়াশুনা করে মাথার চুল-বিসর্জন কেন দিচ্ছি? আজকাল তো দেখি বঙ্গললনাদের নাগাল পেতে প্রেমের ময়দানে ভালো প্লেয়ার হওয়া লাগে না, উঁচু একটা চেয়ারই যথেষ্ট।
- তো আমাকে কি করতে হবে?
- আমি তো অনেক জুনিয়র লেভেলে আছি। তাই এখানে অনেকেই আমার সাথে বসগিরি ফলাতে হাজির হচ্ছে। আপনাকে আমার হাত ধরে কিছুক্ষণ ঘুরতে হবে শুধু আর কি।
- আর তারপর কালকের পেপারের হেডলাইন, পার্টিতে টিউটর-হেলেনের অন্তরঙ্গ অভিসার, ধ্বংস হলো উত্তরা।
- একটা হেল্প চাইলাম, ফাজলামো করছেন?
- অসম্ভব। এখানে এত মানুষ থাকতে আমি কেন? আপনার বয়ফ্রেন্ড-হাসবেন্ড কোথায়?
- আশ্চর্য তো, থাকলে আমি আপনার কাছে আসি কেন?

এই যুগে কারও বয়ফ্রেন্ড-গার্লফ্রেন্ড না থাকলে ভয়ানক অবাক হতে হয়। কলেজে উঠেও আমার গার্লফ্রেন্ড-হীনতার খবর শুনে পরিচিত এক ছেলে প্রায় হার্ট-এটাক করেছিলো। মোক্ষম সুযোগ পেয়ে আমিও সেইরকমের একটা চেহারা করলাম- অভিনয় যে খুব ভালো হলো তা না।
- ওহ মাই গড!! আসলেই নেই? বলছেন কি?? হায় হায়!!
- নাহ।
- তাহলে অন্য কাউকে বলেন। রাজি হয়ে যাবে যে কেউ।
- জানি। অন্য যে কাউকে বললে সে হাসিমুখে কাজটা করবে। কিন্তু এখানে প্রোগ্রাম শেষ করে আমার কাছে নিজের পাওনা পুরোপুরি আদায় করে নিয়ে তবেই ছাড়বে।
- আমিও তো সেই কাজ করতে পারি।
- নাহ, আপনি করবেন না, এটা সিওর।

নিজের পুরুষত্বে সূক্ষ্ম একটা খোঁচা অনুভব করলাম।
তবে এরপর আমাকে আর সুযোগ না দিয়ে এক পলকে আমার কোমর আর কনুইয়ের মাঝখান দিয়ে তার হাতটা প্যাঁচ দিয়ে ফেললো। এক সেকেন্ডও সময় লাগলো না, বোঝাই যাচ্ছে এক্সপার্ট হাতের কাজ। আগেকার যুগে তরুণ-তরুণীদের গুলশান আর ধানমন্ডি লেকের ঐদিকে এমন কনুই-প্যাঁচ অবস্থায় দেখা যেত। এরপর ক্রমেই বাড়তে থাকে আঙ্গুল এবং অন্যান্য অঙ্গের ব্যবহার। বাকিটা তো ইতিহাস।

তাহসিনকে একবার বলেছিলাম আমার সাথে এভাবে হাঁটতে, ও বলে ওর নাকি লজ্জা লাগে। আজব।।
ও আচ্ছা, তাহসিনের কথা বলা হয় নি। আমাদের ডিপার্টমেন্টের এক ব্যাচ জুনিয়র। আমি যখন থার্ড ইয়ারে, মেয়েটার ছবি আঁকা দেখে হুট করে একদিন প্রেমে পড়ে গেলাম। অসম্ভব ভালো ছবি আঁকে মেয়েটা। চারকোল দিয়ে আমার স্কেচ করেছিলো একটা, বাসায় টাঙিয়ে রেখেছি এখনও।
আসলে ছোটবেলায় লুকিয়ে লুকিয়ে টাইটানিক দেখার পর থেকে অনেকদিন পর্যন্ত আমারও স্বপ্ন ছিলো আর্টিস্ট হওয়ার। স্বপ্ন আর পূরণ হলো কই? ভিঞ্চি কিংবা ডিক্যাপ্রিও- কোনও লিওনার্দোই হতে পারলাম না।

যাইহোক, আমি এমনিতে অনেক কথা বলতে পারি, তবে অচেনা এক সুন্দরীকে বাহুবন্ধনে নিয়ে মোটামুটি চুপ মেরে গেলাম। চারপাশের বেশ কিছু অগ্নিদৃষ্টি আমার উপর নিক্ষিপ্ত হচ্ছে। আগুনের হলকা টের পাচ্ছি।

- গার্লফ্রেন্ডের সাথে যে এভাবে হাঁটেন না তা বেশ বুঝতে পারছি। করেন কি দুইজন মিলে? হাঁটাহাঁটি না শুধু হাতাহাতি?

