(জানুয়ারি ২০১৬)
“ইশ! ভাঁজা মাছটা উলটে খেতে পারে না! হাঁ কর গাধা…”
হাঁ করা হল। মম ওর মুখে এক নলা ভাত ঢুকিয়ে দিল। আমি মমের বর, দরজার আড়াল থেকে দেখলাম, আমার খুব হিংসে হল। খুব। আগে কখনো দেখিনি যুবককে, ওর সাথে অন্য যে কাউকেই একই রকম লাগে। ওই ছেলেটা..ওর সাথে অত কী ওর? আমার অবশ্য একটুও ইচ্ছা করল না ওদের কাউকে খুন-টুন করতে যেসব ডিটেকটিভ গল্পে লেখা থাকে আরকি...। কষ্ট পেলাম, সেটাই তো যথেষ্ট।
ঘুম ভেঙ্গে গেল। উফ! কষ্টটা কি সুন্দর উপভোগ করছিলাম, গেল। এখন মন খারাপ হয়ে থাকো পড়ে! পাশে তাকালাম। না, মম নেই। কখনো থাকে না। আমার আগেই উঠে পড়ে। আমি ঊঠে ধ্যানের ভাব করে ওর চায়ের অপেক্ষা করতে লাগলাম।মেয়েটা কি করে যেন টের পেয়ে যায় আমি উঠে গেছি। আজকে তিন মিনিট লাগল না। ওকে দেখে হাসি দিলাম।
“এই নেন স্যার, চা। ইশ! দাঁত মাজে না, হলুদ এক্কেবারে।“
ওকে বেশ দেখাচ্ছে। গোসল করেছে সকালেই। সব মেয়েদেরই হয়ত সুন্দর লাগে, তবে ওর মতন কেউ না।
“কি করো?”
“ভাত রান্ধি। আপনি খাবেন যে বড়!”
ইশ! মেয়েটা এত সুখী মুডে আছে। আমার জন্যে? সত্যি? ওকে সন্দেহ করতে ইচ্ছা করে, সুযোগ পাই না যে! দুঃখ হল নেশার মত, একবার এর মজা পেলে আর না হলে জমে না।
“আচ্ছা, তুমি জানতে পারো কী করে যে আমি জেগে গেছি সঙ্গে সঙ্গে চা হাজির হয় কী করে?”
“আছে আছে। মেয়েলী ব্যপার, তোমার জানার দরকার নাই।“
বলে একটা স্নেহের কটাক্ষ (অন্তত আমার কাছে তাই মনে হল) হেনে চলে গেল। আমার জন্যে আর ওর জন্যে ভাত রাঁধতে।
আমার স্বীকার করতে লজ্জা নেই, ওকে বেশিক্ষণ না দেখলে ভাল্লাগে না। রান্নাঘরে রওনা দিলাম। এখন ওর সাথে অন্য কাউকে দেখার সম্ভাবনা কত? গোয়ালা আসে, এই সময়েই তো... তার সাথে... দুরুদুরু মন নিয়ে গেলাম।
কোমরে আঁচল পেঁচিয়ে একেবারে রণমূরতী গিন্নী রান্না করছে। আমি দরজায় ঠকঠক করে বললাম, “আমার সুন্দরীডা ঘরে আছে?”
“কি চাই?”
“তোমাকে চাই!”
হায়রে! মেয়েটাকে খুশি করা কত সোজা, এতদিন পরেও। বিয়ের একবছর হতে চলল। আমার বয়েস চব্বিশ, ওর বাইশ। প্রেমের বিয়েই বটে! পিতৃদেব অনেক টাকা রেখে গেছেন, বিশাল বাড়ি। মাসে মাসে ব্যাংকের যা ইন্টারেস্ট পাই, রূপকথার মতন। দুজনের সংসার তো, খুব কম খরচ। বাকিটা ব্যাংকেই থাকে, পরের মাসে ইন্টারেস্ট বাড়ে। বাবা যে সৎপথে টাকা আয় করেন নি না বলাই বাহুল্য। এসবের বেশি বর্ণনা নাই বা দিলাম।
যাই হোক, আমি ঘরে ফিরে এলাম। একটু বাইরে যাওয়া দরকার। সারাদিন বাড়িতে বসে থাকাটা ভালো দেখায় না। লোকে স্ত্রৈণ বলবে তো! হেহ হে! আর তাছাড়া, আমার জন্যে হয়ত মম সুযোগও পাচ্ছে না বাইরে থেকে কাউকে এনে...
“মম, আমি গেলাম।”
“গেলাম মানে?”
“এই তো...ঘুরে আসি।”
“আর আমি একলা?”
“হুম... গান গাও...আমার এই পথচাওয়াতেই...”
