রফিকউল্লাহ খান
ভাষাসংগ্রামী হাসান হাফিজুর রহমান
কোনো যুগান্তকারী ঐতিহাসিক ঘটনার সঙ্গে ব্যক্তির সম্পৃক্তিকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করা যায়। আন্দোলনের প্রেরণাদায়ী দার্শনিক হিসেবে কিংবা নেতৃত্বদানকারী হিসেবে অথবা ঘটনার সমান্তরাল সক্রিয় কর্মী হিসেবে। কিন্তু বাঙালির ভাষা আন্দোলন কোনো ব্যক্তিপ্রতিভার এক উদ্যোগে যেমন গড়ে উঠেনি, তেমনি এর পরিণতি ও প্রেরণা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও ব্যক্তি অপেক্ষা সমষ্টির যৌথ সংগ্রামের ভূমিকাই ছিল মুখ্য। আর যে অবিনাশী সদর্থক চেতনার ভিত্তিতে ভাষা আন্দোলনের সূচনা ও পরিণতি, তার রাজনৈতিক ও দার্শনিক তাৎপর্য গভীর ও সুদূরপ্রসারী হলেও তার যথাযথ পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়ন এখনও হয়নি। ১৯৪৭-এ ভারত বিভাগ, ১৯৪৮ সাল থেকে সূচিত ভাষা আন্দোলন, ১৯৫২-র একুশে ফেব্রুয়ারিতে তার চূড়ান্ত ও রক্তক্ষয়ী প্রকাশ; ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের কাছে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার রাজনৈতিক সংগঠন মুসলিম লীগের পরাজয়, ১৯৫৮ সালে সেনাতন্ত্র ও স্বৈরশাসনের প্রবর্তন, ষাটের দশকব্যাপী ছাত্র আন্দোলন, ৬ দফা আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০-এর নির্বাচন ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি জাতিকে কয়েক শতাব্দীর জীবনীশক্তিকে ২৩ বছর সময়সীমার মধ্যে ব্যয় করতে হয়েছে। ইতিহাসের দীর্ঘদিনের সঞ্চিত উপকরণগুলো প্রবল স্রোতের বেগে পুরো জনগোষ্ঠীকেই আন্দোলিত ও সম্মুখগামী করেছে। দ্বিজাতিতত্ত্বের বিষফল 'পাকিস্তান' রাষ্ট্রের তাত্তি্বক ও রাজনৈতিক ভিত্তির অসারত্ব প্রমাণের ক্ষেত্রে ভাষা আন্দোলন কার্যকর ভূমিকা পালন করে। এ আন্দোলনের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো প্রথম পর্যায়ের নাগরিক শিক্ষিত মধ্যবিত্তের গ ি ছাড়িয়ে তা অতিদ্রুত সর্বস্তরের মানুষকেই আন্দোলনের অংশে পরিণত করতে সক্ষম হয়। যৌথ চেতনা, যৌথ জীবনাবেগ ও সম্মিলিত সংগ্রামের এই নবজাগরণতুল্য আয়োজনে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও সৃষ্টিশীলতার ক্ষেত্রেও ঘটে যায় বড় ধরনের যুগান্তর। এই যুগান্তর ও বিপ্লবকালের কর্মী ও শিল্পীপুরুষ হাসান হাফিজুর রহমান। ১৯৫২ সালে তার বয়স ছিল ২০ বছর। তখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের এমএ শ্রেণীর ছাত্র।