হালকা চোখ নাচিয়ে বললো মেয়েটা, অবলীলায়। বুঝতে পারলাম এর মুখে কিছু আটকাবে না। প্রসঙ্গ পাল্টাতে হবে দ্রুত।

- কি করছেন এখন?
- উত্তর দিলেন না যে প্রশ্নের?
- আগে তো পানি গরম করবেন, তারপর চা পাতা ছাড়বেন। কথার সিরিয়াল ঠিক রাখতে হবে না?
- ম্যানেজমেন্টে অনার্স শেষ করে প্রাইভেট একটা ফার্মে আছি। আপনি?
- কম্পিউটার সায়েন্সে মাস্টার্স করছি।
- তো ইঞ্জিনিয়ার সাহেব, আপনার হাতটা যেভাবে শক্ত করে রেখেছেন, আমি ব্যথা পাচ্ছি। এত নার্ভাস হওয়ার কি আছে? আপনার গার্লফ্রেন্ড জানবে না, কথা দিচ্ছি। আর এদিক ওদিক একটু তাকিয়ে দেখুন, সবচেয়ে ভদ্র কাপল এখানে আমরাই।

কথা সত্য। প্রতিটা ডাবল সোফায় চারজন করে। কে কার কোলে তাও ঠিকমত বোঝা যাচ্ছে না। আর যারা দাঁড়িয়ে আছে, তারা বরং শুয়ে থাকলেই ব্যাপারটা শালীন লাগতো। সিল্কি ঝুঁটি করা একই রকম দুইটা মেয়ের ঠোঁট একজায়গায় দেখে অবশ্য একটু দ্বিধায় পড়ে গিয়েছিলাম। পরে একজনের থুতনির নিচে একটু দাঁড়ি দেখে ভুল ভাঙলো।

সোবহান সাহেবকে দেখলাম সবার সাথে কথা বলছেন। আমার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়লেন। অস্বস্তিতে পড়লাম একটু।
উফ কি বিপদে পড়া গেলো, সিন্দাবাদের ভূত তার ঘাড়ের উপর চেপে বসেছিলো, আর আমার পাশের এই ভূতনী কনুই-প্যাঁচ দিয়ে আটকে আছে। আচ্ছা, ভূতের স্ত্রীলিঙ্গ পেত্নী না?? কিন্তু মেয়েটাকে আর যাইহোক, পেত্নী বলা যায় না। কি বলা যায়?
ক্লিওপেট্রা?? মহারানী ক্লিওপেট্রো? যে সম্রাজ্ঞী আপাতত আমার রাজ্যে গেইম অফ থ্রোনসে মেতে উঠেছে।

- একটু ব্র্যান্ডি চলবে? নাহয় রেড স্ট্যাগটা একটু চেখে দেখতে পারেন। চমৎকার।
- দেখুন, গোলগাল আঙ্গুর চিবিয়ে খাওয়াটাই অভ্যাস। ওকে আবার পচিয়ে পেটে নেবার কি দরকার? থাক বরং, ওসব আমায় মানাবে না।
- গোলগাল হয়েই পেটে যাক, আর পচেই পেটে যাক- আউটডোর কিন্তু একটাই, সাহেব। মাঝে যা হয় সেটা এমন কি আর, হাইপোথ্যালামাসের কিছু কারসাজি। হোমিওপ্যাথি খান নি বুঝি কখনও?
- খাবো না কেন? মজাই তো লাগে খেতে।
- ঐ একই। যাক, সে আপনার ব্যাপার। আমার আবার পচা খেয়েই অভ্যাস, বুঝলেন। তবে ভয় পাবেন না, সিনেমার স্টাইলে মাতাল হয়ে আপনার কোলে ঝাঁপ দেবো না।
- হুট করে হাত ধরে যেভাবে গিট্টু মেরে রেখেছেন, ওটুক করলেও আর মনে হচ্ছে না অবাক হবো।
- এই খানিকক্ষণ মিশেই কথা শিখে গেছেন দেখি।
- হুম, অ্যালকোহল বাতাসেও মিশে গেছে মনে হচ্ছে।
- আছেন তো অনেকক্ষণ ধরে, এতক্ষণ বুঝি ছিলো না বাতাসে?
- কেমিক্যাল রিএকশন বলতে পারেন। আর আপনি হলেন ক্যাটালিস্ট।
- এই যাহ, আমার সাথে কেমিস্ট্রি-ও চলে এসেছে দেখি, চালিয়ে যান। আমি কিন্তু ম্যানেজমেন্টের ছাত্রী; ঠিকই সব ম্যানেজ করে ফেলবো দেখবেন।

