পরাধীন ভারতে প্রাচ্যজাগতিক চর্চার যে হিড়িক উঠেছিল এর দ্বারা বোঝা যাবে কেন উনবিংশ শতাব্দীত্র দ্বিতীয় ভাগে বেদ-বেদান্ত চর্চার ব্যাপক ফ্যাসন বর্ণহিন্দুদের মধ্যে দেখা গিয়েছিল। কেনইবা ভারতবর্ষের দিকে দিকে বেদের পুনরুদ্ধারের প্রকল্প নিয়ে প্রার্থনা সমাজ, দেব সমাজ, আর্য সমাজ তৈরী হচ্ছিল, এবং বর্ণহিন্দুরা বিপুল আবেগে নিজেদেরকে আর্যজাতির সঙ্গে লীন করেছিল। বর্ণহিন্দুদের মধ্যে আর্যত্বের এই প্রেরণাটা আসলে কিন্তু ইউরোপীয়দের পরোক্ষ অবদান। পরক্ষো এই জন্য যে, সাম্রাজ্যবাদী ইউরোপীয় শক্তি উনবিংশ শব্দাতীতে প্রায় সারা এশিয়া জুড়ে যে প্রাচ্য জাগতিক চর্চা এবং গবেষণা চালিয়েছিল তার পেছনে মতলবটি ছিল আধিপত্য (হেজিমনি) বিস্তারের- শাসিতের কাছ থেকে শাসকের প্রতি বশ্যতা স্বীকারের দার্শনিক সম্মতি আদায়। ভারতে এই প্রয়াসের নিমিত্ত হিসাবে কাজ করেছিল মধ্যবিত্ত বর্ণহিন্দু গোষ্ঠী, ব্রিটিশদের অনুমোদিত প্রতিনিধি হয়ে।
শোষণ এবং অন্যায় শাসনের স্থায়িত্বের একটি অপরিহার্য শর্ত হল শাসিতের কাছে এর ন্যায্যতা প্রমাণ করা এবং সেই সঙ্গে শাসিতদেরকে বিশ্বাস করানো যে তারা শাসিত হবারই উপযুক্ত। এই কাজে শাসকশ্রেণী ভুরি-ভুরি বিকিয়ে-যাওয়া এবং অন্তঃসারশূন্য অপন্ডিতদের ব্যবহার করে থাকে। উনবিংশ শতাব্দীতে শাসকশ্রেণীর এই বুদ্ধিজীবী প্রকল্পটির দ্বারা আধিপত্য (হেজিমনি) বিস্তারের উপায়টি ছিল বর্ণবৈষম্যবাদের প্রচার । ফলে তাদের শোষক সরকারের কাজের সুরাহা করতে গিয়ে ইউরোপের পন্ডিতদের বর্ণবোইষম্যবাদ বাড়তে বাড়তে প্রায় মানসিক বিকারের স্তরে এসে ঠেকেছিল। এর পরিণতি হিসাবে পৃথিবীতে সভ্যতার সৃষ্ট থেকে নিয়ে সমস্ত সভ্যতার কৃতিত্ব আত্মসাৎ করতে এরা এমন কোনো জালিয়াতি নেই যা করে নি। জোইব অভিব্যক্তি, নৃতত্ত্ববিদ্যা, সমাজ বিজ্ঞান ইত্যাদি শাখায় মেকী তথ্য এবং তত্ত্বের বন্যা বইয়ে দিয়েছিল এটাই প্রমাণ করতে যে, জন্মগতভাবে শ্বেতাঙ্গরা অন্যান্য বর্ণের মানুষদের থেকে উৎকৃষ্ট। এদের যুক্তি অনুযায়ী, সমস্ত অশ্বেতাঙ্গ মানুষেরা নিঃসন্দেহে নিকৃষ্টমানের। সুতরং শ্বেতাঙ্গরা দুনিয়ার বাকী সব মানুষকে পদানত করে তাদের শাসন করার অধিকারী।
কিন্তু এই প্রকল্পে বাস্তবায়নে মুস্কিল হচ্ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গাতে। সেটা হল শ্বেতাঙ্গদের ধর্ম, যা তারা পেয়েছে প্রাচ্য থেকে। যীশু খ্রীষ্ট একজন ইহুদী ছিলেন। সুতরাং অশ্বেতাঙ্গ প্রাচ্যের কাছ থেকে পাওয়া ধর্ম গ্রহণ করতে গিয়ে ইউরোপীয় পন্ডিতদের মনে ক্ষোভ ও দ্বিধার উদ্রেক হয়েছিল। এই দ্বিধার অবসান করতে ভলটেয়ার, ম্যাক্স মূলার, নিট্সে, গতিয়ঁ, স্টুয়ার্ট, চেম্বারলেইন প্রমুখ বিজ্ঞজনেরা বিশদ পান্ডিত্যপূর্ণ আলোচনা করেছেন। কার্যত ভলটেয়ারই এই দ্বিধার অবসান করে দিয়েছিলেন এবং বাকীরা সব তাঁর দেওয়া 'কাহিনী' সারাংশ অক্ষুণ্ণ রেখে বিশ্বকে নিজেদের গল্পমালা উপহার দিয়েছেন।