বাঙালি মুসলমানের রাজনীতিচেতনা ও সংস্কৃতিচর্চার ক্ষেত্রে পাকিস্তান আন্দোলন প্রতিক্রিয়াশীলতার যে বিষবৃক্ষ রোপণ করে, তারই খ িত, অশ্রুসিক্ত ও শোণিতলিপ্ত পরিণতি ১৯৪৭-এর 'মধ্যরাত্রির স্বাধীনতা'। বিশ শতকের দুই-এর দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিম লে সূচিত শিখাগোষ্ঠীর সাহিত্য, সমাজ ও সংস্কৃতিকেন্দ্রিক প্রগতিবাদী ও যুক্তিশাসিত চিন্তাচর্চার ধারা তিন ও চার দশকের প্রতিক্রিয়াশীলতার অপ্রতিহত মুখব্যাদানের কাছে অসহায় হয়ে পড়ে। ফলে পাকিস্তানবাদী আবেগ ও প্রতিক্রিয়াশীলতার সর্বগ্রাসী রূপ প্রগতিবাদী সুস্থ সংস্কৃতির ধারাকে ব্যাহত করে। ভাষা আন্দোলনে যারা অংশগ্রহণ করেছিলেন, তাদের অধিকাংশই ছিলেন বয়সে তরুণ এবং আবেগের ক্ষেত্রে সৎ ও দেশপ্রেমে ঐকান্তিক।
যে সংগ্রামী জীবনচেতনা হাসান হাফিজুর রহমানের সাহিত্যবোধের ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র জীবনাবেগ ও শিল্পাবেগ সৃষ্টি করেছিল, তার ভিত্তি রচিত হলো পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অল্পকালের মধ্যেই। প্রগতিশীল রাজনৈতিক কার্যক্রমের সঙ্গে তার এই সংযুক্তি কেবল ব্যক্তিজীবনের ক্ষেত্রেই নয়, বাংলাদেশের সাহিত্য-সংস্কৃতির ধারায়ও নবতর মাত্রা সংযোজন করে। বিএ শ্রেণীতে অধ্যয়নকালে কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সংযুক্ত হন তিনি। এবং আকৃষ্ট হন প্রগতি লেখক সংঘের কর্মধারার প্রতি। প্রগতিশীল রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক কর্মকা ের সঙ্গে সংযুক্তিই তার জীবনবোধ ও শিল্পজিজ্ঞাসাকে স্বতন্ত্র ও নবমাত্রিক করে তোলে।
হাসান হাফিজুর রহমান সমাজ ও জীবনবিচ্ছিন্ন ছিলেন না কখনও; সাহিত্যসাধনাকে কর্মীর একাগ্রতায় গ্রহণ করেছিলেন এবং তার সদর্থক উত্তরণের প্রেরণার উৎস হিসেবে 'প্রগতি লেখক সংঘে'র ভূমিকা ছিল সুদূরপ্রসারী। পাকিস্তানের জন্ম যে সাহিত্যিক ও শৈল্পিক বন্ধ্যত্ব নিয়ে আসে (আজাদ ১৯৯০ : ১৩), মুষ্টিমেয় লেখকের মতো হাসানও গোড়া থেকেই তা অতিক্রম করার সাধনায় আত্মনিয়োগ করেন।
হাসান হাফিজুর রহমানের প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় সোনার বাংলা পত্রিকায়, ১৯৪৯ সালে। ১৩৫৬ সালের কার্তিক সংখ্যা সওগাত-এ প্রকাশিত হয় 'শেষ মুহূর্ত-১৩৫৫' কবিতা। ১৯৫০ সালে 'পূর্বাশা'য় তার কবিতা 'যে কোনো সর্বহারার প্রার্থনা' এত গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হয় যে, একজন তরুণ কবি রাতারাতি আলোচিত হয়ে ওঠেন সাহিত্যাঙ্গনে। এরপর বুদ্ধদেব বসুর কবিতায় 'কোন একজনের মৃত্যুর মুহূর্তে'ও খুব সম্মানসহকারে ছাপা হয়। আশরাফ সিদ্দিকী এবং আবদুর রশীদ খান সম্পাদিত বিভাগোত্তর কালের প্রথম কবিতা সংকলন 'নতুন কবিতা'য় (১৯৫০) 'কোন একজনের মৃত্যুর মুহূর্তে' কবিতাটি অন্তর্ভুক্ত হয়। তার দাঙ্গাবিরোধী অনবদ্য গল্প 'আরো দুটি মৃত্যু' ১৯৫০ সালে প্রথমে 'অগত্যা'য় এবং পরে 'দিলরুবা' পত্রিকায় মুদ্রিত হয়। মুস্তাফা নূরউল ইসলাম ও আলাউদ্দিন আল আজাদ সম্পাদিত দাঙ্গার পাঁচটি গল্পগ্রন্থের প্রকাশক ছিলেন হাসান হাফিজুর রহমান। এই গ্রন্থের জন্য কিষণচন্দরের একটি গল্পেরও অনুবাদ করেন তিনি। মাসিক মোহাম্মদী পত্রিকায় (জ্যৈষ্ঠ ১৩৫৮) প্রকাশিত হয় তার 'অস্বস্তি' নামক ছোটগল্প। 