একথা বলে সুন্দর করে হাসলো মেয়েটা। এতক্ষণ লজ্জায় ঠিকমত মুখের দিকে তাকানো হয় নি। এবার দেখলাম ভালোমত।
এতক্ষণ যারা আমার দিকে হিংসা নিয়ে তাকিয়েছিলো, তাদের দোষ দেয়া যায়না।
বড় বড় দুইটা চোখ, আর ঠিক দেবী আইসিসের মত খোদাই করা নাক। অদ্ভুত গোলাপি পাতলা ঠোঁট। লিপস্টিকের কারসাজি কিনা বোঝার জন্য ব্র্যান্ডির গ্লাসের মুখে তাকালাম।
স্বচ্ছ দামি গ্লাস এখনও ঝকঝকে।।

পাঠক বোধ হয় এতক্ষণ আমাকে ক্যাসানোভা টাইপ কিছু ভেবে বসে আছেন। ভুল করবেন না, বিজ্ঞ পাঠক। সেই লোকের প্রতিভার কাছে যে আমি বড্ড নস্যি। ভায়োলিন বাদক থেকে প্রেমিক, কখনও অভিনেতা, কখনও লাইব্রেরিয়ান। আবার কখনও ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ ভেঙে চতুর আসামী। সে হাতে ভায়োলিনের সূর বেজেছে, সেই সূরে শ খানেক তরুণী পর্যন্ত নেচে উঠেছে তার শোবার ঘরে। আর ইয়ে, গোটা চারেক পুরুষও নাকি এই শয়ন-তালিকায় ছিল।
আর আমাকে এইটুকুর জন্য কাঠগড়ায় দাঁড় করাবেন?

- কম্পিউটার হ্যাং করলো নাকি, ইঞ্জিনিয়ার সাহেব? হঠাৎ চুপ মেরে গেলেন যে।
- ভাইরাস ঢুকেছে বোধ হয়। সিস্টেম কাজ করছে না ঠিকমত।
- সে কি!! কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার এসব ছোটখাটো ভাইরাসে কুপোকাত। জীবনে বড়সড় ভাইরাসের খপ্পরে পড়েন নি বোধহয় এখনও। তাই এমন হচ্ছে।

টেবিলে খাবার রেডি প্রায়। বিরাট আনজান মনে হচ্ছে। পেটের ভেতর থেকেও ডাক চলে এসেছে। তবে মনের ভিতরের অবাধ্য মাঝিটা কোন খালের উজানে আটকে আছে। কি যেন বাকি পড়ে গেলো মনে হচ্ছে বারবার।
- জনাব, খেয়ে নিন। আপনার অবৈতনিক ডিউটি এখানেই শেষ।
- নাহ, অবৈতনিক চুক্তি ছিলো নাকি আমাদের? বেতন আদায় না করে যাচ্ছি না আমি। অন্তত ভাইরাসের গল্পটা তো বলে যান।
- গল্প আবার কি!! কোনও গল্প নেই।
- ফিমেইল এনাটমি আমার বিষয় না, ম্যাডাম। তবুও বেশ বুঝতে পারছি। ঘণ্টা দেড়েক ধরে একই ভাবে সহজেই আমার হাতটা আঁকড়ে ছিলেন, হঠাৎ ভাইরাসের প্রসঙ্গে হাতটা ওরকম শক্ত হয়ে গেলো কেন?