ভলটেয়ারের বক্তব্য ছিল এই রকম যে, ইহুদীরা ব্রাহ্মণ্য রহস্য জানতো। তাঁর মতে শয়তানের ধারণা সবার আগে আর্যরাই তৈরি করেছিল। এই শয়তানই হল আদি পাপের প্রতিনিধি এবং এই ধারণা থেকেই মানুষের সৃষ্টির রুপক এবং খ্রিস্টান ধর্মের উৎপত্তি হয়েছে। ভলটেয়ার সিন্ধান্তে পৌছেন যে, ইহুদীরা ব্রহ্মবিদ্যার মধ্য দিয়েই আত্মার অনরত্বের কথা জেনেছিল। আব্রাহাম আসলে ব্রহ্ম শব্দ থেকে এসেছে এবং আডাম ও ইভ হল আদিম ও প্রকৃতি। এইসব কারণে ভলটেয়ার দাবী করেছেন যে, খ্রিস্টধর্মের ভিত্তি ইহুদীদের থেকে নয় বরং আর্যদের কাছ থেকে পাওয়া। তাঁর মতে খ্রিস্টধর্মের যাবতীয় অধিবিদ্যামূলক জ্ঞানরহস্য আর্যদের থেকেই এসেছে এবং ইহুদীরা এই দার্শনিক ভিত্তিকে বহুওলাংশে বিকৃত করেছে। ভলটেয়ারের এই অভিসন্ধিমূলক তত্ত্ব কথাটি যখন কেতাবী বিজ্ঞপ্তি হিসাবে পন্ডিত মহলে জারি হল তখন তার ফলস্বরুপ পরবর্তীকালে মনুস্মৃতির মত লম্পট ধর্মোপদেশ নিট্সের মতো বুদ্ধিজীবীর রসালো চিন্তার খোরাক হয়ে দাঁড়ালো।
নিট্সে 'মহৎ মানুষ' -এর আড়ালে বর্ণবৈষম্যের যে বিষাক্ত বীজ জার্মানীতে বপন করেছিলেন সেইটাই যে হিটলারের মতো বিষবৃক্ষের সৃষ্টি করেছিল এমন ধারণা এককালে অনেকেই পোষণ করতেন। অবশ্য নিট্সেকে নাৎসীদের প্রেরণা-সঞ্চারকের অপবাদ থেকে রক্ষা করতে তাঁর বুদ্ধিজীবী সমর্থকদের মধ্যে কফ্ম্যান এবং কামু অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। অতএব প্রাচ্যজাগতিক অধ্যায়ন এবং চর্চার পূর্বেই গবেষণার উপসংহারটি তৈরী হয়ে গিয়েছিল। এক কথায় আর্য জাতির বংশধর হিসাবে নড়ডিক আংলো-স্যাক্সন গোষ্ঠির বিজ্ঞজনেরা আর্য জাতির শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের মধ্য দিয়ে শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদমূলক আর্য সভ্যতার উৎকর্ষ এবং আদি সৃষ্টির কাহিনী উদ্ভাবন করেছিলেন।
ভারতবর্ষের পন্ডিতবর্গের মধ্যেও ইউরোপীয়ান্দের এই প্রাচ্যজাগতিক চর্চার প্রভাব ভালোভাবেই পরিলক্ষিত হয় বর্ণহিন্দুদের মধ্যে। বর্ণহিন্দুরা তাদের মনিবের দেওয়া অতীতের গৌরবগাথা সংবাদে হর্ষিত এবং পুলকিত হয়ে বেদের জ্ঞান আহরণে মেতে উঠল। হিন্দুধর্মের পুনরুদ্ধারে ধর্ম-সংস্কারকদের লাইন লেগে গেল। এদের মধ্যে স্বামী বিবেকান্দ সব থেকে স্বতন্ত্র, কারণ তিনিই প্রথম বেদ-বেদান্তের আত্মশুদ্ধি মার্কা জ্ঞান পাশ্চাত্যে রপ্তানী করার প্রকল্পে হাত দিয়েছিলেন। সেই থেকে কত স্বামীজী, সাধু বাবাজী যে পশ্চিমকে, বিশষ করে আমেরিকাকে শান্তির সুধা পান করিয়ে বিশ্ব-মানবিকতার আদর্শে দীক্ষিত করেছেন তার ইয়াত্তা নেই; কিন্তু তা সত্ত্বেও আমেরিকার যুদ্ধং দেহি রূপ দেখলে বড়ই বিমর্ষ হতে হয়। আসলে বেদে মধ্যদিয়েই আর্যবাদের প্রচার করে স্বামীজীরা অবচেতনে শ্বেতাঙ্গ বর্ণবৈষম্যবাদী ঔদ্ধত্য প্রসারেই ইন্ধন জুগিয়েছেন।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