'জরিমানা' গল্প মুদ্রিত হয় সওগাত-এর পৌষ ১৩৫৯ সংখ্যায়। যে সমাজ ও মৃত্তিকামূলস্পর্শী জীবনচেতনা হাসান হাফিজুর রহমানের সৃজনী প্রতিভার মৌল বৈশিষ্ট্য, উলি্লখিত গল্প ও কবিতায় তার অন্তঃসাক্ষ্য সুস্পষ্ট। ১৯৫০-এর সাম্প্র্রদায়িক দাঙ্গার প্রতিক্রিয়ায় রচিত 'আরো দুটি মৃত্যু' তার সদর্থক জীবনচেতনার সার্থক শিল্পপ্রতিবিম্ব। এভাবেই আমরা দেখি, ছাত্রাবস্থায়ই তার জীবনজিজ্ঞাসা মানবমুখী শিল্প-অভিপ্রায়ে হয়ে উঠেছিল বিশিষ্ট, গৌরবম িত। এই সব রচনার অন্তঃবাহী নিগূঢ় চেতনাস্রোত অল্পকালের মধ্যেই সংগ্রামী চেতনায় রূপান্তরিত হয়। প্রকৃতপক্ষে, তার জীবনার্থ ও শিল্পবোধ সাহিত্য, সংস্কৃতি ও শিল্পের বিচিত্র উৎস থেকে শক্তি শোষণ করেছে। রাজনীতি সূত্রে মার্কসীয় তত্ত্বচিন্তার সঙ্গে গভীর সম্পর্ক স্থাপিত হলেও তত্ত্বাবেগ তার সহজাত জীবনচেতনাকে ভারাক্রান্ত করেনি। বরং এই রাজনীতিবোধ আমৃত্যু তার বিশ্বাসের কেন্দ্রে সদর্থক চেতনার আলো প্রজ্বলিত করে রেখেছে।
২
গণতন্ত্র, মানববাদ, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও সাম্যবাদের বৈশি্বক বিস্তারের পটভূমিতে একটা সংকীর্ণ চেতনাকে কেন্দ্র করে 'পাকিস্তান' রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা সমকালীন বিশ্বরাজনীতির পটভূমিতে ছিল অস্বাভাবিক, বিস্ময়কর। কিন্তু সামন্ত মূল্যবোধের কেন্দ্রমূলে যার আদর্শিক ভিত্তি নিহিত, তার অন্তর্গত দুর্বলতা ১৯৪৭ সাল থেকেই প্রকাশ পেতে থাকে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা বাংলাদেশের জনশ্রেণীর জন্য যে ঔপনিবেশিক শাসনেরই একটা নব্য প্রক্রিয়া, ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির কাছে তা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়। পাকিস্তানি প্রশাসনযন্ত্র প্রথমে উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছিল যে, পূর্ব পাকিস্তানের একটি শক্তিশালী মধ্যবিত্ত শ্রেণী বিদ্যমান, যারা সমাজের প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির কাছে নিজস্ব সত্তা বিলীন না করে বাংলাভাষার রক্ষণ ও আধুনিকীকরণের জন্য প্রস্তুত। (আহমদ ১৩৮২ : ৯৬) ইতিহাস, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও আর্থ-সামাজিক কাঠামোর স্বাতন্ত্র্যে পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসীরা কেবল বিশিষ্টই নয়, আত্মনিয়ন্ত্রয়ণ অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে তারা আবহমানকাল ধরে সংগ্রামশালীও বটে।