“আচ্ছা, অনেকদিন আমরা হাঁটতে যাই না। আজ যাই চলো।”
অতঃপর... ভাত রান্না হয়ে গিয়েছিল। তরকারী সব শেষ, জ্বাল দেয়া বাকি ছিল। রেখে সুন্দরীকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। অবশ্যই হাত ধরে, লোকজনের সামনে। আমার অত লজ্জা নাই। আর মমের তো নাইই!
আমার আর ওর জীবনটা পিকনিকের মত। কোন কাজ নাই, কিছু করার দরকার নাই আর নিজের বলতে দুজনেরই আর কেউই নাই। বেশ একটা দুজনের পিকনিকে যে জীবনটা ভালোই কাটার কথা তাতে আর সন্দেহ কি। কিন্তু, ওই... গল্পে সবটা লেখা থাকে না, থাকা উচিতও না। কমল তুলতে গেলে আগেই কাঁটা খেলে যদি লোকে আর না তোলার চেষ্টা করে?
আমার নাম নীল। কন্ঠ খারাপ না। বাঁশি বাজাতে পারি না। নাম দেখে প্রেমে পড়েছিল ও, ওই যে অঞ্জন দত্তের গান নীল? সেইটে শুনে। তবে এ তো প্রেম নয়, ওর প্রেম পেতে কম কষ্টটা করিনি। এখন আমি বলতেই পারি মম আমার মানুষ। বলি না। ইদানিং মনে করি মানুষ কারো হবে বলে জন্মায় না। মানুষ নিজের। মম এখন আর কারোকে চুমু খেলে আমার কিছু বলার থাকা উচিত নয়, কষ্ট পাবো, হুম... কষ্ট পাওয়ার ব্যপারটাই গোলমেলে।
মম বলল, “এই চলো রিকশা নিই।“
নিলাম। আমরা গুলশান থেকে শাহবাগ যাবো। আপাতত। রিকশায় বসে নানা আগাপাশতলা ভাবছিলাম। হঠাত জোরে বলে ফেললাম, “আমার বৌকে আমি ভালবাসব না!”
মম কথাটা শুনে ফেলল। আমার দিকে তাকিয়ে হেসে আমার হাত ধরল আবার।
সারাদিন বেড়িয়ে ফিরে এসে প্রথম যেটা মনে এল, তরকারী ফ্রিজে রাখা হয় নাই, এক্কেবারে পচে গেছে নিশ্চয় এই গরমে। লম্বা একটা জিব বের করল ও। আমি বললাম, “চলো, কিনব মোরগ কিনব কোক/ মোমের আলোয় ডিনার হোক!”
“তাই বলে... বাচ্চাদের মতন...ভুলে গিয়ে...”
আমি হেসে বললাম, “মাত্র তো এক বছর... আস্তে আস্তে শিখবা হি হি...”
সারাদিন হাঁটাহাঁটি করে, ঘুরে টুরে দুজনেই ক্লান্ত। এখন আবার হোটেলে গিয়ে খাবার মত শক্তি কারোরই নেই। পথে অনেক কিছুই খাওয়া হয়েছে, খাওয়ার অত চাড়াও নেই। ও আমাদের বিছানা ঠিক করতে শুরু করে দিল। ঠিক তখন, আমার মাথায় বিদ্যুতের মতন ভোরের স্বপ্নের কথা মনে হল। ও অন্য একটা ছেলেকে খাইয়ে দিচ্ছে, ঠিক যেমন করে আমি ভাবতাম।
হাত পা কাঁপতে শুরু করল। চোখের সামনে ও, ঝাড়পোঁছ করছে। খুব রাগ হল। মনে হল সবটাই ছলনা। স্বপ্নটাই সত্যি, আর বাস্তবটা রূপকথা।
ওর ঝাঁটা হাত পাশ কাটিয়ে শুয়ে পড়লাম। মনের মিল যদি থাকে তবে নিজের মানুষের মনের ভাব অনেকটাই বোঝা যায়। ও নিশ্চয়ই কিছু বুঝল। দাঁড়িয়ে রইল। ওর মাথার পেছন দিয়ে আলো আসছিল, কালো একমাথা চুলের পেছনেই সাদা আলোর ঝলকানি। ও দাঁড়িয়েছিল প্রতিমার মত। কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার পর ও হাসল, কত কষ্ট আর আত্মগ্লানি থেকেই না ওরকম হাসি হাসা যায়। আমার খুব অনুশোচনা হল। যেটা বদলানো যাবে না তাই নিয়ে এত কিসের ভাবনা? ওর হাসিটা আমার খুব ভেতরে গিয়ে লেগেছিল, সারাদিনে যত কষ্ট পাইনি এক হাসিতে তার বেশি পেলাম। সেজন্যেই তো ওকে এত ভালোবাসি!