একটা ছোট্ট সেকেন্ডের জন্য অন্যরকম একটা চাহনি। তারপর আস্তে করে হাতটা ছাড়িয়ে নিলো সে। আর দেখলাম না তাকে। খাওয়া-দাওয়া শেষ করার পরও ছিলাম বেশ অনেকক্ষণ, হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো যেন মেয়েটা।


******************


এই গল্পটা আমি যতবার বলি; মনে হয় এই জায়গাটায় এসে শেষ হয়ে গেলে ভালো হত। পরে এটাকে থ্রিলার, এমনকি ভূত এফএমের গল্প বলেও চালিয়ে দেয়া যেত।
যাহোক, পরে মেয়েটাকে অনেকদিন খুঁজলাম। আর খুঁজবোই বা কিভাবে, এতক্ষণ যেই মেয়ের সাথে হাত ধরে পার্টিতে হেঁটে বেড়ালাম, তার নামটা তো পর্যন্ত জানা হয় নি।
লজ্জার মাথা খেয়ে একদিন সোবহান সাহেবকেও বললাম, উনিও তেমন কিছু বলতে পারলেন না। বেশি ক্ষমতাবানদের সাথে মিশলে একটা সমস্যা হয়, দূর থেকে দেখতে হয়, নিজের মত ক্ষমতা কাজে লাগানো যায়না।

কিন্তু... চার মাস পর একটা ফোন পেলাম...
আবারো সেই একদিনের পরিচিত কথার মারপ্যাচ।

- কম্পিউটার-ইন্টারনেট নিয়ে আপনারা করেনটা কি বলেন তো? এই যুগে কি চাইলেও কাউকে হারানো যায়?
- তা যায়না। কিন্তু খুঁজে পাওয়ার কোন জিনিসটা নিয়ে আমি ঐদিন বাসায় ফিরেছি, জানেন? আপনার পারফিউমের গন্ধ শুধু। ব্যাস, আর কিচ্ছু না। নামটা পর্যন্ত বলেন নি যে ফেসবুক-গুগলে সার্চ দিবো। হ্যাঁ, আমরা আসলেই ব্যর্থ, সার্চ অপশনে গন্ধ ব্যবহার করার রাস্তা বের করতে পারলাম না। গন্ধ গন্ধে ঠিকই খুঁজে পেয়ে যেতাম তাহলে। উফ, কি পারফিউম ব্যবহার করেন বলেন তো?
- এলিজাবেথ আর্ডেন, ইভিনিং ইন প্যারিস, জেসিকা পার্কার, ল’রেল…
- ওরে সর্বনাশ। থাক, লাগবে না আর। ও হ্যাঁ, আপনাকে খুঁজতে আরেকটা কাজ অবশ্য করতে পারতাম, তাহসিনকে আপনার চেহারা বর্ণনা করে ওকে দিয়ে ছবি আঁকিয়ে ফেলতে পারতাম। কিন্তু তাহলেই হতো রে, পুরো সিস্টেম ক্রাশ করতো!!
- আপনার গার্লফ্রেন্ড ছবি আঁকে বুঝি?
- কি করবো বলেন? ডিএসএলার কেনার পয়সা নেই। এছাড়া আর ভালো ছবি কোথায় পাবো? আচ্ছা, সব কথা এখানেই শেষ করে ফেলতে চাচ্ছেন?
- নাহ, তবে আপনাকে একটা গিফট দিতে চাই। সেদিন যে পাওনা আদায় করতে চেয়েছিলেন, ধরে নিন সেটাই।
- কোথাও দেখা করি, চলুন। তারপর নাহয় দেবেন।
- গার্লফ্রেন্ড রেখে অন্য মেয়েদের এভাবে হুট করে দেখা করার কথা বলতে হয় না, বুঝলেন। লজ্জার মাথা-মুণ্ডু কিছু তো রাখেন।

লাইন কেটে গেলো এরপরই। পরের দুইদিন একশ’ বার চেষ্টা করলাম ঐ নাম্বারে, বন্ধ পেলাম।
এবার মেজাজ খারাপ হলো অনেক।
এটা যখনকার কথা, আমার মাস্টার্স শেষ হয়েছে। একটা ভালো সফটওয়্যার কোম্পানিতে চাকরি পেয়েছি মাত্র। এবং তাহসিনের সাথে আমার বিয়ের কথাবার্তা চলছে।