অন্ধ ধর্মমোহের বন্ধনে দুই বিপরীত ভৌগোলিক প্রান্তকে সংযুক্ত করার চক্রান্তের প্রথম প্রকাশ ঘটে রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে_ এ নিয়ে চিন্তাভাবনা দেশ বিভক্তির সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়। '৫ ডিসেম্বর, ১৯৪৭ ঢাকাতে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটির সর্বশেষ বৈঠক বসে। ওয়ার্কিং কমিটির এই বৈঠকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ হয় যে, উর্দুকে পূর্ব বাংলার রাষ্ট্রভাষা করা হবে না।' (উমর ১৯৭৯ : ৪) ইতিপূর্বে রাষ্ট্রভাষাবিষয়ক চিন্তাভাবনা সচেতন মহলে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছিল। প্রথমে স্ববিরোধ-আক্রান্ত হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের সপক্ষে যুক্তি প্রদান করা হয়। ডক্টর কাজী মোতাহার হোসেনও বাংলা ভাষার পক্ষে সুস্পষ্ট অবস্থান গ্রহণ করেন। কিন্তু ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ রমনা রেসকোর্স ময়দানে এবং ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বিশেষ সমাবর্তন উৎসবে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা ও গভর্নর জেনারেল মুহম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা করেন, 'পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু, অন্য কোনো ভাষা নয়।' যারা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার দাবি উত্থাপন করেছিলেন, তাদের উদ্দেশে তিনি এ দুটি ভাষণে পুনঃপুন 'বিদেশি এজেন্সির সাহায্যপুষ্ট, কমিউনিস্ট, পাকিস্তানের শত্রু, সংহতি বিনষ্টকারী, রাজনৈতিক অন্তর্ঘাতক, ঘরোয়া শত্রু, বিশ্বাসঘাতক, রাজনৈতিক সুবিধাবাদী, বোকার স্বর্গে বসবাসকারী স্বার্থপর, পঞ্চমবাহিনী ইত্যাদি বহু তিরস্কার বর্ষণ করেন।' (হক ১৯৭২ : ৯) এবং কঠোর দমননীতি সত্ত্বেও ভাষাপ্রসঙ্গ শিক্ষিত নাগরিক মধ্যবিত্তের সীমানা অতিক্রম করে বৃহত্তর জনজীবনেও আলোড়ন সৃষ্টি করে। ফলে আন্দোলন ক্রমাগত বিস্তৃতি লাভ করতে থাকে। অতঃপর বিক্ষোভ, বিতর্ক ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করার প্রস্তাব গৃহীত হয়। কিন্তু পাকিস্তান সরকারের নেতিবাচক ভূমিকা ও ষড়যন্ত্র এই আন্দোলনকে একটা রক্তাক্ত পরিণতিমুখী করে তোলে। এবং ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে সংঘটিত বিক্ষোভ, সংগ্রাম ও রক্তপাতের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলা ভাষার চিরন্তন মর্যাদা ও স্বীকৃতি।
ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে হাসান হাফিজুর রহমানের সম্পৃক্তি কেবল প্রত্যক্ষ কর্মকা ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, শিল্পিত আবেগে, সৃষ্টিশীলতার যুগান্তকারী প্রকাশে এবং সাংগঠনিক কর্মপ্রক্রিয়ায় হয়ে উঠেছিল প্রাণচঞ্চল ও গৌরবময়। তার জীবন ও শিল্পবোধের ক্ষেত্রে ভাষা আন্দোলন হয়ে উঠেছিল নবমাত্রিক সৃজনপ্রেরণার বীজশক্তি। ব্যক্তিবোধের সঙ্গে সমষ্টি-আবেগের এরূপ সমন্বয় আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতির ইতিহাসে বিরল। তার নিজ উচ্চারণের মধ্যেই এ বিবেচনার স্বীকৃতি বিদ্যমান :
