যে বইয়ের নাম মেরুজিন, তার প্রচ্ছদ হবে কাল্পনিক অথবা অলৌকিক। কিন্তু নীলাঞ্জন কর্মকারের কবিতার বই মেরুজিনের প্রচ্ছদে বড়ই হতাশ হলাম। শস্তা মনে হয়েছে বড়। চলতি কোলকাত্তাইয়া আঁতলামি। বরং বইয়ের ভেতরের অলংকরণ ঋজুতর এবং সহ্যসীমার মধ্যে অবস্থান করে। জানি বইয়ের অলংকরণ বা প্রচ্ছদ বাংলা কবিতার বইয়ের সমালোচনায় প্রধান আলোচ্য বিষয় হতে পারে না। কিন্তু যেহেতু মেরুজিনের কবিতাগুলির কোন শিরোনাম নেই, এমনকি কোনও সংখ্যা বা পরিচিত অক্ষরেও সূচিত নয় কবিতাগুলি; তাই প্রত্যেক কবিতার উপরের আয়তক্ষেত্রাকার ছবিগুলিকেই প্রত্যেক কবিতার সূচক ধরে নেওয়া যেতে পারে। এই কারণেই এ বইয়ের কবিতার সাথে সাথেই এই বইয়ের অলংকরণও পাঠকের মনোযোগ দাবী করে।
এবার দেখা যাক বইয়ের ভেতর আর কী রইল। সূচিপত্র নেই, তাই গুনে দেখা গেল মোট ২৪টি কবিতা, প্রবেশক কবিতাটা গুনতিতে ধরলে ২৫। ‘স্মৃতির পথ ধরে একটি বিকেল হুইসল/ দিতে দিতে চলে যায় ইডেন রোডের দিকে.../ ... আর, কে যেন ডাকে। সাদা পাৎলুন পরে/ এ-ছাদ থেকে ও-ছাদ... ও-ছাদ থেকে সে-ছাদ...’ এই সূচনায় বইটির অন্যান্য কবিতা সম্পর্কে একটা নির্মেদ প্রত্যাশা তৈরি হয়।
বই, বিশেষতঃ কবিতার বই, আমি শেষ থেকে শুরু করি। ‘গভীর ঘুমের ভিতর একদিন নীলাঞ্জন নামে/ একটি যুবক মরে যাবে। আর তাকে কফিনে মুড়ে/ তালাবন্ধ করে একটি স্মারক-চাবি রেখে দেওয়া হবে/ কফিনের পাশে।’ বইয়ের নামের কারণেই কিনা জানি না, এ কবিতায় জীবনানন্দকে বড় বেশি মনে আসে। ‘গভীর ঘুমের ভিতর নীলাঞ্জন নামে একটি/ কফিন শুয়ে আছে।’ –এর কাছাকাছি নয় কি রূপসী বাংলার মৃত্যুভাবনা? কিন্তু যে কবি পশ্চিমবাংলার বাণিজ্যিক কবিতার নিয়ম উপেক্ষা ক’রেই নিখাদ গদ্যে কবিতা লিখছেন, তাঁর কবিতাকে এককথায় জীবনানন্দগোত্রীয় বলাটা অবিচার হবে। তাই একের পর এক পড়লাম কবিতাগুলি।
কবিতাগুলির মধ্যে একটা চেনা ফর্ম আছে। একটা কবিতার মানচিত্র অন্যটার থেকে খুব আলাদা নয় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই। ব্যাপটিস্ট মিশন, স্ট্রবেরি, তুলোচাষ, পাদ্রী, আইরিশ টেবিল, গ্রিক যুবতি, পাইনের সারি, ম্যাপল গুঁড়ি, কার্নিভাল, মিশনারি – এইসব বিদেশি চিহ্নগুলি নীলাঞ্জনের কবিতার আপরিহার্য অঙ্গ হয়ে উঠেছে। কবিতা পড়তে পড়তে মনে