এর দুইদিন পর বাসা থেকে বের হয়েছি অফিস যাবার জন্য। একটা বাচ্চা ছেলে হাতে একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিলো। কোন এক লোক নাকি আমাকে দিতে বলে চলে গেছে। আর কিছু বলতে পারলো না।
একটা ডায়েরি ছিলো ঐটা।


******************


আমার নাম জানাটা কি খুব দরকার আপনার??
মনে হচ্ছে না, তবে আমি চাই আমার খুব সুন্দর একটা নাম আপনার মাথায় থাকুক, যেমন ধরুন, অনামিকা। সুন্দর না নামটা?? অথবা খুব হাসিখুশি ধরণের একটা নাম, যেমন ধরুন- হ্যাপি।
আর আপনিও একটা নাম দিয়ে দিতে পারেন, আমার আপত্তি নেই। লজিকাল প্রোগ্রামিং তো করলেন এতদিন, এবার ছোট্ট একটু ইল্লজিকাল কিছু করুন নাহয়।

জানেন, কোন একটা ম্যাগাজিন একটা জরিপে কয়দিন আগে পেয়েছিলো, পৃথিবীতে মাত্র দুই পারসেন্ট মেয়ে নিজেকে সুন্দরী বলে দাবি করে। বাকি আটানব্বই জন যত সুন্দরই হোক না কেন, প্যানপ্যান করতে ভালোবাসে। আপনারা যাদের দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন, তারাও কিন্তু আয়নায় নিজেকে দেখে দীর্ঘতর নিঃশ্বাস ফেলে। নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে সয়লাব চারিদিক।
আমি এত কালো কেন? আমি এত সাদা কেন? আমার গালে টোল পড়ে না কেন? আমার কোমর ক্যাটরিনার মত বাঁকা হয় না কেন? আমার ভুরুটা আরেক সেন্টিমিটার বায়ে হলে কি হতো? ব্লা ব্লা ব্লা...
আমি কিন্তু ঐ দুই পারসেন্টের একজন। আর ছোটবেলা থেকেই বিরাট অহঙ্কারি।
একবার বাসে এক ছেলে নোংরা কথা বলেছিলো, তাকে হাঁটু দিয়ে এমন জায়গায় মেরেছিলাম, তার প্রতিদিন তিন-চারবার করে আমাকে মনে পড়ার কথা। ডিহাইড্রেশন হলে তো আরো অনেকবার।

বাদ দেই এসব আজেবাজে কথা।
আচ্ছা, কিশোরি মেয়েদের প্রেমে পড়তে দেখেছেন কখনও? একেবারে সত্যিকারের প্রেম? আর মেয়ে সুন্দরী-অহঙ্কারি হলে কি হয় জানেন? সেটা আর প্রেম থাকে না। অবসেশন হয়ে যায়। কৈশোর থেকে একদিন একদিন করে তৈরি হয়ে আসা অবসেশন।
আমার অনেকটা সেরকমই ছিলো। আমাদের পাশের বিল্ডিং-এ থাকতো ভাইয়াটা। দেখতে-শুনতে বা পড়াশুনায় এমন আহামরি কিছু ছিলো না, কিন্তু ঐ যে বললাম, অবসেশন।

প্রেমকাহিনীতে বলার মত তেমন কিছু নেই। আপনাদের ভাষায় হয়তো কিছুটা ন্যাকামো ছিলো, এই আর কি।
তবে বাসায় মোটামুটি বিদ্রোহ ঘোষণা করে অল্প কয়দিনেই বিয়ে করে ফেললাম ওনাকে।
আমার খুব মা হওয়ার শখ ছিলো, জানেন। খুব অনুভব করতে ইচ্ছা করতো নিজের শরীরের ভেতর আরেকটা শরীরের বেড়ে ওঠা। একটু একটু করে।
বিয়ের দুইমাস পর প্রথম আমি পিরিয়ড মিস করি। অদ্ভুত খুশি লাগতে থাকে আমার। তবে প্রথম মামুনকে যেদিন বলি, ও কেমন অন্যরকম হয়ে যায়। পরে অবশ্য চেকাপ করে বুঝি ওটা অন্য কারণ।