"১৯৫২-র ভাষা আন্দোলনের সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি ছেলে-মেয়েই জড়িত ছিলো। ঝবহংধঃরড়হ সবারই সমান ছিলো। যেহেতু আমি সাহিত্যিক ছিলাম, সাংস্কৃতিক কর্মকা ের সাথে জড়িত ছিলাম_ সেজন্য কোনো কিছু করার অবকাশ আমার বেশি ছিলো।
একুশে ফেব্রুয়ারীতে আমি এবং অলি আহাদ মধুর ক্যান্টিনে বসে ছিলাম। তিনি আমাকে বললেন, মেডিক্যাল কলেজের ছেলেরা ইট-পাটকেল ছুড়ছে তুমি গিয়ে তাদের নিষেধ করো, নতুবা গুলি চলতে পারে। আমি গিয়ে তাদের নিষেধ করলাম, কিন্তু কেউ আমার কথা শুনলো না। কতক্ষণ পর দেখলাম, আমি নিজেও ইট মারতে শুরু করেছি। তারপর একটা টিয়ার শেল আমার কাছে পড়লো, কিন্তু সেটা ফাটেনি। আমি সেটা ঘুরিয়ে উল্টাদিকে মারলাম, তিন চার হাত দূরে সেটা পড়লো।
তারপর তিন/চার মিনিট পরে গুলি চললো। কারা করছে বুঝতে পারলাম না। বরকত ব্যারাকের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিলো, তার থাই ভেদ করে গুলি চলে গেলো। লম্বা মানুষ। বসে থাকলেও গুলি তার মাথায় লাগতো। আমি এবং বরকত একসাথেই অনার্সে ভর্তি হয়েছিলাম, চড়ষরঃরপধষ ংপরবহপব-এ। বেশ লম্বা, ছয় ফিট তিন ইঞ্চি, খুব চুপচাপ থাকতো। তার রাজনীতিসম্পৃক্তি সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা ছিল না। আমি তখন গেটে_ যখন বরকত গুলিবিদ্ধ হলো। গুলি আড়াইটায় হয়েছিলো। আমি বরকতের ডেডবডি দেখিনি।
আমি এবং মুর্তজা বশীর অন্য একজন আহতকে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাই। আরও কয়েকজনসহ জেলখানার উল্টোদিকে ক্যাপিট্যাল প্রিন্টিং প্রেস-এর ওখানে চলে গেলাম, মৌলভীবাজার। একজন বললো, মন্ত্রী মফিজউদ্দিনের ঙৎফবৎ-এ গুলি হয়েছে (পরে অবশ্য জানি এ তথ্য সত্য নয়)। একটা লিফলেট লিখি_ তা উক্ত মন্ত্রীকে লক্ষ্য করে রচিত। ৪.৩০ মি.-এর মধ্যে লিফলেট লেখা ও ছাপা সম্পন্ন হয়, সঙ্গীদের মধ্যে মুর্তজা বশির ছাড়া কারো কথা মনে নেই।
'অমর একুশে' কবিতাটি আমি ১৯৫২-এর মার্চ/এপ্রিলের দিকে লিখি। জুন মাসে কুমিল্লা সাহিত্য সম্মিলনে প্রথম জনসম্মুখে পাঠ করি। আমার সম্পাদিত 'একুশে ফেব্রুয়ারী' সংকলনেই সেটা প্রথম ছাপা হয়।... কবিতাটি রচনা করি স্বাভাবিক প্রেরণায়। তখন সবারই আবেগ ছিলো। ভাষা আন্দোলন তো ছিলো চঁনষরপ ংবহঃরসবহঃ-এর ব্যাপার, তার সাথে ব্যক্তিগত অনুভূতির সংযুক্তির ফলশ্রুতিই হলো 'অমর একুশে'। মূলত দেশজ অনুভূতি, সেখানে সংযুক্ত হলো ব্যক্তির পড়সসরঃসবহঃ।" (খান ২০০৭ : ৩৩-৩৪)