হয় মধ্য ইউরোপের শুঁড়িখানার সামনে লন্ঠনের মত অনুজ্জ্বল চোখ মেলে আছি। বা এই বাংলারই নাম-না-জানা শীর্ণ নদীর ওপর দুর্বল সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে আছি হেমন্তের সন্ধ্যায়। কিন্তু স্পষ্টভাবে সেই সেতু আমাদের চেনা ভূগোলের অন্তর্ভুক্ত নয়। কবি যখন জানান – ‘এই নদী উপত্যকার গাছগুলিতে গত আশ্বিনের/ ভায়োলিন বাঁধা আছে’, তখন আশ্বিনের উল্লেখ থাকলেও এই কবিতা পড়ি বাংলা থেকে অনেক দূরের কোনও আবহে বসে। আমাদের পরিচিত গাছে বড়জোর বেহালা দেখা যেতে পারে, কিন্তু ভায়োলিন কখনও নয়। বা ‘দূরে রেফারিহীন খেলার মাঠ বরফে আবৃত, কুয়াশার ভিতর থেকে ভেসে আসছে একটি ফুটবল’ – ফুটবল বাংলার প্রিয় অনুষঙ্গ হলেও বরফ আবৃত মাঠের কথায় ইউরোপ বড় বেশি মনে পড়ে যায়।
এই বইয়ের কবিতাগুলির নির্মাণে কবি দেশি চিন্তনে বিদেশি মাত্রার সচেতন ব্যবহার করেছেন। আর এই কাজে সাহায্য করেছে প্রত্যেক কবিতার ওপরে আঁকা সোমনাথ বসু ঠাকুরের ছবিগুলি। ফলতঃ গড়ে উঠেছে একটা সার্থক মানসভূমি, যেখানে কবিতাগুলি খাপ খায়। মেরুজিন বইয়ে এটাই নীলাঞ্জনের অন্যতম সাফল্য। পাঠক, জেনে রাখুন, এটাই কবির প্রথম কবিতার বই। এ বইয়ে জন্মদিনে পায়েস রাঁধা হয় অবশ্যই, কিন্তু তার সাথেই সে পায়েস পাঠানোর বাসনা পোষণ করা হয় অচিন মিশনারিগুলিতে।
সব মিলিয়ে কবিতাগুলির নিজস্ব সুর আছে। যে সুর পশ্চিমবাংলার বর্তমান বাজারচলতি কবিতাভাষা থেকে বেশ কিছু দূরে অবস্থান করে। কিন্তু ধারাবাহিক পাঠে ক্লান্তি আসে। ক্রমাগত ভিনদেশি শব্দপুঞ্জের সাথে বোহেমিয়ান সুরে সমস্ত কবিতা একই তারে বাঁধা মনে হতে থাকে। যা যে কোনও কবির জন্যেই অস্বাস্থ্যকর। ‘অর্থহীন শুয়ে থাকি বিছানায়’, ‘এখন মশারিও তো কবরের মতো লাগে’ – মতো বাক্যের পুনঃ পুনঃ যাতায়াত এবং আশ্বিন, হেমন্ত, বিকেল, বিষণ্ণতা, গভীর মাংস ইত্যাদির নিয়মিত কোলাজ অবধারিতভাবেই কবিতার অন্দরে জীবনানন্দকে মনে পড়িয়ে দেয়।
তবু এই কবির পরের বই পড়ার জন্যে উন্মুখ অপেক্ষায় রইলাম। যিনি লিখতে পারেন – ‘ক্ষুধার্ত ছাত্রেরা/ হামা দিয়ে উঠে আসে এক অলীক তোরণের কাছাকাছি’; তাঁর কব্জির জোর নিয়ে অন্ততঃ কোনও সন্দেহ থাকা উচিত নয়।
এই সমালোচনাটি মাসকাবারি ডট কম-এর মার্চ ইস্যুতে প্রকাশিত হয়েছে।