কিন্তু ক্রমেই বদলে যেতে থাকে মামুন। ও যেন চাইতো না আমার বাবু হোক। আমাকে রেগুলার পিল খেতে বাধ্য করতো। ভয়ঙ্কর বিশ্রী ব্যবহার করতো। গায়েও হাত তুলতো। রাতে পশুর মত আচরণ করতো মাঝে মধ্যে। আমিও মনে হয় কেমন যন্ত্রের মত হয়ে যাচ্ছিলাম তখন। ভার্সিটি শেষ হয় আমার এভাবেই। কিন্তু মাস ছয়েক এভাবে যাওয়ার পর ওকে না জানিয়ে পিল নেয়া বন্ধ করে দেই। এরপর কনসিভ করি। ভেবেছিলাম ওকে জানাবো না, কিন্তু তিন মাসের মধ্যে ও টের পেয়ে যায়।

এর মধ্যে কিছু ব্যাপার পরিষ্কার হয় আমার কাছে। ও ড্রাগ অ্যাডিক্টেড ছিলো। বিয়ের আগে থেকেই, কিন্তু মোহের জন্য ওসব মাথায় আসে নি কখনও। পরে বিষয়টা দিনদিন ভয়ঙ্কর হতে থাকে। অনেক চেষ্টা করি আমি ওকে ফেরাতে, পারি না। দুই পরিবারের সাথে সম্পর্ক খারাপ হয়ে যায়।

এই তিনমাস আমি কিভাবে ছিলাম জানেন? আমার বাবুটার সাথে। মামুন যখন মারতো আমাকে, বাবুটার গায়ে আস্তে করে হাত বুলিয়ে আদর করতাম আমি। পেটের উপর দিয়ে ওর শরীরে হাত রেখে কতরাত যে পার হয় আমার। আপনারা পুরুষেরা বড়ই দুর্ভাগা, এই অনুভূতির টিকিও কখনও পাবেন না।
আমি হিসাব রাখতাম। আমার চারমাস চলছিলো। বাবুর হাত, পা, বুক, পেট, আঙ্গুল, এমনকি ছোট্ট দুইটা চোখও তৈরি হয়ে গেছে এর মধ্যে। সারা শরীরে কালশিটে নিয়েও কি অদ্ভুত আনন্দ হতো আমার!! আচ্ছা, মানুষ সৃষ্টি করার পর স্রষ্টারও কি এরকম আনন্দ হয়েছিলো?

আর তারপর।
এই সময়ে আমার এবরশন করা হয়। তিনমাসের পরই অনেক রিস্ক থাকে। তার উপর সস্তা ক্লিনিকে ভর্তি করা হয় আমাকে।
প্রচুর ব্লিডিং হয়। মারা গেলে অনেক খুশি হতাম। কিন্তু অনেক উপরের আকাশে ভাবলেশহীন কেউ একজন বোধ হয় অন্য প্ল্যান করে রেখেছিলো আমার জন্য।

বেঁচে গেলাম এ যাত্রা। তবে ইউটেরাসে একটা ভাইরাল ইনফেকশন হয়ে যায় অ্যাবরশন-এর পর। সার্ভিকাল ক্যান্সারের খুব পরিচিত একটা ভাইরাস, হিউম্যান প্যাপিলোমা।
ততদিনে ডিভোর্স দিয়ে দেয় আমাকে মামুন। আমার অবস্থা আরো খারাপ হতে থাকে।
দুইটা অপশন ছিলো আমার। ইউটেরাস কেটে ফেলা, আর নাহলে হাবিজাবি ট্রিটমেন্ট করে, কেমো নিয়ে কয়েক বছরের মত বেঁচে থাকা। এখন সেটাই আছি। কেন জানেন? সব অহঙ্কার ভুলে গিয়ে কোনও একদিন কোনও ছেলেকে ভিক্ষুকের মত যেন বলতে পারি, একটা বাবু দিতে পারবেন আমাকে? বিশ্বাস করেন, আর কিছু চাইবো না কোনওদিন। টাকাপয়সা, সম্মান, নামের টাইটেল- কিচ্ছু না।

সেদিন ভাইরাসের কথা বলাতে তাই সবকিছু হঠাৎ মনে পড়ে গেলো। আমার শরীরে আদর করে পুষে রাখা ভাইরাসটার কথা। ততদিনে অনেকটা আশা হারিয়ে ফেলেছি। তবুও নিজেকে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখতাম। দামি পারফিউমে ঘর ভর্তি করে রাখতাম। কোথাও যাওয়ার আগে ঘণ্টাখানেক ধরে সাজতাম।

