somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রবার্ট ফিস্ক: মধ্যপ্রাচ্যের পুরোনো বিভাজনএখন মৃত। পরিণতি নিয়ে আমি খুবই ভীত।

১৫ ই জুন, ২০১৪ রাত ৯:৪০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



‘সাইকস-পিকোট মৃত,’ওয়ালিদ জুমব্লাত গত রাতে আমার উদ্দেশ্যে গর্জে ওঠে। হয়তো তিনিই সঠিক। তিনি লেবাবনের ড্রুজ ধর্মের একজন নেতা। ১৫ বছরের একটি গৃহযুদ্ধে লড়াই করেছেন। ওই গৃহযুদ্ধ লেবাননের মানচিত্রকেই নতুন করে নির্ধারণ করে। ওয়ালিদ জুমব্লাত বিশ্কবাস করেন, উত্তর এবং পূর্ব সিরিয়া ও পশ্চিম ইরাকের সুন্নি জেহাদিদের নিয়ন্ত্রণ অজর্নের নতুন লড়াইটি শেষপর্যন্ত বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইংরেজ-ও-ফরাসি ষড়যন্ত্রকে ধসিয়ে দিয়েছে। এ ষড়যন্ত্রের জন্ম হয়েছিলো মার্ক সাইকস এবং ফ্রান্সিস পিকোটের হাতে। এই পরিকল্পনাটি ওটোম্যান আমলের মধ্যপ্রাচ্যকে নেহাতই পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিতকতগুলো ক্ষুদ্র আরব রাষ্ট্রে ভাগ করে ফেলে।
আল-কায়েদার সঙ্গে সম্পর্কিত সুন্নি যোদ্ধারা ইরাক এবং সিরিয়ার ইসলামী খেলাফতকে অস্তিত্ব দানের জন্য লড়াই করে আসছে। হোক তা ক্ষণস্থায়ী। সিরিয়া, ইরাক, লেবানন কিংবা জর্ডান, কিংবা প্রতিপত্তিশালী রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত প্যালেস্টাইনের মাঝে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের হাতে সৃষ্ট কৃত্রিম সীমান্ত রেখা নিয়ে একবিন্দুও ভাবে না। মসুল দখলের ঘটনায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর মিত্র দেশগুলোর হাতে গড়া বিভাজনের গোপন পরিকল্পনাটি ধসে পড়েছে তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। কারণ তেল সম্জপদের জন্যই ব্রিটেন এবং ফ্রান্স দুই দেশই মসুলকে নিজের করতে চাইতো।
সাইকস-পিকোট চুক্তি এখনো পুরো মধ্যপ্রাচ্যকে তাড়া করে বেড়ায়। ব্রিটেন প্যালেস্টাইনে ইহুদিদের জন্য ‘মাতৃভূমি’ গড়ে তোলার পক্ষে ব্রিটেনের সমর্থন দানের যে প্রতিশ্রুতি ১৯১৭ সালের ব্রিটিশ পররাষ্ট্র আর্তুর বেলফোর দিয়েছিলেন তা বাস্তবায়নের সুযোগ করে দেয় এই চুক্তি। আসলে কেবল আজকের দিনের আরব জনগণই ( এবং ইসরাইয়েলের) ভাল করে বুঝতে পারে এই গভীর ঐতিহাসিক পালাবদলটা। বুঝতে পারে এর গভীর রাজনৈতিক তাৎপর্যটাও। আসলে মধ্যপ্রাচ্যের পুরোনো উপনিবেশিক মানচিত্রটাই গত এক সপ্তাহের অসাধারণ যুদ্ধটাকে অনিবার্য করে তুলেছে।
১৯১৮ সালে অটোমান সাম্রাজ্যের পতনে উত্তর-পূর্ব, দক্ষিণ-পশ্চিম অক্ষরেখা বরাবর তা দুই ভাগে ভাগ হওয়ার কথা ছিল। আজকের দিনে কুর্দি নিয়ন্ত্রিত কিরকুকের কাছ থেকে এ অরেখাটি মোটামোটিভাবে শুরু হয়ে উত্তর ইরাকের মসুল এবং সিরিয়া মুরভূমিকে ঘিরে বর্তমানে যা গাজার পশ্চিম উপকূল বলে পরিচিত তার ভেতর দিয়ে যাওয়ার কথা। মসুল প্রথম দিকে ফ্রান্সের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়-- এর ফলে বিট্রিশদেরকে তেলসম্পদ জলাজঞ্জলি দিতে হয়। কারণ ব্রিটেন এবং রাশিয়ার ককেশাস এলাকার মাঝে মসুল যেমন একটি ফরাসি বাফার জোনে পরিণত হবে, তেমনি বাগদাদ এবং বসরা ফরাসি এলাকার ভেতরে থাকার চেয়ে ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণে থাকাই বেশি নিরাপদ মনে করা হয়েছিল। তবে তেলসম্পদ ঘিরে ব্রিটেনের বাণিজ্যিক আকাঙ্খা বেড়ে যায়। এর ফলে সার্বভৌম চুক্তি বলে মসুলকে নিজের কাছে ফিরিয়ে নেয় ব্রিটেন। ব্রিটেনের অধিগত ইরাকের (পূর্বের মেসোপটেমিয়া) নতুন রাষ্ট্রের ভেতরে মসুলকে যুক্ত করা হয়। আর মসুলের তেল নিরপাদে লন্ডনে যেতে থাকলো। ইরাক, জর্ডান এবং পুরো প্যালেস্টাইন ব্রিটেনের অধীনে গেলো আর সিরিয়া ও লেবানন গেলো ফরাসি নিয়ন্ত্রণে।