সৃজনশীলতার সঙ্গে রাজনৈতিক দায়বদ্ধতার এই সংযুক্তি হাসান হাফিজুর রহমানের আমৃত্যু সাধনায় পরিণত হয়েছিল। প্রথম একুশে ফেব্রুয়ারি সংকলন সম্পাদনার ক্ষেত্রে হাসান হাফিজুর রহমানের ভূমিকা কতটা অগ্রণী ছিল, তার প্রমাণ পাওয়া যায় সংকলনের প্রকাশক ভাষা আন্দোলনের অন্যতম কর্মীপুরুষ মোহাম্মদ সুলতানের ভাষ্য থেকে : "তেপ্পান্ন সালের প্রথম দিকে হাসান প্রস্তাব দিল ৫২-এ উত্তাল ভাষা আন্দোলনের সময়ে আমাদের দেশের সুধী লেখক সমাজ কলমের আঁচড়ে যা লিপিবদ্ধ করেছেন, পুস্তকাকারে তা প্রকাশ করা যায় কিনা। আজকের দিনে অনেকেই ভাবতে পারেন, কাজটি কত সহজ। মুসলিম লীগের শাসন, চতুর্দিকে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প, বামপন্থী মাত্রই রাষ্ট্রদ্রোহী, পূর্ব পাকিস্তানি তরুণদের আর্থিক অসচ্ছলতা, সরকারের গণবিরোধী শাসনের স্টিমরোলার_ সব কিছুকে অস্বীকার করেই এমন একটি দুঃসাহসিক কাজ করতে হবে। আমরা যারা রাজনীতি করতাম, ৮ পয়সা থেকে ১২ পয়সা পেলে রাজভোগ খাওয়া হত মনে করতাম। সেই সময়ে 'একুশে ফেব্রুয়ারী' বইটা বের করতে সেই মুহূর্তেই ৫০০.০০ টাকার প্রয়োজন। আমার আর হাসানের হাতে ৫০ টাকাও নেই। সমাধান করে দিল হাসান। বাড়িতে গিয়ে জমি বেচে সে টাকা নিয়ে আসবে। যা ইচ্ছা, যা চিন্তা, হাসান তাই করল।" (রহমান ১৯৮৩ : ৬২-৬৩) এই দায়বদ্ধতা যে প্রেরণা থেকে উৎসারিত, তার সাংস্কৃতিক শিকড় হাজার বছরের বাঙালির সংগ্রামশীল ও আত্মত্যাগী চেতনার সঙ্গে সম্পর্কিত।
১৯৫৩ সালের জানুয়ারি মাসের শেষ দিকে 'একুশে ফেব্রুয়ারী' সংকলন প্রকাশিত হয় এবং তা বাজেয়াপ্ত হয়ে যায় ২০ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায়। ভাষা আন্দোলনের শিল্পিত আবেগপুঞ্জকে সংরক্ষিত করার এই কর্মোদ্যোগ, নিষ্ঠা ও দায়িত্ববোধ হাসান হাফিজুর রহমানের জীবনচেতনার এক গৌরবোজ্জ্বল প্রান্ত। জাতীয় ইতিহাসের এক মহত্তম অধ্যায়ের রক্তাক্ত অনুভূতিপুঞ্জকে গ্রন্থবদ্ধ করে বাঙালি জাতির জীবন ও শিল্পচেতনার পটভূমিতে তিনি মর্যাদার স্থায়ী আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছেন।
বিচিত্র কর্মধারার সঙ্গে জড়িত থাকা সত্ত্বেও জীবনের উল্লেখযোগ্য সময়, অর্থ ও শ্রম তিনি মানুষ ও শিল্পের কল্যাণ ও সমৃদ্ধির লক্ষ্যে ব্যয় করেছেন। ভাষা আন্দোলন-পরবর্তী পর্যায়ে মাতৃভাষা ও জাতীয় সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে চরম অস্থিরতা বিরাজ করেছিল। পত্র-পত্রিকা-সাময়িকীর ক্ষেত্রেও চলছিল সংশয় ও দোদুল্যমানতা। বাঙালি মুসলমান সমাজের একমাত্র প্রগতিশীল সাহিত্য পত্রিকা সওগাতও এই সংকট থেকে মুক্ত ছিল না। উল্লেখ্য, ১৯৫০ সালের মে মাসে সওগাত কার্যালয় ও সওগাত প্রেস কলকাতা থেকে ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু প্রকৃত উদ্যোগ ও আত্মবিশ্বাসের অভাবে সওগাত-এর প্রকাশ হয়ে পড়েছিল অনিশ্চিত। এ অবস্থায় সওগাত পুনঃপ্রকাশের ব্যাপারে উদ্যোগী হয়ে হাসান হাফিজুর রহমান সওগাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এবং সওগাত পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
৩