আর কেন দেখা করলাম না জানেন? এরপর আমার কেমোথেরাপির প্রথম অংশ ছিলো। আপনার চোখে যেই সুন্দর মুখটা ছিলো, ঐটাই যেন থাকে সবসময়। আর কখনও দেখা হচ্ছে না আমাদের। তবুও আপনাকে এতকিছু কেন বললাম কে জানে। অনেক বড় ভুল করার পর আসলে ছোটখাট ভুলকে পাত্তা দিতে ইচ্ছা করে না, তাই হয়তো।

আমি যথেষ্ট শক্ত মেয়ে, জানেন। এতকিছুর পরও কেউ আমাকে কাঁদতে দেখে নি। সবাই শুধু একটানা শাওয়ারের ঝরঝর আওয়াজ পেত। সবসময়।


******************


আমার বিয়ের সময় এগিয়ে আসছিলো। কিন্তু জেদ চেপে গেলো এবার আমার। ধরলাম সোবহান সাহেবকে ভালোমত। অনেকদিন আগের পার্টি ছিলো ওটা। তাও খুঁজে বের করলাম অনেককে। সোবহান সাহেবের ক্লায়েন্ট ছিলো যারা এমন বেশ কয়েকটা অফিসে যোগাযোগ করলাম। নামধাম কিচ্ছু জানিনা, তাই বিড়ম্বনা হলো অনেক। পনেরো বিশদিন খোঁজাখুঁজির পর অবশেষে পেলাম। না দেখে তখনও সিওর হতে পারছিলাম না যদিও। আর সেই মেয়েও চাকরি ছেঁড়েছে প্রায় তিনমাস হলো।

অফিস থেকে বাসার ঠিকানা দেয়ার নিয়ম নেই, সোবহান সাহেবের কল্যাণে সেটাও পেয়ে গেলাম।
পরের দিন হাজির হলাম ঐ বাসায়। আর হ্যাঁ, তার দুইদিন পর আমার বিয়ে। আমার কোনও খবর নেই। বাসায় বারবার বলছি অফিসের দরকারি কাজে আটকানো।
যাই হোক, খুঁজে বের করলাম বাসা। ওখানে শুনি, তিনদিন হলো হাসপাতালে আছে সে। সোজা হাসপাতালে গেলাম। বেডে ঘুমিয়ে আছে সে। আরেকটা অল্পবয়সী ছেলে, ওর ভাই হতে পারে মনে হলো।

ওর মুখটা আগের মত নেই। তবু জানতাম, চোখটা খুললেই চিনতে পারবো আমি মেয়েটাকে।
ঘণ্টাখানেক বসে ছিলাম, তারপর ঘুম ভাঙলো তার। ভিতরে ভিতরে কি হচ্ছিলো আমার আমিই জানি, কিন্তু খুব স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছিলাম। আপ্রাণ চেষ্টা করছিলাম।

- ডায়েরিটার লাস্টের বেশ কয়েকটা পৃষ্ঠা ছেঁড়া দেখলাম। কিন্তু আপনি তো লুকোচুরি খেলবেন বলে ঠিক করেছেন। তাই আমিই ঐ পৃষ্ঠাগুলো নিতে চলে আসলাম এত ঝামেলা করে।
- পাওনা তো আমি ঠিকই বুঝিয়ে দিয়েছি। এখন আবার তার উপর সুদ চাচ্ছেন কেন?
- উফ, আপনার তো দেখি ব্যাংকার হওয়া উচিত ছিলো। ক্যালকুলেটর দিয়ে জীবন হিসাব করতে চাচ্ছেন কেন বারবার?
- আপনারা কম্পিউটারে হিসাব করবেন, আর আমরা ক্যালকুলেটরে, এটাই তো স্বাভাবিক, তাইনা?
- আমার হিসাব ভালোই বুঝে গেছেন দেখি। হায়রে, হিসাবটা যোগ-বিয়োগ কিংবা বাইনারী হলে কি চোখ খুলে এভাবে আমাকে দেখতেন?

উত্তরে প্রথমে একটা হাসি শুনলাম। তারপর খুব আস্তে করে সে বললো,
আপনি কেন আসলেন এই পর্যন্ত? কেন?