কিন্তু আল-কায়েদা ও তাদের নুসরা বাহিনি এবং আইএসআইএস এই মিত্রগোষ্ঠীসমূহ মিলে যে নতুন ভৌগলিক মানচিত্র তৈরি করেছে তা উত্তর-পূর্ব থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে এগোয় না, বরং পূর্ব থেকে পশ্চিমে এগিয়ে যায়। এর মধ্যে ফাল্লুজা, তিকরিত, মসুল এবং রাক্কা শহর এবং পূর্ব সিরিয়ার বিশাল এলাকাও রয়েছে। জিহাদি কৌশল বেশ দৃঢ়ভাবেই ইঙ্গিত করে, পশ্চিম বাগদাদ থেকে সীমারেখাটি যাত্রা করে ইরাকি এবং সিরীয় মরুভূমিকে নিজের সীমার ভেতরে নিয়ে আসে। ইরাকের হোমস, হামা এবং আলেপ্পোও এর ভেতরে পড়ে যায়। তবে আত্রামবিশ্বাস হারানো ইরাকি সেনাবাহিনি এখন যে ধরনের যুদ্ধে লিপ্ত প্রায় তেমনি একটা যুদ্ধের মাধ্যমে সিরীয় সরকারী সেনাবাহিনি সফলভাবেই হোমস এলাকার পুর্নদখল নিয়েছে। হামা দখল নেওয়ার চেষ্টা করছে। এবং আলেপ্পো বেহাত হওয়ার হাত থেকে বেঁচে গেছে।
এদিকে দৈবত্রক্রমে একটি ঘটনা ঘটেছে, অর্থনীতিবিদ আয়ান রুটলেজ অতি-সম্প্রতি বিশ্বযুদ্ধের আগে-পরে মুসুল ও এর তেলের জন্য যুদ্ধ এবং মক্কার সুন্নি মুসলমান শরীফ হোসাইনের কথাভঙ্গের ফলাফল নিয়ে একটা হিসেবেনিকেশ প্রকাশ করেছেন। অটোমান সাম্রাজ্য উৎখাতে সহযোগিতা করায় ব্রিটেন হোসেইনকে একটি স্বাধীন আরব ভূমির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। দক্ষিণ ইরাকে -- যেখানে বসরার তেল সম্পদ রয়েছে -- শিয়া গোষ্ঠীকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য বিট্রেনের মাথাব্যথা নিয়েও রুটলেজ একটা অনুসন্ধান চালিয়েছেন। এখন যে সংকট ইরাককে টুকরো টুকরো করছে তার সঙ্গে এ বস্তুটি খুবই প্রাসঙ্গিক।
আরবে শরীফ হোসাইনির মতার উত্তরসূরি সৌদি রাজপরিবার। আর যেই জিহাদি গোষ্ঠী পহূর্ব সিরিয়া এবং পশ্চিম ইরাক এবং এখন মসুল ও তিরকিতের দখল নিয়েছে সেই গোষ্ঠীটিকেই এই রাজপরিবার বিলিয়ন ডলার সহায়তা দিচ্ছে। যতোদিন না আমেরিকা সুন্নি স্বৈশাসক সাদ্দাম হুসেনকে ছুঁড়ে ফেলে শিয়া ইরানের মিত্র সংখ্যাগরিষ্ঠ শিয়াদের সরকারকে ক্ষমতায় বসিয়েছে ততদিনই আরব উপকূল এলাকার তেল সম্পদের উপর নিয়ন্ত্রণ অর্জন করার ভেতর দিয়ে সৌদিরা এ এলাকায় সুন্নি ক্ষমতার ভিত্তি হিসেবে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করে রেখেছিল।
তারপর, মধ্যপ্রাচ্যের পূর্বাঞ্চলীয় নতুন মানচিত্রটি ইরাকের তেল-রপ্তানি কমিয়ে এবং তেলের দাম বাড়িয়ে (অবশ্যই এর সঙ্গে সৌদি তেলও রয়েছে) এবং এখনো নিষেধাজ্ঞা জর্জরিত ও আতংকগ্রস্ত ইরানের বেহাত হওয়ার বিনিময়ে এ এলাকার তেলসম্পদের উপরে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে সৌদি ক্ষমতাকে বাড়িয়ে তুলেছে। আর ইরান নিশ্চিতভাবেই তার শিয়া ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নেতৃত্বাধীন পতন-উন্মুখ বাগদাদ সরকারকে রক্ষা করবে। মসুলের তেল এখন সুন্নিদের তেল। এবং বাগদাদের পশ্চিমে জেহাদীদের দখলে থাকা মুরভূমিতে ধারণা করা হয় বিশাল এলাকা জুড়ে তেলের মজুদ রয়েছে যার অনুসন্কাধান কাজ এখনো চালানো হয়নি। এ মজুদ শিয়া নিয়ন্ত্রিত বাগদাদের জাতীয় সরকারের হাতে নয়, বরং তা এখন বেশ দৃঢ়ভাবেই সুন্নিদের দখলে।
এই ভাঙন হয়তো,বলতেই হয়, নতুন চেহারায় ইরান-ইরাক যুদ্ধের সম্বাভানাকে উস্কে তুলবে। এর আগে ইরান-ইরাক যুদ্ধে ১৫ লক্ষ সুন্নি এবং শিয়া মসুলমান নিহত হয়। বাইরের দেশসমূহ দুই দেশকেই সমরাস্ত্র সরবরাহ করেছে। তবে সাদ্দামের সুন্নি নেতৃত্ব আরব উপকূলীয় দেশসমহূরে সহযোগিতা পেয়েছে। ক্ষমতাধর এই দুই মুসলিম রাষ্ট্র পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত দেখে পশ্চিমাবিশ্ব খুশি হয়। আর সেই কারণেই ওয়ালিদ জুমব্লাত এখন এও বিশ্বাস করেন যে, এই সাম্সাপ্রতিক ট্রাজেডি মি. সাইকস এবং মি পিকোটকে নস্যাত করে দিয়েছে। এবং এই ট্রাজেডি কবরে শায়িত আর্তুর বেলফোরের মুখে হাসি ফোটাবে।
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ব্লগার'স ইন্টারভিউঃ আজকের অতিথি ব্লগার শায়মা