ও খুব আস্তে করে উঠে সাবধানে শুয়ে পড়ল আমার পাশে। আমি বেড সুইচ টিপে আলো নিভিয়ে দিলাম। তারপর হুট করে ওকে বুকে টেনে নিলাম। ওর মন ভালো করতে না, আমার প্রচন্ড দরকার ছিল। ও কেঁপে উঠে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল, “তুমি জানো? তোমাকে একটু পরে পরে না দেখলে কিচ্ছু ভাল্লাগে না?... রান্না রেখে কতবার তোমাকে একটু দেখে আসি খোঁজ রাখো?... কেন কষ্ট দিবি তুই?...ইত্যাদি ইত্যাদি”
আমার বুকের ঘনিষ্ঠতায় কিছুক্ষণের মধ্যেই ওর কান্নার বেগ কমে গেল। ওকে ছাড়লাম না। একসময় আস্তে করে বললাম, “জানো, অপ্সরার প্রেমে পড়লে মানুষ পাগল হয়?”
রাত্রে আবার স্বপ্ন দেখলাম। ও কার যেন হাত ধরে হাঁটছে। ওর মুখ খুব উৎফুল্ল। স্বপ্নেই বুঝলাম স্বপ্ন দেখছি, এবং ঘটনাটা যে আমার এখন সেটা আমারই মন খারাপের কারণ হতে চলল সবটাই বুঝলাম। গতকালই এরকমভাবে ওর হাত ধরে হেঁটেছি। আমি মন খারাপ আর ঈর্ষা গুলিয়ে ফেলি না। আমার কাউকে হিংসা করার নেই, আমার মন খারাপ হল ঘুমের মধ্যেই।
সকালে উঠে মজার দৃশ্য। রাত্রে যেভাবে ঘুমিয়েছিলাম সেভাবেই আছি দুজনে। ওকে জড়িয়ে ধরে। চোখ খুলেই বুঝলাম অনেক আগেই জেগে গেছে রাজকন্যা। আমার বুকের মধ্যে থেকেই হালকা গলায় বলল, “ঘুম ভাঙল শেষমেষ?”
আমি বললাম, “রোদে গরমে। রাত্রে দাঁত মাজি নাই।”
“কয়দিনই বা মাজেন!”
“তোমার অসুবিধা হয় না?” বলে অর্থপূর্ণ চাহনি দিয়ে হেসে ফেললাম।
ও হাসল, কিছু বলল না। আমি জিগ্যেস করলাম, “আচ্ছা, রোজ তো আমার আগে উঠেন, আজ উঠেন নাই যে?”
একটু হেসে বলল, “তোমার আগেই উঠছি। নামতে আলস্য লাগছিল।”
আমি অবশ্য অন্যরকম ভাবলাম। নিশ্চয়ই আমার বুক থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে কাজে যাবার মত শক্তি ওর ছিল না বলেই জড়িয়ে ধরে জেগে ছিল। বুকটা ভরে যাবার একটা স্বাদ! স্বপ্নের দুঃখ ভুলে গেলাম।
আমি উঠে দাঁত মাজতে গেলাম। দাঁত মাজতে মাজতে নিজেকে দেখলাম আয়নায়। এমন হাসি পেল!
এসে দেখি সুন্দরী রান্নার জোগাড়যন্তর করে। এর গৃহিণী রূপটা...মাঝে মাঝে খুব সাধারণ হতে ইচ্ছা করে। আমি হালকা গলায় বললাম, “পাগলী, চলো অন্য বাসায় থাকব কিছুদিন।”
“এইটা আবার কোন পাগলামি?”
“এই বাসাটা কিছুদিন তালাবন্ধ থাক। চলো, পিকনিক করে আসি। একটা বাড়ি ভাড়াকরেই ফেলেছি প্রায়। তুমি না রাজি হলে তো হবে না।”
“কোথায়?”
“থাকব কাছেই... বাসা ভাড়া নিয়ে থাকব আরকি!”
“পাগলা, তোমার সঙ্গে ভাড়াবাড়ি জীবন কাটাব?”
“বাব্বাহ... কবিতা পড়ার রোগ ধরল কবে?”
“অনেকবার শুনিয়েছিস তো রে, মুখস্থই হয়ে গেছে।“
যাই হোক, ওর প্রশ্ন এড়িয়ে আমি ওকে নিয়ে পরদিনই একটা দুই ঘরঅলা গোল বারান্দাওলা বাড়িতে উঠলাম। আমার বাড়ি থেকে বাসে আধাঘন্টার দুরত্ব।
আমাদের গল্পের আখ্যানভাগ এখান হইতে শুরু।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই নভেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১:১২