বিভাগোত্তর বাংলাদেশের অন্তঃশীলা দুঃখদহনে অবসন্ন ও গতিচ্যুত হয়ে পড়া সমাজমানসে ভাষা আন্দোলন যে নবচেতনা সঞ্চার করে, তার ফলে আত্মসন্ধান, সত্তাসন্ধান ও জাতিসন্ধানের প্রশ্নটি নতুন পরিস্থিতিতে নতুন রূপে আত্মপ্রকাশ করে। এই পটভূমিতে সংঘটিত ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়েই ক্ষুব্ধ, অগি্নগর্ভ সমাজসত্তার শিল্পিত আত্মপ্রকাশের পথ সুপ্রশস্ত হয়। রক্তিম অভিজ্ঞতা থেকে দ্বন্দ্বোত্তরণের শিল্পশক্তি অর্জন করে জীবনলগ্ন ও প্রগতিপরায়ণ শিল্পীমানস।
এক দ্বন্দ্বক্ষুব্ধ, জটিল ও রক্তাক্ত সময়ের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হাসান হাফিজুর রহমানের কবিজীবন। এই সময়ের ইতিহাস 'নিরন্তর অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতার এবং এগুলো থেকে ক্রম-মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস।' লাল-কালো রেখায় চিহ্নিত সময়পরম্পরায় বিচিত্র বিপ্রতীপ অভিজ্ঞতার মধ্যেও তিনি এক সদর্থক শিল্পাদর্শে উত্তরণের সাধনা করেছেন। বলা বাহুল্য, এই উত্তরণের বীজমন্ত্র তিনি লাভ করেছেন ভাষা আন্দোলন থেকে। একুশে ফেব্রুয়ারির ঘটনাপ্রবাহ থেকেই হাসান হাফিজুর রহমান তার কর্মী ও শিল্পীসত্তার মধ্যে অচ্ছেদ্য সম্পর্ক নির্ণয়ে সমর্থ হয়েছেন। যে চার দশকের সময় পরিসরে তার জীবন ও কর্মধারা প্রবাহিত, তার সামাজিক-রাজনৈতিক কাঠামোর রূপ ও রূপান্তর তার সংবেদনশীল মনকে প্রভাবিত করেছে গভীরভাবে। উলি্লখিত সময়সীমায় জাতির মেধা, মনন ও আবেগজীবনে যে অস্থিরতা, ক্ষোভ, দ্রোহ, উল্লাস ও যন্ত্রণার পুঞ্জীভবন ঘটেছিল, তার কাব্যসাধনার সঙ্গে তা জড়িয়ে গেছে অভিন্নসূত্রে। সময়, সমাজ ও ইতিহাসকে তিনি স্থাপন করেছেন চেতনার কেন্দ্রমূলে এবং জীবন ও রাষ্ট্রীয় বিন্যাসের অনিবার্যতা তাকে যে মধ্যবিত্তের অস্তিত্ব কাঠামো দিয়েছিল, আত্মসন্ধান ও সত্তাসন্ধানের প্রবলতায়, সমষ্টি অস্তিত্বের যন্ত্রণা পীড়নের ধারাবাহিকতায় এবং ত্যাগ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তাকে অতিক্রম করে গেছেন তিনি। সমকালের আত্মাকে স্পর্শ করতে পারার সক্ষমতায় তার কবিমন সময়ের পরিবর্তন-পরম্পরার মধ্যেও ছিল সদাজাগ্রত, ক্রিয়াশীল।
হাসান হাফিজুর রহমানের মন ও মননে গোড়া থেকেই ব্যক্তি-আবেগ সংঘ-আবেগের অংশ হিসেবে গৃহীত। লুই আরাগঁ কিংবা পল এল্যুয়ারের মতো কাব্যাদর্শের দ্বন্দ্বে তিনি নিক্ষিপ্ত হননি কখনও। বরং বিংশ শতাব্দীর উদার মানবতাবাদের চারিত্রলক্ষণযুক্ত সাম্যবাদী ধ্যান-ধারণা_ যা স্টিফেন স্পেন্ডার কিংবা ডবি্লউ এইচ অডেনের মানসধর্ম_ হাসান হাফিজুর রহমানের কবিস্বভাবে সেরূপ সমন্বয়ের দৃষ্টান্ত প্রচুর। বাঙালি মুসলমানের কাব্যসাধনার পূর্বতন ধারা সমাজ ও ইতিহাসের পটে স্থাপন করে তার সত্যস্বরূপ নির্ধারণ করেছেন তিনি। বিভাগোত্তরকালীন সমাজবাস্তবতায় এযাবৎকালের উৎকেন্দ্রিক ও বহির্মুখী চেতনার রূপান্তর তার কাছে অনিবার্য মনে হয়েছে।