লিখেছেন অপু তানভীর, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১১:০৫



সামুতে ব্লগারদের ইন্টারভিউ নেওয়াটা নতুন না । অনেক ব্লগারই সিরিজ আকারে এই ধরণের পোস্ট করেছেন । যদিও সেগুলো বেশ আগের ঘটনা । ইন্টারভিউ মূলক পোস্ট অনেক দিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

...এবং উচ্চতায় তুমি কখনই পর্বত প্রমাণ হতে পারবে না

লিখেছেন নতুন নকিব, ০৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৫৬

...এবং উচ্চতায় তুমি কখনই পর্বত প্রমাণ হতে পারবে না

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ অন্তর্জাল।

ছোটবেলায় মুরব্বিদের মুখে শোনা গুরুত্বপূর্ণ অনেক ছড়া কবিতার মত নিচের এই লাইন দুইটাকে আজও অনেক প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

লালনের বাংলাদেশ থেকে শফি হুজুরের বাংলাদেশ : কোথায় যাচ্ছি আমরা?

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৪



মেটাল গান আমার নিত্যসঙ্গী। সস্তা, ভ্যাপিড পপ মিউজিক কখনোই আমার কাপ অফ টি না। ক্রিয়েটর, ক্যানিবল কর্পস, ব্লাডবাথ, ডাইং ফিটাস, ভাইটাল রিমেইনস, ইনফ্যান্ট এনাইহিলেটর এর গানে তারা মৃত্যু, রাজনীতি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি! চুরি! সুপারি চুরি। স্মৃতি থেকে(১০)

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৪


সে অনেকদিন আগের কথা, আমি তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। স্কুলে যাওয়ার সময় আব্বা ৩ টাকা দিতো। আসলে দিতো ৫ টাকা, আমরা ভাই বোন দুইজনে মিলে স্কুলে যেতাম। আপা আব্বার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×