জীবনে কিছু কিছু সিদ্ধান্ত খুব দ্রুত নিতে হয়, আমি সেটাই করলাম ঐ মুহূর্তে। রুমে কে ছিলো না ছিলো, কোনওদিকে না তাকিয়ে তার হাত ধরে বললাম . . .
“আমার আপকামিং বাবুটার জন্য একটা আম্মু লাগবে, আপনি কি ঐ বাবুটার আম্মু হবেন?"
তারপর একটু হেসে বললাম, “বেশি কষ্ট দিবো না, এই প্রমিস বলছি।”
“আমার হাত ধরে প্রমিস করলে তো লাভ নেই, আমি তো এমনিই মরে যাবো সামনে...”

বলে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলো সে। সহজ সরল এই কথাটার মধ্যে অনেক অনেক দিনের একটা কান্না লুকানো ছিলো। মেয়েটা কি দিয়ে তৈরি, খোদা?

চলে যান আপনি প্লিজ। আপনার পায়ে ধরছি। আমাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করবেন না, মিথ্যা বলতে অনেক কষ্ট হয় আমার, অনেক কষ্ট। আর... ডায়েরির পেজগুলো আমার কাছে থাকুক। এত স্বার্থপর কেন আপনারা সবাই? এইটুকুও আমার কাছে থাকতে দেবেন না?

আমি আর ওর চোখের দিকে তাকাই নি। মেয়েটাকে সারাজীবন আমি অহঙ্কারি হিসেবেই ভাবতে চাই। ভাঙা গলার শেষ কথাগুলো আমি ভুলে যাবো। যেভাবে হোক ভুলে যাবো।


******************


আমার গল্প শেষ। তবে এই গল্পটা প্রথম আমি কাকে বলি জানেন?? আমার প্রথম বাবুটা হাসপাতাল থেকে যেদিন বাসায় আসে, ওকে বলি। তাহসিন ঘুমাচ্ছিলো তখন।
আর হাসপাতাল থেকে চলে আসার পর মেয়েটার সাথে আর কখনও দেখা হয় নি আমার। ওকে কষ্ট দিতে ইচ্ছা হয়নি আসলে।
পরিবার অনেক সুন্দর একটা ব্যাপার। আমার ঘরে টাঙানো নিজের চারকোলের স্কেচটা একসময় আমাকে যেভাবে আকর্ষণ করতো, এখন আমার স্ত্রী আর ভীষণ দুষ্ট দুই ছেলেমেয়ে আমাকে তারচেয়েও অনেকগুণ আকর্ষণ করে।

তাহসিন এখন আর ছবি আঁকে না, অফিস-ছেলেমেয়ে-সংসার নিয়ে পড়ে থাকে, ওদিকে সময় কই? কিন্তু আফসোস নেই একদম।
আর আমি কি করি জানেন? ঐ হারিয়ে যাওয়া অহঙ্কারি মেয়েটাকে দেখি তাহসিনের মুখে। মাঝে মাঝে বারান্দায় লাগানো বেলিফুলের গন্ধকে তীব্র পারফিউম মনে হয়। কি যেন ছিলো নামগুলো? ইভিনিং ইন প্যারিস, এলিজাবেথ আর্ডেন... আর কি কি??

তাহসিনের পরের জন্মদিনে অবশ্যই ওকে গিফট করতে হবে এগুলো।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই আগস্ট, ২০১৪ রাত ৮:৫১
৪টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

তোমাকে লিখলাম প্রিয়

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ০২ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০১


ছবি : নেট

আবার ফিরে আসি তোমাতে
আমার প্রকৃতি তুমি,
যার ভাঁজে আমার বসবাস,
প্রতিটি খাঁজে আমার নিশ্বাস,
আমার কবিতা তুমি,
যাকে বারবার পড়ি,
বারবার লিখি,
বারবার সাজাই নতুন ছন্দে,
অমিল গদ্যে, হাজার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ মিসড কল

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইল বিরোধী প্রতিবাদ বিক্ষোভ

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ০৩ রা মে, ২০২৪ সকাল ৮:০২

গাজায় হামাস উচ্ছেদ অতি সন্নিকটে হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্ক ও লসএঞ্জেলসে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পরেছিল। আস্তে আস্তে নিউ ইয়র্ক ও অন্যান্ন ইউনিভার্সিটিতে বিক্ষোভকারীরা রীতিমত তাঁবু টানিয়ে সেখানে অবস্থান নিয়েছিল।


... ...বাকিটুকু পড়ুন

×