আত্মজিজ্ঞাসা ও সত্তাসন্ধানের সমগ্রতায় কবি জীবনের সূচনা থেকে এভাবেই হাসান হাফিজুর রহমান স্বতন্ত্র শিল্প অভিপ্রায়ে বিশিষ্ট হয়ে ওঠেন। সমকালীন বাংলা কবিতার বিষয়-সংকটকে তিনি গভীরভাবে অনুধাবন করেছিলেন। তিরিশের কবি-পুরুষরা যে দ্বন্দ্ব ও অগ্রগতির প্রক্রিয়ায় চৈতন্য স্থাপন করে সমাজ, সময় ও সভ্যতালগ্ন হয়েছিলেন, বিভাগোত্তরকালের কবিতায় তার স্পন্দন দুর্লক্ষ্য। চলি্লশের দশকের নবোদ্ভূত প্রগতিবাদী ও জীবনলগ্ন কাব্যধারাও দেশ-বিভাগ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, রাষ্ট্রাদর্শের পশ্চাৎগতি প্রভৃতি ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় হয়ে পড়েছিল অবরুদ্ধ। ১৯৪৮ সাল থেকে সূচিত ভাষা আন্দোলন, দ্বন্দ্ব-জটিল সমাজ-রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ, সমাজমানসের স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের দুঃসহ বাস্তবতা এবং ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির প্রতিবাদ ও আত্ম-উজ্জীবন সংবেদনশীল শিল্পীচিত্তে হয়ে উঠেছিল নবসৃষ্টির পথনির্দেশনা। ফলে, অতীত-গর্ভ উত্থিত প্রতিক্রিয়াশীল রাষ্ট্রীয় আদর্শ হলো পরিত্যাজ্য; গণতন্ত্র, সাম্যবাদ, ধর্মনিরপেক্ষ জীবনদৃষ্টি প্রভৃতি মানবকল্যাণধর্মী মতাদর্শ ও চিন্তাধারা শিল্পকলার মৌল উপাদানে পরিণত হওয়ার অবকাশ পেল। শিল্পী যেহেতু সমাজের প্রাগ্রসর চেতনার প্রতিভূ, সে কারণে এ পটভূমিতে শিল্পীর দায় বৃদ্ধি পেল বহুগুণে। বাংলাদেশের কবিতায় হাসান হাফিজুর রহমান সেই দায় বাস্তবায়নের অগ্রবর্তী সংগ্রামী শিল্পীপুরুষ।
হাসান হাফিজুর রহমানের সংগ্রাম কেবল ১৯৪৭-৫৩ কালসীমার মধ্যেই আবদ্ধ ছিল না। যে ব্যাপক ও চিরায়ত অর্থে ভাষা মানব-অস্তিত্ব ও সংগ্রামের প্রতীক, জীবন, কর্ম ও শিল্পসাধনার মধ্য দিয়ে তাকেই প্রতিষ্ঠা করে গেছেন তিনি। ভাষা সংগ্রামকে তিনি বাঙালির অস্তিত্বসংগ্রাম ও রাজনৈতিক সংগ্রামের সঙ্গে সমীকৃত করেছেন।
তথ্যনির্দেশ
আজাদ, হুমায়ুন : ১৯৯০, ভাষা আন্দোলন : সাহিত্যিক পটভূমি, দ্য ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ঢাকা
আহমদ, কামরুদ্দীন : ১৩৮২, পূর্ব বাংলার সমাজ ও রাজনীতি, ইনসাইড লাইব্রেরি, ঢাকা
উমর, বদরুদ্দীন : ১৯৭৯, পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা
খান, রফিকউল্লাহ : ২০০৭, হাসান হাফিজুর রহমান : জীবন ও সাহিত্য, ঐতিহ্য, ঢাকা
রহমান, খালেদ খালেদুর (সম্পাদিত) : ১৯৮৩, হাসান হাফিজুর রহমান, ঢাকা
হক, আজীজুল : ১৯৮৫, অস্তিত্বচেতনা ও আমাদের কবিতা, বাংলা একাডেমী, ঢাকা
হক, আবুল কাসেম ফজলুল : ১৯৭২, মুক্তিসংগ্রাম (প্রথম পর্ব), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
লেখক : অধ্যাপক
বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।





